সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বড় হওয়া তরুণ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাংকেনস্টাইন। উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তিনি, তার মাথায় তখন ভূত চাপে তিনি মৃত মানুষকে জীবিত করবেন তো করবেনই। যাকে কিনা ইংরেজিতে বলে নেক্রোম্যান্সি, কিন্তু বিজ্ঞানের সহায়তায়। কিন্তু কীভাবে করা যায় এ কাজ?
মরা লাশ জ্যান্ত করার চিন্তা আসার পেছনেও কারণ আছে। ক’দিন আগে তার মা ক্যারোলাইন মারা গেছেন জ্বরে ভুগে। কোনোমতে বেঁচে গেছে তার বাগদত্তা এলিজাবেথ। তখন থেকেই এ চিন্তা ঘুরছে।
ফ্রাংকেনস্টাইন শেষমেশ একটা পরিকল্পনা দাঁড়া করিয়ে ফেললেন বটে। রসায়ন, আলকেমি আর তড়িৎশক্তি ব্যবহার করে তিনি একটি মৃত দেহকে জাগিয়ে তোলেন। কিন্তু মরা লাশ পুরোপুরি মানুষ হয়ে ফেরেনি। ফেরে এক দানব হয়ে।
ভিক্টর তখন মনে মনে এক অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন। তিনি এক দানব সৃষ্টি করলেন। কিন্তু দানবটিকে পালবার কোনো উপায় যে রাখেননি। দেখতেও কদাকার। নিজের সৃষ্টি থেকে পালিয়ে গেলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছের এক সরাইখানায় গিয়ে মদে চুর হয়ে গেলেন ফ্রাংকেনস্টাইন।
ওদিকে দানব পালিয়ে গেল। আর ক’দিন বাদে ফ্রাংকেনস্টাইনের ছোট ভাই উইলিয়াম খুন হলো। খুনি যে সেই দানব নিজেই সেটা বুঝতে ফ্রাংকেনস্টাইনের দেরি হলো না। কেন এ কাজ করছে দানবটি?
বহু ঘাটের জল পেরিয়ে মুখোমুখি হয় দানব আর তার স্রষ্টা ফ্রাংকেনস্টাইন। পরিষ্কার জানিয়ে দিল, মানবজাতির প্রতি তার আক্রোশ নেই, আক্রোশ তার নিজের স্রষ্টার প্রতি। তাই একে একে ফ্রাংকেনস্টাইন পরিবারকে শেষ করবে সে, তার কাছের পরিবার পরিজনকে। দানবের একটাই আবদার, সে তার প্রজাতির একা প্রাণী। তাকে সঙ্গিনী বানিয়ে দিক ফ্রাংকেনস্টাইন।
কিন্তু অস্বীকৃতি জানিয়ে ভুল করে বসেন ফ্রাংকেনস্টাইন, এখন কি তিনি পারবেন তার প্রেয়সী এলিজাবেথকে বাঁচাতে?
এতক্ষণ যা পড়ছিলেন সেটি মেরি শেলির লেখা ১৮১৮ সালে প্রকাশিত বহুল আলোড়ন তোলা বই ফ্রাংকেনস্টাইনের সারমর্ম। বাকিটা না হয় উহ্যই থাক গল্পের। কিন্তু ভ্যাম্পায়ারের গল্পের যুগে এক বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী কীভাবে লিখে ফেলেছিলেন মেরি শেলি? তার পেছনের গল্পটা কিন্তু আঁধারি। আর সে গল্পটা নিয়েই হলিউডের পর্দায় এলো Mary Shelley ছবিটি। ফিল্মটি মুক্তি পায় ২০১৮ সালের ২৫ মে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আজও অনেকে ফ্রাংকেনস্টাইনকেই দানব বলে ভুল ভাবেন, আসলে ফ্রাংকেনস্টাইন কেবল দানবটির স্রষ্টা।
ছবিটি বানিয়েছেন কিন্তু সৌদি আরবের প্রথম নারী ছবিনির্মাতা হাইফা আল-মনসুর (هيفاء المنصور)। অবাক হচ্ছেন বুঝি? সৌদি আরবের নামকরা আর সবচেয়ে বিতর্কিত পরিচালকদের মাঝে তিনি একজন। একজন নারী হিসেবে দু’শ বছর আগের একজন নারীর জীবন ফুটিয়ে তুলবার কাজটি তিনি করেছেন এ ছবিতে।
মুভির শুরুতেই দর্শক জানতে পারেন মেরি শেলির মা যে মারা গেছেন সে বিষয়ে। বাবা আর সৎ মায়ের কাছে বড় হওয়া মেরি জন্ম নিয়েছিলেন খোদ লন্ডনে, অষ্টাদশ শতকের একদম শেষদিকে (১৭৯৭ সালে)। তার বাবা উইলিয়াম গডউইন ছিলেন ডাকসাইটে লেখক, বিশ্লেষণ করতেন রাজনীতি।
বাবার নতুন স্ত্রীর আগের ঘরের মেয়ে ক্লেয়ার মেরি জেন ক্লেয়ারমন্ট এ ছবির আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মেরি শেলির (তখনো তার নাম অবশ্য শেলি হয়নি) সাথে তার খুব খাতির, যতই সৎ বোন হোক না কেন।
ওদিকে লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে এত মনোযোগ উইলিয়াম দিতেন না মেয়েদের ওপর, নতুন স্ত্রী আসবার পরেও। যদিও মেরির আরো বোন ও সৎবোন বাস্তবে ছিল, তাদেরকে ছবিতে দেখানো হয়নি।
ছোট থেকেই লেখালেখি করতে চেষ্টা করতেন মেরি, কিন্তু বাবা বারবার বলতেন, তোমার লেখায় যেন অন্যের ছাপ না থাকে। তোমার নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে বের কর। সেটাই তোমার পরিচিতি।
আমাদের গল্পের শুরু আসলে সৎ মায়ের সাথে মেরির ঝগড়াঝাটির পর থেকে। বাবা উইলিয়াম তখন অনিচ্ছাসত্ত্বেও মেয়ে মেরিকে নিকটাত্মীয় উইলিয়াম বেক্সটারের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। প্রায় ষোড়শী মেরি ভাবছিলেন অচেনা এ জায়গায় এসে মন মরা হয়ে থাকবে। কিন্তু কীসের কী?
কথায় আছে না, ষোল বছরের কিশোরী প্রেম? সেই প্রেমের দেখা পেয়ে যান মেরি, তাও যেন তেন কারো সাথে নয়, সুদর্শন কবি পার্সি বিশি শেলির সাথে! আসলে, সে বাড়িতে কবি পার্সি শেলি দাওয়াত পেয়েছিলেন। আর তখন থেকে পার্সির সাথে বন্ধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে মেরির। আর সেই বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গড়ায় প্রণয়ে।
বেক্সটারের বাড়ি থেকে যখন মেরি নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন তখন পার্সির প্রেমে পুরোই মত্ত। দিন যেন আর কাটে না। এরই মাঝে যখন একদিন তিনি আবিষ্কার করেন নিজের বাড়িতে বাবার অতিথি হয়ে এসেছেন পার্সি, তার আনন্দ কি লুকোনো থাকে?
কিন্তু শীঘ্রই অবাক হয়ে তিনি আবিষ্কার করেন পার্সি আসলে বিবাহিত। এবং পার্সি আসলে বিশ্বাস করেন না যে, কেউ একা একজনের প্রেমে আবদ্ধ থাকতে পারে। অবশ্য স্ত্রীর সাথে তার বনিবনা হচ্ছিল না। পার্সি নিজে অবশ্য চাচ্ছিলেন মেরিকে বিয়ে করে ফেলতে।
বাধ সাধেন মেরির বাবা উইলিয়াম। কোনোমতেই তিনি পার্সির সাথে মেরির বিয়ে দেবেন না, যতদিন পার্সির আগের বিয়ে বিচ্ছেদ না হয়।
এরকম অবস্থাতে মেরি পালিয়ে গেলেন নিজের সেই সৎবোন ক্লেয়ারকে নিয়ে। ওদিকে মেরির গর্ভে তখন পার্সির সন্তান। আর সেই সন্তান জন্মের পর পর মারা গেল বৃষ্টির পানি লেগে ঠাণ্ডায়। সে জন্য পার্সিকেই দুষলেন মেরি, কারণ পাওনাদারদের তাড়া খেয়ে পার্সি বৃষ্টিস্নাত রাত্তিরেই পালিয়ে গিয়েছিলেন শিশুকে নিয়ে।
তবে ক্লেয়ারের সাথে সুসম্পর্ক ছিল পার্সির। তাকে নিয়ে কবিতেও লিখেছিলেন। কিন্তু মেরির পুরো জগৎ যেন নাড়া দিয়ে ওঠে যখন একদিন পার্সির এক বন্ধু এসে চড়াও হতে চায় মেরির ওপর। পার্সি বাড়ি ফিরে এলে মেরি সে ঘটনা তাকে বললেন, পার্সি তাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, আমাকে বলো না যে তুমি আমার বন্ধুটিকে না করেছিলে! পার্সির প্রতি তার ভালোবাসা কেমন যেন ঘৃণায় পরিণত হতে থাকে। এক উগ্র অন্ধকার জীবনের সাথে পরিচিত হতে থাকেন মেরি।
এমন সময় কবি বায়রনের সাথে পরিচিত হয় ক্লেয়ার, তারা চুটিয়ে প্রেম করতে থাকেন। ক্লেয়ারের গর্ভে বায়রনের সন্তান বড় হতে থাকে। আর এ অবস্থায় বায়রন তাদের আমন্ত্রণ করেন সুইজারল্যান্ডে, সাথে আরেক বন্ধু চিকিৎসক পলিডরি।
কোনো একদিন মৃতদেহ নিয়ে পলিডরিকে কাজ করতে দেখেন বলে মনে হলো মেরির। সেটি তার মনে গেঁথে যায়। অন্যদিকে, পার্সি আর বায়রনের নিয়ন্ত্রণহীন আঁধারে জীবন সহ্যই করতে পারছিলেন না মেরি।
এক বাজে আবহাওয়ার দিন তাদের বাসায় বন্দী হয়ে থাকতে হলো। সেই রাতে লর্ড বায়রন প্রস্তাব করলেন এক প্রতিযোগিতার। সবাই হরর গল্প লিখে জমা দেবে, কারটা সেরা হয়। সবাই রাজি হয়ে গেল।
ড্রাকুলার জনপ্রিয়তার যুগে বায়রন আর পলিডরি দুজনেই লিখলেন ভ্যাম্পায়ার নিয়ে কাহিনী। কিন্তু মেরি কী লিখলেন? এ লেখার গোড়াতে যে কাহিনী আপনারা পড়ছিলেন, সেই ফ্রাংকেনস্টাইনের গল্প। গ্রিক পুরাণে প্রমিথিয়াস যেভাবে কাদামাটি দিয়ে মানুষের আকার বানিয়েছিলেন, সেভাবে ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবকে তিনি নাম দিলেন নতুন প্রমিথিয়াস।
কিন্তু সমস্যা হলো, একজন নারীর লেখা তো প্রকাশকেরা নেবেন না। সত্যিই পাত্তা পেল না। হ্যাঁ, প্রকাশিত হবে কেবল এক শর্তে, যদি পার্সি বিশি শেলির নাম দিয়ে বের হয়। মেরি কি শেষ পর্যন্ত নিজের পরিচয় বাদ দিয়ে পার্সির পরিচয় নেবেন?
মেরি কি নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাবেন না?
২০০ বছর বাদে মেরি শেলির ফ্রাংকেনস্টাইনের কথা সবাই জানে। তার মানে তিনি তার নিজের পরিচয় খুঁজে পেয়েছিলেন। কিন্তু কীভাবে? সেজন্য দেখে ফেলুন মেরি শেলি নামের মুভিটি। আর তার জীবনী নিয়ে রোর বাংলার আর্টিকেল পড়তে চাইলে ক্লিক করুন এখানে: মেরি শেলি: ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের আড়ালে এক সংগ্রামী নারীর গল্প। আর ফ্রাংকেনস্টাইন গল্পটি নিয়ে পড়তে চাইলে: ফ্রাঙ্কেনস্টাইন: বইয়ের পাতায় জীবন্ত দানব।
মেরির চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন এলা ফ্যানিং। আর সুদর্শন পার্সির চরিত্রে আছেন ডগলাস বুথ, যিনি আগে রোমিওর চরিত্রেও অভিনয় করেছিলেন। এছাড়া ব্যাক্সটার পরিবারের এক মেয়ের চরিত্রে আছেন গেম অফ থ্রোন্সের আরিয়া-খ্যাত মেইসি উইলিয়ামস।
চমৎকার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সাথে সাথে এ ছবিতে বোনাস হিসেবে আপনি পাবেন পার্সি শেলির অসাধারণ সব কবিতার চরণ, যেগুলো আপনাকে উপহার দেবে এক কাব্যিক ভাব।
আইএমডিবিতে ৬.৩/১০ রেটিংকে কিছুটা কম ধরা হলেও, ফ্রাংকেনস্টাইনের পেছনের কথা যদি আপনি জানতে চান, তবে দু’ঘণ্টার এ মুভিটি আপনাকে হতাশ করবে না, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ফিচার ফটো: Los Angeles Times