পূর্বে পশ্চিমা বিশ্বের মিডিয়াগুলোতে সংখ্যালঘুদের বাঁধাধরা কিছু চরিত্র চিত্রায়িত করা হতো। আদি আমেরিকানদেরকে দেখানো হতো বর্বর হিসেবে, আফ্রিকান আমেরিকান ও হিস্পানিকদের চিত্রায়িত করা হতো হিংসাত্মক হিসেবে এবং এশিয়ানদের ব্যঙ্গ করা হতো পুরু বাচনভঙ্গির বিবেকহীন দোকানদার হিসেবে। বর্তমানে এ ধরনের চিন্তাভাবনা অনেকাংশেই প্রশমিত হয়েছে। তবে ৯/১১ এর পরবর্তী সময়ে তৈরি হওয়া ইসলাম বিদ্বেষকে বারবার উস্কে দেওয়ার জন্যই যেন কিছু টিভি, সিনেমা, বইয়ে মুসলিমদের চরমপন্থী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। নিজেদের ইসলামিস্ট দাবি করা সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডগুলোকে গল্প, কল্পকাহিনীতে উপস্থাপনের পদ্ধতি এত শক্তিশালী যে, সাধারণ পশ্চিমাদের মাঝে ভয়ের সাথে সাথে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণার পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। আর এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্যই যেন জনপ্রিয় কমিক্স প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘ডিসি কমিক্স’ তাদের ইউনিভার্সে মুসলিম সুপারহিরোদের তালিকাভুক্ত করছে। তো চলুন, সুপার ভিলেনদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তি, সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য তালিকাভুক্ত হওয়া দুই মুসলিম সুপারহিরো সম্পর্কে জেনে আসি।
বিলাল আইশালাহ: দ্য নাইট রানার
প্যারিসের ব্যাটম্যান খ্যাত আলজেরিয়ান সুন্নি মুসলিম ‘বিলাল আইশালাহ’র পৃথিবী ২০০৫ সালের ফ্রান্সের দাঙ্গার পূর্ব পর্যন্ত সাধারণ ফ্রেঞ্চ-মুসলিমদের মতোই ছিল। যদিও অন্য তরুণদের মতো বিলাল দাঙ্গায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিল না, কিন্তু দাঙ্গা চলাকালীন বন্ধু আরিফ সহ সে পুলিশের হাতে গ্রেফতার এবং প্রহৃত হয়। ঘটনাটা ঘটে তার ১৬তম জন্মদিনে। পরবর্তীতে প্রতিশোধ গ্রহণের অভিপ্রায়ে আরিফ স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে আগুন লাগানোর চেষ্টা করে এবং সেখানেই দগ্ধ হয়ে মারা যায়। বন্ধুর মৃত্যু বিলালকে পুরোপুরি বদলে দেয়। সে বুঝতে সচেষ্ট হয়, এসব দাঙ্গা, হাঙ্গামা, জাতিগত উত্তেজনাগুলোর জন্য বিক্ষোভকারী এবং পুলিশ উভয়েই দায়ী। এই সদ্য লাভ করা সুনীতি এবং মার্শাল আর্ট ‘পার্কোর’ এর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সে স্থানীয় অরাজকতাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করে এবং ‘নাইট রানার’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ঐ সময়ে বিলাল এমন একটি চক্রের কথা জানতে পারে, যেটি শহরে নানান রকম দুর্বৃত্তপনা, নৈরাজ্য সৃষ্টির সাথে জড়িত। তাদেরকে ধাওয়া করার সময় তার সাথে ব্যাটম্যান এবং রবিনের দেখা হয়ে যায় এবং তারা দলবদ্ধ হয়ে ঐ চক্রটিকে পরাভূত করে। পরবর্তীতে প্যারিস থেকে ফেরার পূর্বে ব্যাটম্যান বিলালের জন্য একটি অ্যাপার্টমেন্টের ব্যবস্থা করে এবং রবিনকে তার প্রশিক্ষক হিসেবে প্যারিসেই রেখে যায়। প্রশিক্ষণ শেষ হলে, সে ‘ব্যাটম্যান ইনকর্পোরেটেড’ এর ফ্রেঞ্চ প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়। বিলালের এই নতুন আবির্ভাব সাধারণ মানুষের মাঝে তার প্রতি ক্ষোভ এবং অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। তারা তাকে পুলিশের সহচর হিসেবে আখ্যায়িত করার মাধ্যমে এড়িয়ে যেতে শুরু করে। ফ্রান্সের মুসলিমদের মাঝে সে নিদারুণ অবজ্ঞার পাত্র হিসেবে পরিগণিত হয়, কেননা তাদের ধারণা- বিলাল আমেরিকানদের মতো মুসলিম বিশ্বাসকে ঘৃণা করে।
এমন পরিস্থিতিতে সে ব্যাটম্যানের সাহায্য চায় এবং অনুরোধ করে, তাকে দেওয়া দায়িত্ব যেন অন্য কাউকে প্রদান করা হয়। ব্যাটম্যান তাকে কাজে লেগে থাকতে বলে এবং আশ্বাস দেয় যে, একদিন অবশ্যই মানুষ তার মহত্ব বুঝতে পারবে। এছাড়াও আরেকটি ঘটনা বিলালকে তার কাজে করতে অনুপ্রেরণা যোগায়। একদিন রাতে শহরে পাহারা দেওয়ার সময় বিলাল দেখতে পায়, দুটি ছেলে একটি কাপড়ের টুকরো নিয়ে ঝগড়া করছে। কিছুক্ষণ পর সে আবিষ্কার করে, ছেলে দুটি আসলে বাড়িতে তৈরি একটি মুখোশ নিয়ে তর্ক করছে। ‘কে প্রথমে তাদের হিরো নাইট রানারের মুখোশ পরিধান করবে’ সেই বিষয়ে নিজেদের পক্ষে সাফাই গাইছে। ঘটনাটি বিলালের মাঝে নতুন করে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং তাকে দেওয়া ‘প্যারিসের ব্যাটম্যান’ ভূমিকাটি পুরোপুরি গ্রহণ করে।
ডিসি কমিকের চরিত্রটির প্রথম আবির্ভাব হয় ‘Detective comic annual #12’এ ডেভিড হাইন এবং কাইল হিগিন্সের হাত ধরে। ২০০৫ সালে ফ্রান্সের ক্লিশি-সু-বয়েস থেকে শুরু হওয়া দাঙ্গার সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে এটি নির্মিত। চরিত্রটি অ্যাক্রোবেটিক নানান কৌশলে পারদর্শী। তার ‘পার্কোর’ এবং ‘ফ্রি রানিং’ দক্ষতা ব্যাটম্যানের সাথে সমতা বজায় রেখে চলতে সাহায্য করে। হ্যান্ড-টু-হ্যান্ড কমব্যাটে তার দক্ষতা সাধারণ হলেও, পরবর্তীতে রবিনের সাহায্যে প্রশিক্ষণের ফলে সে পর্যাপ্ত দক্ষ হয়ে ওঠে। সে ‘দ্য ডার্ক অ্যাথলেট’ হিসেবেও সর্বাধিক সমাদৃত।
সাইমন বাজ: গ্রিন ল্যান্টার্ন
৯/১১ এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমাবাজির সময় যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডিয়ারবর্নে বসবাসরত লেবানিজ বংশোদ্ভূত সাইমন বাজের বয়স ছিল মাত্র ১০। এই ধ্বংসাত্মক বোমাবাজির ফলাফল স্বরূপ আমেরিকায় বসবাসরত অন্যান্য আরব-মুসলিমদের মতো সাইমন এবং তার বোন সিরাও বিভিন্ন হয়রানির শিকার হয়। ধীরে ধীরে আমেরিকানদের কাছে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য সাধারণ মুসলিমদের দোষ দেওয়াটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে। অন্যান্য মুসলিমদের মতো সাইমন বাজ এবং তার বোনও নানারকম বিদ্বেষ এবং হয়রানি থেকে রক্ষা পায় এবং স্বাভাবিক জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে উঠে। পরবর্তীতে সে অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উপর ডিগ্রি লাভ করে এবং ডেট্রয়িট’স অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেয়। তার বোনও বিয়ে করে সুখী সংসার শুরু করে।
অটোমোটিভসের প্রতি সাইমনের অনুরাগ তাকে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ স্ট্রিট-রেসিং এর ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলে। একদিন বোনের স্বামী নাজির আমরের সাথে প্রতিযোগিতাকালে গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হয়। ফলাফল স্বরূপ, নাজির মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং কোমায় চলে যায়। দুর্ঘটনার জন্য সাইমন নিজেকে দায়ী করে এবং নাজিরের চিকিৎসা সহ পরিবারের অন্যান্য খরচের দায়ভার গ্রহণ করে। কিন্তু এর পরপরেই সে অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রির চাকরি হারায়, যা তাকে আর্থিকভাবে অসচ্ছল করে তুলে। পরিস্থিতি তাকে গাড়ি চোর হতে বাধ্য করে।
একদিন একটি গাড়ি চুরির পর সাইমন আবিষ্কার করে গাড়িটির পিছনের সিটে বিপজ্জনক বিস্ফোরক স্থাপন করা রয়েছে, সেগুলো যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে। বিস্ফোরণের ফলে কারো যাতে ক্ষতি না হয়, সে কথা বিবেচনা করে সে গাড়িটিকে একটি পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরির নিয়ে যায় এবং অল্পের জন্য বিস্ফোরণের হাত থেকে রক্ষা পায়। এর পরপরই পুলিশ তাকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হিসেবে গ্রেফতার করে।
জিজ্ঞাসাবাদের প্রথম দিন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সাইমন তার জড়িত থাকার ব্যাপারটি অস্বীকার করে। পরে পুলিশ তাকে এফবিআই এর হেফাজতে পাঠিয়ে দেয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এজেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ফেডকে নিয়জিত করে। এজেন্ট ফেড জিজ্ঞাসাবাদের কৌশলে পরিবর্তন আনে এবং সাইমনকে টর্চার সেলে নিয়ে যায়। ভীতসন্ত্রস্ত সাইমন বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করে এবং আকস্মিকভাবে ফেডের সাহায্যকারী দুই এজেন্টের উপর চড়াও হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য এজেন্ট ফেড তার আগ্নেয়াস্ত্র বের করে এবং সাইমনেকে গুলি করতে উদ্যত হয়। ঠিক সেই সময়ে হাল জরডান এবং থাল সিনেস্ট্রোর ল্যান্টার্ন পাওয়ার রিংটি দালান ভেঙে টর্চার সেলে এসে সাইমনের আঙুলে স্থাপিত হয়ে রিংটির নতুন মালিক হিসেবে নিয়োজিত করে এবং বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যায়।
গ্রিন ল্যান্টার্নদের সাধারণ ক্ষমতা ছাড়াও সাইমন বাজের রয়েছে ভবিষ্যৎ দর্শনের ক্ষমতা। তাছাড়া বোনের স্বামী নাজির আমরকে কোমা থেকে সারিয়ে তোলার ব্যাপারটি খেয়াল করলেই তার অদম্য ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে আরোগ্য করে তোলার সক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া প্রথমদিকে সে পাওয়ার রিং এর জ্বালানি যেকোনো সময় নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে সন্দেহ করে সবসময় ব্যাকআপ হিসেবে সাথে আগ্নেয়াস্ত্র রাখতো!
চরিত্রটি ডিসি কমিক্সে প্রবেশ করে মিশিগানে জন্ম নেওয়া আধা-লেবানিজ, গ্রিন ল্যান্টার্ন লেখক জিউফ জনসের হাত ধরে। বলা বাহুল্য, সাইমন বাজের উপর লেখকের বাস্তব জীবনের বেশ প্রভাব রয়েছে।
ফিচার ছবি: insidepulse.com