“আপনি তো ডাক্তার, তাই আমার একটা প্রশ্ন ছিল। কখনো কখনো আমার নিজেকে নিজের ভালো লাগে না। এ ব্যাপারে কি কোনো সাহায্য করতে পারবেন?”
ভগ্নিপতি ওয়াল্টারকে করা এই প্রশ্নটি আমাদের সামনে তুলে ধরে আসল ব্যারিকে। আমরা বুঝতে পারি তার মানসিক অবস্থা, সহজাত আচার-আচরণের কারণ, এবং সর্বোপরি পরিপূর্ণভাবে নিজের ইচ্ছামতো জীবনযাপন করতে না পারার যাতনা।
‘পাঞ্চ-ড্রাংক লাভ’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় ২০০২ সালের ১৯ মে। ৯৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমাকে সূচিত করা যায় দুই মুখ্য ব্যক্তিত্বের ভিন্ন পথে চলার প্রজেক্ট হিসেবে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা অ্যাডাম স্যান্ডলারের ক্ষেত্রে এই অভিগমন নিজের শিল্পীসত্তার সাথে সকলকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার। কেননা, এখানে তাকে পুরোপুরি নিজের অভিনয় শৈলীতে আত্মনিয়োগ করতে দেখা গেছে। ঐ সময়ে তার অভিনীত অন্যান্য চরিত্রের বৈশিষ্ট্যসূচক অ্যান্টিক, ফিজিক্যাল কমেডি বা ভাঁড়ামো এখানে অনুপস্থিত। অন্যদিকে, পরিচালক পল থমাস অ্যান্ডারসনের ক্ষেত্রে এটি ছিল ভিন্নধর্মী কিছু করার সুযোগ। পাঞ্চ ড্রাংক লাভের আগে আগে অ্যান্ডারসন সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন তিনটি- হার্ড এইট (১৯৯৬), বুগি নাইটস (১৯৯৭), এবং ম্যাগনোলিয়া (১৯৯৯)।
বুগি নাইটস এবং ম্যাগনোলিয়া বিশেষ করে তাকে চলচ্চিত্র বিশ্বে একজন সিরিয়াস ফিল্মমেকার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। তাই পাঞ্চ-ড্রাংক লাভে তাকে আমরা নতুন ধরনের কিছু করতে দেখলাম, যা আগের দুটি চলচ্চিত্রের ডিমান্ডিং কোনো প্রজেক্ট না। দৈর্ঘ্যের দিক থেকেও এটি আগের দুটির তুলনায় সংক্ষিপ্ত। রোমান্টিক কমেডি বলা হলেও একে এই ধারার আর দশটা সিনেমার কাতারে ফেলা যাবে না। গল্পে আমরা একটি রোমান্সের প্রস্ফুটন দেখি, কিন্তু হাস্যরসের উপস্থিতি খুব যে বেশি তা কিন্তু না। সাধারণ দর্শকের ঠোঁটে হয়তো মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠবে, তবে এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয় কদাচিৎ। একটি ব্যাপার হলো- অমনোযোগী দর্শক হলে হয়তো হাস্যরসের পরিস্থিতিগুলো মিস করে যাবেন। কারণ, এসবের অধিকাংশই ঘটে সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ডে।
সিনেমার গল্প আবর্তিত হয় ব্যারি ইগানকে (অ্যাডাম স্যান্ডলার) ঘিরে। সে একজন পূর্ণবয়স্ক কর্মজীবী পুরুষ, যার গুরুতর ইমোশনাল সমস্যা আছে। সমাজের স্বাভাবিক রীতিনীতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার পাশাপাশি তার রয়েছে বর্ডারলাইন অ্যাগোরাফোবিয়া। ফলে কোনো কাজ করার বা পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার বদলে নিজের কমফোর্ট জোনে থাকাকেই সে প্রাধান্য দেয় বেশি। প্রায়শই তাকে নিজের মেজাজ এবং কান্নার উপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে দেখা যায়। গুদামে বসে বিবিধ টয়লেট সামগ্রী বিক্রি করা ব্যারি হঠাৎ করেই খুঁজে পায় একটি মার্কেটিং লুপহোল। এই লুপহোল ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে সে পাবে বিনা খরচে বিমানপথে এক মিলিয়ন মাইল ভ্রমণের সুযোগ। এজন্য তাকে কেবল তিন হাজার ডলার মূল্যের হেলদি চয়েস ব্র্যান্ডের পুডিং কিনতে হবে। এরপর জীবনেও বিমান ভাড়া দিতে হবে না। কিন্তু ঝামেলা হলো- সে কারো সাথে মেশে না, বিমানেও কখনো ওঠেনি, নেই কোথাও যাবার মতো কোনো জায়গাও। নিজের ব্যাপারে তার সরল স্বীকারোক্তি,
“আমি জানি না আমার কোনো সমস্যা আছে কিনা, কারণ অন্য মানুষেরা কেমন তা আমার জানা নেই।”
একসময় তার সাথে দেখা হয় লেনার (এমিলি ওয়াটসন)। জাতিতে ব্রিটিশ, লাজুক, মৃদুবাক লেনা আবার ব্যারির সাত বোনের এক বোনের সহকর্মী। লেনার ব্যারিকে ভালো লেগে যায়, ব্যারিরও ভালো লাগে তাকে। ক্ষণকাল পরেই উভয়ে ভাসতে শুরু করে প্রেমের ভেলায়। কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট জীবন তো আর তার ললাটে লেখা নেই। তাই আবারও ঝামেলা আসে ছায়া সঙ্গী হয়ে। একবার সঙ্গী পাওয়ার আকুলতায় সে কল করে পত্রিকার বিজ্ঞাপনে দেখা একটি নাম্বারে। কল করার সময় সে ভুলেও ভাবেনি সেটি ফোন সেক্স অফার করা কোনো চক্রের নাম্বার। যতক্ষণে বুঝতে পারে, ততক্ষণে জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। ফলে ঐ কর্তৃপক্ষ আর ব্যারির মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এবার আসা যাক সিনেমা হিসেবে পাঞ্চ-ড্রাংক লাভ কেন সফল সেই আলোচনায়। কেন এটি গতানুগতিক অন্যান্য রমকমকে ছাপিয়ে গেছে; কীভাবেই বা অ্যান্ডারসন আর স্যান্ডলারের ফিল্মোগ্রাফির ভিন্নধর্মী সিনেমা হয়েও- প্রাঞ্জলতার সাথে ধারণ করেছে তাদের সিনেমার সহজাত বৈশিষ্ট্যসমূহকে। পরিচালক নিজেও স্যান্ডলারকে পছন্দ করেন। তার গতানুগতিক কমেডিগুলোও দেখেন। হয়তো তার কাছে মনে হয়েছিল- স্যান্ডলারের ঐ সকল সিনেমায় সবকিছু থাকলেও কোনোকিছুর খামতি রয়েছে। এই খামতি দূর করতেই তিনি স্যান্ডলারের স্ক্রিন পার্সোনা অনুযায়ী স্ক্রিপ্ট সাজান। প্রথমে তাকে নিয়ে কাজ করবেন শুনে অনেকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেও নিজের কাজ ঠিকমতো করেছেন অ্যান্ডারসন। ফরাসি নিউ ওয়েভের প্রবাদপুরুষ গোঁদার বলেছিলেন, ফিল্ম ক্রিটিসিজমের সবচেয়ে সেরা উপায় হলো আরেকটা মুভি নির্মাণ করা। স্যান্ডলারকে সঙ্গে নিয়ে এই চলচ্চিত্রে যেন সেটাই করলেন তিনি। তাই একদিক থেকে একে ফিল্ম ক্রিটিসিজমও বলা চলে। পরিচালক নিজেই একে আখ্যা দিয়েছেন ‘একটি আর্ট হাউজ অ্যাডাম স্যান্ডলার ফিল্ম’ বলে।
বৈচিত্র্য আর স্টাইলের দিক থেকে তার সৃষ্ট দুনিয়াতেই পাঞ্চ-ড্রাংক লাভের অবস্থান। তবে মুভিকে যেন খুব বেশি আর্টসি বা মেকি মনে না হয়, সেদিকেও ছিল তার পূর্ণ মনোযোগ। সেই সময়ে তার নির্মিত অন্যান্য সিনেমার সাথে এর তুলনা আসা উচিৎ না। কারণ, এখানে জনরা এবং অভিপ্রায় দুটোই ভিন্ন। তথাপি, দেখতে একে অ্যান্ডারসনের সিনেমার মতোই লাগে। নতুন কিছু করতে চাওয়ার প্রতি তার যে অনুরাগ, সেটি এখানেও দৃশ্যমান। ঘন ঘন তিনি নিয়েছেন লং আনব্রোকেন শট। চাতুর্যের সাথে ব্যবহার করেছেন শব্দ। যার মাধ্যমে দর্শককে শক দেওয়ার পাশাপাশি কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রধান চরিত্রের মনের অবস্থাও প্রকাশিত হয়েছে। সিনেম্যাটোগ্রাফি আর সংগীতের জন্য তাই রবার্ট এলসউইট এবং জন ব্রায়নেরও বাহবা প্রাপ্য। অ্যান্ডারসনীয় ভাবকে আরো প্রগাঢ় করতে দেখা মিলেছে ফিলিপ সিম্যুর হফম্যান এবং লুইস গুজমানের। উপস্থিতি ছিল সাররিয়ালিস্টিক নির্যাসেরও।
অ্যাডাম স্যান্ডলারের দিক থেকে দেখতে গেলে এ কথা সত্যি যে, এখানে তিনি তার অভিনয়ের ব্যাপ্তি দেখিয়েছেন। পর্দায় উন্মোচিত করেছেন নিজের নতুন একটি দিক। কিন্তু ব্যারি চরিত্রটি আরেকটি ক্লাসিক স্যান্ডলার চরিত্র। দর্শক এমনিতে তাকে যে রূপে পর্দায় দেখে, তার চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন কিছু তিনি করেননি। রাগ, দুঃখ, হতাশা, বেপরোয়া ভাব তার অভিনীত অন্যান্য চরিত্রের মতো ব্যারিরও বৈশিষ্ট্য। এখানে অ্যান্ডারসন আনয়ন করেছেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, আর জোর দিয়েছেন উদ্ভূত পরিস্থিতির অমোঘতার উপর, যাতে উদ্ভাসিত হয়েছে অভিনেতা হিসেবে স্যান্ডলারের ট্যালেন্ট। টাইপ কাস্ট, কমেডি বক্স অফিসের কিং বলে খ্যাত ব্যক্তিটি যে নিজের ভেতর এতটা গভীরতা আর সূক্ষ্মতা ধারণ করেন, তা বোধহয় অ্যান্ডারসন ছাড়া আর কেউ ভাবতে পারেনি। চেনাজানা ফর্মুলার শৃঙ্খল ভেঙে স্যান্ডলারও অনবদ্য।
যেহেতু গল্পের মূল ফোকাস ব্যারি, সেহেতু অন্যান্য চরিত্রের স্ক্রিন টাইম কম। এই স্বল্প সময়ের মাঝেই নিজের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছেন ওয়াটসন। হফম্যানের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। সিনেমায় তার ভূমিকা এক্সটেন্ডেড ক্যামিওর চেয়ে খানিকটা বেশি। কিন্তু এটুকুতেই নিজের জাত চিনিয়েছেন তিনি। ব্যারির সাথে তার চরিত্রের যে বচসা হয়, সেই সিকোয়েন্সের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যারির সহকর্মী হিসেবে গুজমানের সাথে তার কেমিস্ট্রিও উপভোগ্য।
সবকিছু ছাপিয়ে পাঞ্চ-ড্রাংক লাভ পার্সোনালিটি টাইপ আর নিজেকে নিজে মেনে নেওয়ার গল্প। ব্যারির মানসিক অবস্থাও দেখা হয়েছে সহানুভূতির সাথে, যা তাবৎ দুনিয়ার খাপ খাওয়াতে না পারা লোকজনকে ভরসা দেয়, একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে বলে আশা জাগায়। অ্যান্ডারসনের ভক্ত হলে বা স্যান্ডলারের গতানুগতিক সিনেমা ক্লিশে লাগলে এই সিনেমাটি দেখতে পারেন।