বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সিনেমা উৎপাদনকারী রাষ্ট্র ভারত। আর ভারতের সবচেয়ে বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলিউড। প্রতি বছর বলিউডে ১ হাজারের উপরে সিনেমা মুক্তি পায়, যা হলিউডের প্রায় দ্বিগুণ। এই সিনেমাগুলোর প্রধান কারিগর হচ্ছে পরিচালকরা। বলিউডের সিনেমা সম্বন্ধে যদি আপনার ভালো জ্ঞান থেকে থাকে অথবা আপনি যদি একজন হিন্দি সিনেমাবোদ্ধা হয়ে থাকেন, তাহলে একটি বিষয় অবশ্যই আপনার চোখে পড়ার কথা। অধিকাংশ ভারতীয় পরিচালকই একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলা অনুসরণ করে তাদের সিনেমা বানান। এই নিবন্ধে গড়পড়তা বলিউড ছবি এবং বলিউডের কয়েকজন স্বনামধন্য পরিচালকের সিনেমায় ব্যবহৃত ফর্মুলা বের চেষ্টা করা হয়েছে।
যদিও বলিউড বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি, কিন্তু অন্য বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলোর চেয়ে বলিউডের ধাঁচটা একটু আলাদা। অন্য কোনো দেশের সিনেমায় এত বেশি নাচগান খুঁজে পাবেন না আপনি। কোনো দেশের সিনেমার কাহিনী এতটা প্রেমনির্ভরও নয়। বলিউডের সিনেমার ব্যাপ্তি অন্যদের চেয়ে বেশি। সিনেমার এই দিকগুলো শুনতে নেতিবাচক লাগতে পারে, কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষেরা কিন্তু এগুলোকে ইতিবাচকভাবেই নিয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এই ফর্মুলার কারণেই এই অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষ হলমুখী হয়েছে, এমনকি নিম্নবিত্তরাও। এই ফর্মুলা প্রভাব ফেলেছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সিনেমাতেও, বিশেষভাবে আমাদের দেশীয় চলচ্চিত্রে।
পরিচালকদের ফর্মূলা বের করার আগে আসুন দেখে নেই গড়পড়তা বলিউড ফিল্মের একক কিছু বৈশিষ্ট্য।
স্টার/সুপারস্টারকে ঘিরে ঘুরবে বাকি সব গ্রহ
যেসব সিনেমায় স্টার, সুপারস্টাররা রয়েছে, সেসব সিনেমার কাহিনী থেকে শুরু করে পার্শ্বনায়ক/নায়িকা সবকিছু ঠিক করা হয় স্টার, সুপারস্টারের মর্জি মোতাবেক। কেননা শুধুমাত্র ঐ স্টার/সুপারস্টারের উপস্থিতিই আপনার সিনেমাকে বক্স অফিস হিট করে তুলবে।
সুদর্শন নায়ক, রূপসী নায়িকা
যে চরিত্রই হোক না কেন, উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, মাফিয়া ডন কিংবা পুলিশ অফিসার, প্রধান চরিত্রে পরিচালকের প্রথম পছন্দ থাকে ভালো চেহারার কেউ (উল্টোটা হয় খলনায়কের ক্ষেত্রে। মাফিয়া ডন, পুলিশ অফিসার যা-ই হোক না কেন, তার চেহারা হবে খারাপ)। কারণ মানুষ সুন্দরী নায়িকা দেখতে যায়, স্মার্ট নায়ক দেখতে চায়, তারা অভিনয় পারে কিনা, তাতে কিছু আসে যায় না। এই বৈষম্যের কারণে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর মতো প্রতিভাবান অভিনেতাকে মূলধারায় আসতে অনেক সময় নিতে হয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে।
অতিরিক্ত সংগীত নির্ভর
আমাদের হয়তো দেখতে দেখতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, কিন্তু একটি গড়পড়তা বলিউড ফিল্মে যে পরিমাণ গান থাকে, আমেরিকান বা ব্রিটিশ মিউজিক্যাল ফিল্মগুলোতে এত গান থাকে না।
দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল
যেখানে একটি গড়পড়তা হলিউড ছবির ব্যাপ্তিকাল দেড় ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা, সেখানে একটি গড়পড়তা বলিউড ছবির ব্যাপ্তিকাল আড়াই ঘণ্টা থেকে তিন ঘণ্টা। বলতে গেলে প্রায় দ্বিগুণ।
আইটেম সং
‘আইটেম সং’ নামক বস্তুটিও বলিউডের নিজস্ব উদ্ভাবন। মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বানানো এই আইটেম সংয়ের উপর অনেক সময় ছবির বক্স অফিস সাফল্য নির্ভর করে।
কুম্ভীলকবৃত্তি
যদি আপনি দেখেন কোনো ছবি প্রচলিত ফর্মুলার সাথে যাচ্ছে না, সম্ভাবনা হচ্ছে এই ছবি কোনো বিদেশী সিনেমা অবলম্বনে বানানো। এদের সবগুলোই কিন্তু আবার কুম্ভীলকবৃত্তি না, অনেক পরিচালক এখন ঘোষণা দিয়েও বিদেশী ছবির রিমেক তৈরি করছে।
এবার চলুন দেখে নেয়া যাক বলিউডের এ সময়ের ৭ জন জনপ্রিয় পরিচালকের সিনেমায় ব্যবহৃত ফর্মূলা।
১) রাজকুমার হিরানী
- কোনো আগন্তুক সিস্টেমে ঢুকবে
- সিস্টেমের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে
- শেষে সিস্টেম পরিবর্তন হবে
- অনেক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাবে কাহিনী
কিছুটা ব্যতিক্রমধর্মী ও সামাজিক বার্তাবাহী সিনেমার জন্য রাজকুমার হিরানী বিখ্যাত। তার প্রতিটি সিনেমার মাধ্যমে তিনি সমাজের কোনো না কোনো স্তরের অসামঞ্জস্যতাকে তুলে ধরেছেন। হোক সেটি ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, হোক সমাজের প্রতি স্তরের দুর্নীতি কিংবা প্রচলিত ধর্মব্যবসা। ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘পিকে’ কিংবা ‘মুন্না ভাই’ সিরিজ, তার প্রতিটি ছবিতেই যেমন একটি সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়েছে, এর সাথে সেই অসঙ্গতির সমাধানও বাতলে দেয়া হয়েছে।
২) ইমতিয়াজ আলী
- সুন্দরী নায়িকার সাথে নায়কের সাক্ষাত
- ভ্রমণ
- যেকোনো একজন অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে
- দুজন সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে অথবা একজন মারা যাবে
‘জাব উই মেট’ থেকে শুরু করে ইমতিয়াজ আলীর সব সিনেমা মূলত প্রেমকাহিনী নির্ভরই। কিন্তু এই ক্ষুদ্র কাহিনীর মধ্য দিয়েই তিনি সাধারণত বড় কিছু ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। নায়ক-নায়িকার সাক্ষাতের মাধ্যমে যদিও সিনেমা শুরু হয়, কিন্তু কাহিনীর বিস্তৃতি যেভাবে সময়কে প্রদক্ষিণ করে, তা দর্শককে প্রতিটি চরিত্রের গভীরে নিয়ে যায়, আর প্রতিটি চরিত্রের গভীরেই রয়েছে তার জীবন দর্শন।
৩) আশুতোষ গোয়ারিকার
- ঐতিহাসিক পটভূমি
- বিস্তর কাহিনী
- সিনেমার ব্যাপ্তি অন্ততপক্ষে ৩ ঘণ্টা
লাগান-খ্যাত পরিচালক আশুতোষ গোয়ারিকারের সিনেমা সাধারণত অন্য যেকোনো সিনেমার চেয়ে বেশি দৈর্ঘ্যের হয়। উদাহরণস্বরূপ আপনি তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘লাগান’কেই নিতে পারেন, যার ব্যাপ্তি ৩ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট। আশুতোষ গোয়ারিকারের ক্যামেরায় উঠে এসেছে ‘লাগান’, ‘যোধা আকবর’, ‘মহেঞ্জো দারো’-র মতো সব ঐতিহাসিক সাগা।
৪) রোহিত শেঠি
- গাড়ি ভাঙছে, উড়ছে
- মার মার কাট কাট অ্যাকশন সিকুয়েন্স
- হিউমার > কাহিনী
- রোমান্স, হিউমার, অ্যাকশন মিলিয়ে বানানো ফর্মুলা
- সিক্যুয়াল
বর্তমান বলিউডের কমার্শিয়াল ছবির একজন কর্তাব্যক্তি রোহিত শেঠি। তার পরিচালিত যেকোনো সিনেমার মধ্যে আপনি প্রেমকাহিনী পাবেন, হাস্যরস পাবেন, অ্যাকশন সিকুয়েন্স পাবেন (অ্যাকশন সিকুয়েন্সের মধ্যে অধিকাংশই আবার লজিকবিহীন)। আর হাল ফ্যাশনের আইটেম সং তো আছেই। যদি সিনেমা বক্স অফিস সাফল্য পায়, তাহলে তার সিক্যুয়াল আসছে ধরে নিতে পারেন। এক গোলমালেরই তিন তিনটি সিক্যুয়াল বের হয়েছে।
মূলকথা দর্শককে হলমুখী করতে সিনেমায় যে উপাদান ঢালা প্রয়োজন, তা-ই ঢালছেন তিনি। কেউ তার সিনেমাকে বলে ‘বিনোদনধর্মী’, কেউ বা ‘সস্তা’।
৫) করন জোহর
- চিত্তাকর্ষক সংগীত
- বিদেশী লোকেশন
- সমাজের উঁচু শ্রেণী কেন্দ্রিক কাহিনী
- ড্রামাটিক ক্লাইম্যাক্স
বিত্তবান নায়ক-নায়িকারা একে অপরের প্রেমে পড়বে, তাদের এই প্রেমের চিত্র ধারণ হবে চিত্তাকর্ষক কোনো বৈদেশিক লোকেশনে। এর সাথে সিনেমা জুড়ে থাকবে শ্রুতিমধুর রোমান্টিক গান। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের প্রতি নজর না দিয়ে এই ফর্মুলা অনুসরণ করে শুধু সমাজের উচ্চবিত্তদের জীবনযাপন নিয়ে সিনেমা তৈরির জন্য প্রায় সময়ই সমালোচনার শিকার হয়ে আসছেন পরিচালক করন জোহর। কেননা ভারতীয় সিনেমার মূল দর্শক নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপর তার উচ্চবিত্ত কেন্দ্রিক ছবি ন্যূনতম প্রভাব ফেলতেও ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু করন জোহরের নিবেদিত ভক্তকূল রয়েছে, যারা শুরু থেকেই তাকে এবং তার ছবিকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করে আসছে।
৬) সঞ্জয় লীলা বানসালী
- এক সেটের মধ্যেই সিনেমার সিংহভাগ চিত্রায়িত
- চিত্তাকর্ষক পরিচ্ছদ
- মহাকাব্যিক মাত্রার কোনো প্রেম উপাখ্যান
সঞ্জয় লীলা বানসালীর ছবি বেশি পরিচিত অতিরঞ্জিত সেট এবং আকর্ষণীয় কস্টিউমের জন্য। ‘দেবদাস’, ‘গুজারিশ’, ‘গোলিও কি রাসলীলা রাম-লীলা’, ‘বাজিরাও মাস্তানি’-র মতো তার অধিকাংশ ছবির শুটিং হয়েছে একটি বৃহৎ সেটের মধ্যেই। আর প্রতিটি সিনেমার কেন্দ্রে রয়েছে একেকটি অসম প্রেম কাহিনী।
৭) আনুরাগ কশ্যপ
- অভিনয় পারে এরকম অভিনেতা
- স্বল্প বাজেট
- কাহিনী ও অভিনয় নির্ভর চলচ্চিত্র
সাম্প্রতিককালে যে ক’জন ভারতীয় পরিচালক মুক্তধারার চলচ্চিত্রকে প্রয়োজনীয় স্বকীয়তা দান করেছেন, তাদের মধ্যে আনুরাগ কশ্যপ অন্যতম। তার ছবি কাহিনী নির্ভর, প্রথাগত বলিউড সিনেমার মতো ‘কে অভিনয় করছে’ সেটা নির্ভর না। তার সিনেমায় ‘সুপারস্টার’ নয়, শুধুমাত্র প্রকৃত অভিনেতারাই স্থান পায়। আনুরাগ কাশ্যপ তার প্রায় সব ছবিই বানিয়েছেন বক্স অফিসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। যার ফলে তার ছবি এতটা দর্শকনন্দিত না হলেও, সমালোচক মহলে ভালোই সমাদৃত।
সাম্প্রতিককালে অনেক পরিচালকই বলিউডের প্রচলিত ফর্মুলা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অনেক পরিচালকই বক্স অফিসের চিন্তা বাদ দিয়ে সিনেমার মানের উপর জোর দিচ্ছেন। আনুরাগ কশ্যপ, বিশাল ভরদ্বাজ, হানসাল মেহতা, নুরাগ বসু, দিবাকর ব্যানার্জীর মতো পরিচালকরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন এই মুক্তধারার চলচ্চিত্র মঞ্চায়নে। এদের হাত ধরেই তাই উঠে এসেছে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, কাঙ্গানা রানৌত, মনোজ বাজপেয়ির মতো তুখোড় অভিনেতারা, যারা চেহারা বা স্টারডমের ধার না ধেরে অভিনয় দিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন বি টাউনে। আর ফর্মুলার মধ্য দিয়ে গেলেও রাজকুমার হিরানি, ইমতিয়াজ আলি, নীরাজ পান্ডের মতো পরিচালকেরা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন কালজয়ী কিছু চলচ্চিত্র।
ফিচার ইমেজ: Time Out; edited by the writer.