“আমি বাস্তবতা চাই না, আমি জাদু চাই। জাদু।”
সিনেমার শেষভাগে কেন্দ্রীয় চরিত্র ব্লাঞ্চের বলা এই সংলাপটিই হয়ে দাঁড়ায় সিনেমার প্রধান বিষয়। আর সেই দৃশ্যটি? সন্দেহাতীতভাবেই আমেরিকান সিনেমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটকীয় বা ড্রামাটিক দৃশ্য সেটি। আর কেনইবা এলিয়া কাজানকে হলিউডের শ্রেষ্ঠ ‘ড্রামাটিক পরিচালক’ বিশেষণে আখ্যায়িত করা হয়, তা বেশ ভালো করে বুঝতে পারা যায় এই একটি দৃশ্য দেখেই। তবে সেই বিশেষণের ব্যাখ্যায় ভেড়ার আগে প্রস্তাবনাটা জরুরি। বলা যাক, প্রারম্ভিক দু-চার কথা।
গগনবিদারী হুংকার ছেড়ে ট্রেন তখন ইস্টিশনে থেমেছে। বিদীর্ণ, মলিন মুখে খানিকটা উদভ্রান্তের ভঙ্গীতে নারীটি কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছে। অচেনা শহর, অচেনা রোডঘাট, অচেনা মানুষের ভিড়ে বেশ কুঁকড়ে গেছে মনে হলো। ভালোমানুষি দেখিয়ে পাশের একজন নারীর হাতে ধরে রাখা ঠিকানাটা বাতলে দিল। ‘ডিজায়ার’ নামক একটা বাসে; ওটাই স্ট্রিটকার, এতে চড়তে হবে সেই ঠিকানায় পৌঁছুতে হলে। চিঠিতে স্পষ্ট করে উল্লেখ ছিল, ডিজায়ার নামক এই স্ট্রিটকারের। সিনেমার নামটা এখানে আক্ষরিকভাবেই উঠে আসে, তবে নামটার মর্মার্থ আরো গভীরে।
ঠিকানা ধরে ব্লাঞ্চ পৌঁছালো স্যাঁতস্যাঁতে, জীর্ণ গোছের এক বাড়ির রোয়াকে। তার বোনের বাড়ি। বোন স্টেলাকে বাড়িতে নয়, পাওয়া গেল পাশের এক ক্লাবে। বোনজামাই স্ট্যানলি তখন আরেকজনের সাথে পুলবোর্ডের উপর হাতাহাতিতে ব্যস্ত। রগচটা স্বভাব তার। স্টেলা চাইল, তখনই তার স্বামীর সাথে বড়বোনের পরিচয় করিয়ে দিতে। কিন্তু ব্লাঞ্চ জোর আপত্তি করলো। সফরশেষে শারীরিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ার অজুহাতে তখন আর মুখোমুখিটা হলো না। তবে হলো যখনই, সেটা বেশ অস্বস্তিদায়ক হলো দর্শকের পক্ষে। ব্লাঞ্চ এমনভাবে তাকাল স্ট্যানলির দিকে, যে খোদ দর্শকই অস্বস্তি বোধ করবে। একটা যৌন উত্তেজনা প্রভাব বিস্তার করছিল গোটা দৃশ্যটায়। তবে পরিবেশটা হালকা করতে পর্দায় তখন নিঃশ্বাস নেওয়ার উপায়রূপে আসলো স্টেলা।
ব্লাঞ্চ মিসিসিপির একজন স্কুলশিক্ষিকা। একটা গোপন ঘটনার জের ধরে চাকরিটা হারায় সে। জায়গাজমিও হারায় আদালতে মামলা হেরে। স্বামীও মারা গেছে। বলতে গেলে, শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর মতো তার কোনো খুঁটিই আর নেই; তাই শেষ আশ্রয় হিসেবে এসেছে বোনের কাছে। মামলা-মোকদ্দমায় জায়গাটা হারিয়েছে জেনেই নাখোশ হয়ে পড়ে বোনজামাই স্ট্যানলি। সে ওমন একজন মানুষ, যে টানেলের শেষদিকে আলো নয় বরং একটা উদ্দেশ্য দেখতে চায়। শ্যালিকার আগমনে খুশি নয় সে মোটেও।
তার বর্বর প্রকৃতিটাকে ভয় পায় ব্লাঞ্চ, ওদিকে সে নিজেও খুব ভঙ্গুর প্রকৃতির। আর সেটাকেই সন্দেহের চোখে দেখে স্ট্যানলি। ব্লাঞ্চের উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার বুঝতে চায় সে, তার অতি সতর্কতা, অতি নাজুকতাকে নিজের কাঁটার মতো বিঁধতে পারা কথা দিয়ে কথা দিয়ে সর্বক্ষণ প্রতিহত করার চেষ্টা চালায় স্ট্যানলি। সে সত্যটা সামনে আনতে চায়। তাছাড়া একটা যৌন উদ্দীপনা তো তাদের মাঝে কাজ করছেই। দু’জনের মধ্যকার এই দ্বন্দ্ব জটিল মোড় নেয়, যখন স্ট্যানলির বন্ধু মিচ ব্লাঞ্চের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে।
টেনিসি উইলিয়ামসের একই নামের মঞ্চনাটকের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়েছে সিনেমার চিত্রনাট্য। অ্যা স্ট্রিটকার নেইমড ডিজায়ার, উইলিয়ামসের সবচেয়ে আলোচিত এবং জনপ্রিয় মঞ্চনাটক। ৫০ দশকে গোটা আমেরিকান সমাজ এবং সংস্কৃতি একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। শিল্পমাধ্যমেও ঘটেনি তার ব্যত্যয়। চলচ্চিত্র, সাহিত্য, সঙ্গীত সর্বক্ষেত্রেই একটা ভিত্তিগত পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সূত্র ধরে। আর সে পরিবর্তনের একটা সূক্ষ্ম পূর্বাভাস লক্ষ করা যায়, এই মঞ্চনাটকের বিষয়াদিতে।
ধর্ষণ, সমকামিতার মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলো অবশ্য সিনেমার চিত্রনাট্যে প্রচ্ছন্ন আকারে অবস্থান করে। তখনকার হলিউড যে ‘হেইস কোড’ দ্বারা পরিচালিত হতো, সে কোড রক্ষা করতেই এই বিষয়গুলো প্রকট হয়ে উঠতে পারেনি সিনেমায়। তবে যৌন উত্তেজনাটা বরাবরই ছিল। কামনা আর আকাঙ্ক্ষা দ্বারাই সেটাকে স্পষ্ট করে তোলা হয়েছে। এই দুটো (কামনা এবং আকাঙ্ক্ষা) দ্বারাই চালিত হয়েছে সিনেমার কেন্দ্রীয় দুই চরিত্র।
স্ট্যানলি চরিত্রটি একইসাথে বর্বর এবং সৎ। তার মেজাজ রুক্ষ, কথাগুলো ছুরির তীক্ষ্ণ ফলার মতো। সে যা চায়, সে ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চিত। উগ্র স্বভাব তার। তার যেকোনো পদক্ষেপের পেছনেই কাজ করে গভীর আসক্তি। এবং সেটিকে স্ট্যানলি লুকাতে চায় না। তাইতো ব্লাঞ্চের মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিজনক কথাগুলোকে, নিজের কথা দিয়ে ফালা ফালা করে কাটতে দ্বিধান্বিত হয় না সে। স্ট্যানলির এই নগ্ন আসক্তিই চরিত্রটাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। স্টেলা শতকিছুর পরেও যেমন তাকে পরিত্যাগ করতে পারে না, তেমনি দর্শকও তাকে নাকচ করে দিতে পারে না। তাইতো বর্বর আচরণের পর যখন সে ‘স্টে……লা…’ বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে, তখন তার প্রতি ঘৃণা জাগানো দায়।
স্ট্যানলি চরিত্রটি আমেরিকান সিনেমায় কেন্দ্রীয় পুরুষ চরিত্রে একটা নতুন রূপরেখার প্রণয়ন করেছিল সে সময়। এবং সে রূপরেখা ধরে আজো অনেক চরিত্র লেখা হচ্ছে। চরিত্রটি অবিস্মরণীয় হয়ে ওঠার পেছনে মার্লন ব্র্যান্ডোর অসামান্য অভিনয়ের ভূমিকাও বিশাল। একজন কিংবদন্তী অভিনেতা হয়ে ওঠার পেছনে এ চরিত্রের অবদান কম নয়। পূর্ণ সততার সাথেই চরিত্রটি পর্দায় রূপায়ন করেন ব্র্যান্ডো। তাতে যেন এক ফোঁটা অভিনয় নেই, পুরোটাই মনেহয় বাস্তব। তার অনুনাসিক স্বর, অনুসন্ধিৎসু চোখের ভাষায় যতক্ষণ পর্দায় ছিলেন, ততক্ষণই প্রভাব বিস্তার করে গেছেন।
পরিচালক এলিয়া কাজানকে ‘অ্যাক্টর’স ডিরেক্টর’ বলে অভিহিত করা হয়। অভিনয়শিল্পীদের কাছ থেকে অভিনব উপায়ে অভিনয় বের করে আনার জন্য সুখ্যাতি ছিল তার। অভিনয়শিল্পীদের ইম্প্রোভাইজ করার সুযোগ দিতেন তিনি। তাতেই একদম ন্যাচারাল অভিনয় বের হয়ে আসতো। এ সিনেমাতেও তেমনটাই হয়েছে। শ্রেষ্ঠ অভিনয়শৈলীর অন্যতম বড় উদাহরণ, অ্যা স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার। ব্র্যান্ডো তো আছেনই, ব্লাঞ্চ চরিত্রে ভিভিয়েন লেই’র চমকপ্রদ অভিনয় অন্য মাত্রা যোগ করেছে। বাস্তবিক অভিনয়ের সাথে মঞ্চের অভিনয়ের ধারাটা যোগ করে স্মরণীয় একটি পারফর্ম্যান্স উপহার দিয়েছেন তিনি। ব্লাঞ্চ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা একটা চরিত্র। নিরাপদ থাকতে নিজের মতো করে ঘটনাগুলোকে সাজিয়ে নেয়। কাল্পনিক হলেও, তার কাছে ওটাই বাস্তব। তার নামটাই তার চারিত্রিক দ্বৈততা প্রকাশ করে। ব্লাঞ্চ (ব্লশ), এই ফরাসি নামের অর্থ সাদা। তা এই সাদা রং পবিত্রতার প্রতীক যেমন বহন করে, তেমনিই খুব সহজে দাগাঙ্কিত হওয়ার ঝুঁকি বহন করে। আর সরলতা থেকে দাগাঙ্কিত হওয়ার গোটা গ্যামাটটা ধরেই চলে এই চরিত্রটি।
নারী যৌনতার বিষয়টি সিনেমায় উপস্থাপন করা সেই সময়ে বিশাল সাহসের কাজ ছিল। আর সাহসটা দেখিয়েছেন এলিয়া কাজান। মঞ্চনাটকের মতো প্রকট না হলেও বেশ সূক্ষ্মভাবে বিষয়টি চিত্রায়িত করেছেন তিনি।
পরিচালক এলিয়া কাজান একজন বহিরাগত হওয়ায়, বহিরাগতদের সংগ্রামটা তার জানা ছিলই। তাইতো নিজের সিনেমাগুলোয় সাবলীলভাবে সমাজবাস্তবতা উপস্থাপন করতেন তিনি। সমাজবাস্তবতা আর মানবিকতা মিশিয়ে গল্পের বয়ান করতেন তিনি। স্টেলার জীর্ণশীর্ণ বাড়ি, স্ট্যানলির সেই ছেঁড়া টি-শার্ট, ব্লাঞ্চের মলিন জামাকাপড়ে সেই বাস্তবতা পুরোদমে আঁচ করা যায় এবং দর্শকের হাঁসফাঁসটাও তখন বাড়ে। গল্পবয়ানে আবেগটাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন তিনি। এবং সেটা সৎ আকারেই পর্দায় তুলে আনতেন। স্টোরিটেলিং বা গল্পবয়ানের শৈলীর ক্ষেত্রে তিনি বলতেন,
“গল্পের আবেগটা পর্দায় যথাযথ চিত্রায়নে যা যা করা দরকার, তা তা সেভাবে করাই শৈলী।”
সিনেমাটিতে নাটকীয়তা তৈরি করতে পুরোপুরি আবহে জোর দিয়েছেন কাজান। প্রোডাকশন ডিজাইনে মঞ্চের ভাবটা রেখেছেন, যেহেতু মঞ্চনাটক অবলম্বনেই এটি। সেইসাথে, মাঝেমাঝে গীতিময় ভাব জাগানো সংলাপেও মঞ্চের ভাবটা লেগে ছিল। কাজান সাধারণত নাটকীয়তা তৈরিতে সংলাপকে ছাপিয়ে কুশীলবদের অভিনয়কে গুরুত্ব দিতেন। তিনি চাইতেন, শুধু সংলাপ উগড়ে নয়, বরং শিল্পীদের শরীরী ভাষায় গল্পের আবেগটা উঠে আসুক, নাটকীয়তা তৈরি হোক। সে অনুপাতেই আলোছায়ার ব্যবহারও করা হতো। ড্রামাটিক ক্লোজ-আপ শটের ব্যবহার করতেন তিনি। ওই ভিজ্যুয়াল ভাষাটাই তো তখন দর্শকের মাঝে আবেগের সঞ্চার ঘটাবে। এ সিনেমার শ্রেষ্ঠ নাটকীয় দৃশ্য, তৃতীয় অংকে মিচ যখন ব্লাঞ্চের কাছে সত্য জানতে চায়, আলোতে দেখতে চায়।
সিনেমার শুরু থেকেই কাজান যেভাবে এই চরিত্রটিকে যেভাবে তৈরি করে আসছিলেন, তার অন্তর্দ্বন্দ্ব; সংবেদনশীলতাকে যেভাবে দর্শকের ধারণায় গেঁথে দিয়েছেন এবং গল্পের আবেগটাকে যেভাবে পরিচালনা করে এসেছেন, তাতে এই দৃশ্য ব্লাঞ্চ চরিত্রটির জন্য অনেকটা অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে যাওয়ার মতো। ব্লাঞ্চের এতক্ষণ ধরে ভেতরে ছটফট করতে থাকা আবেগটা যেন আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভার মতো বিস্ফোরিত হয় এই দৃশ্যে এসে। সিনেম্যাটিক এক্সপ্রেশনিজম ব্যবহার করে নাটকীয়তাকে এই দৃশ্যে আরো এক ধাপ চড়িয়ে দিয়েছেন কাজান। শেষ অব্দি, ব্লাঞ্চের বাতুলতা গড়ায় মনোব্যাধিতে।
সত্যটাকে নিজের মতো করে পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করে সবসময় বাস্তবতা থেকে যেভাবে পালাতে চাইত ব্লাঞ্চ, ব্রেকডাউনের সেই দৃশ্যে ঠিক একইভাবে পালাতে চায় দর্শক। ব্লাঞ্চের সেই- ‘বাস্তবতা নয়, জাদু চাওয়া’টাই তখন একমাত্র সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদগ্ধ বাস্তবতায় এককাঠি জাদু চাওয়ার করুণ আকুতিকে হৃদয়ে নিয়েই পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে যায় এই ‘গ্রেট সিনেমা’টি।