কেমন হয়েছে ন্যাটালি পোর্টম্যানের ‘অ্যানাইহিলেশন’?

Ex Machina, ২০১৪ সালে অবমুক্ত হওয়া অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র। খুব চমৎকার একটি প্লটে দাঁড়ানো ছিল সিনেমার গল্প। পাশাপাশি অভিনয়, সংলাপ, উপস্থাপনা, সমাপ্তি ইত্যাদি অনেক কিছু মিলিয়ে মোটামুটি সব দিক থেকেই অসাধারণ ছিল এই সিনেমাটি। এর পরিচালক ছিলেন অ্যালেক্স গারল্যান্ড। এবার ২০১৮ সালে তিনিই নির্মাণ করেছেন ‘অ্যানাইহিলেশন’। আগের সিনেমাটি খুব চমৎকার হয়েছিল। তাই অনেকেই আশা করেছিলেন এটিও খুব চমৎকার হবে। কিন্তু আশা কিছু দিক থেকে পূরণ হলেও সব দিক থেকে হয়নি।

অভিনয়ের জন্য যাদের রাখা হয়েছে তারা সকলেই চমৎকার অভিনয় করেন। চমৎকারের মাঝে আরো চমৎকার হলো অভিনেত্রী ন্যাটালি পোর্টম্যান। তিনি সিনেমার প্রধান চরিত্র। অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রীর অভিনয়ই এই সিনেমার সবচেয়ে ভালো দিক। শুধুমাত্র তার অভিনয়ের জন্য হলেও পুরোটা সিনেমা দেখে ফেলা যায়। অন্যান্যদের অভিনয়ও বেশ ভালো হয়েছে। গল্পের প্লটও উন্নত। কিন্তু পাশাপাশি অনেকগুলো দিক থেকে এর মাঝে ত্রুটি রয়ে গেছে

চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে প্রাণীর নমুনা কোষ সংগ্রহ করছেন লিনা (ন্যাটালি পোর্টম্যান); © Paramount Pictures

প্রথমত, গল্পের ফাঁকে ফাঁকে এমন কিছু বিষয় আনা হয়েছে যেগুলো যৌক্তিকভাবে সম্ভব নয়। সায়েন্স ফিকশনের কৌশল ব্যবহার করে অনেক অসম্ভব বিষয়ই সম্ভব করে দেখানো যায়। কিন্তু সবকিছু নয়। এখানে এই ত্রুটি রয়ে গিয়েছে।

মূল গল্প বাদে সিনেমার ভেতরে অনেকগুলো উপ-গল্প থাকে। উপ-গল্পগুলো একত্রে মিলে মূল গল্পের ভিত্তি দাঁড় করায়। উপ-গল্পগুলোর একটির সাথে আরেকটির সামঞ্জস্যতা যত বেশি হবে মূল গল্প তত চমৎকার হবে তত বাস্তবসম্মত হবে। এখানে মূল প্লট চমৎকার হলেও উপ-গল্পগুলোর মাঝে সামঞ্জস্যতার অভাব আছে।

গল্পের সমাপ্তি সিনেমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এখানের সমাপ্তি কিছুটা কিছুটা প্রশ্নবোধক এবং কিছুটা সামঞ্জস্যহীন। তার উপর সিনেমার গল্পে দর্শকদের জন্য কিছু বার্তা থাকে। এটি থাকা বাধ্যতামূলক নয়, তবে থাকলে সিনেমার মান অনেক বেড়ে যায়। এক্স মেশিনার কথাই বলা যাক। এর যে গল্প এবং যেভাবে এর সমাপ্তি হয়েছে তা সামগ্রিক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে প্রশ্ন রেখেছে মানুষের কাছে। আসলেই কি যন্ত্র কখনো এমন হবে যা মানুষকেও ফাঁকি দেবে, মানুষকেও ধোঁকা দেবে, মানুষকেও ছড়িয়ে যাবে?

অ্যানাইহিলেশনে এমন বিশেষ কোনো বার্তা নেই। ভালো এবং চমৎকার একটি বার্তা হতে পারতো, কিন্তু হয় হয় করেও হয়নি। পুরো সিনেমাটাই সব দিক থেকে অনন্য হতে পারতো, কিন্তু হয় হয় করেও হয়নি।

অ্যানাইহিলেশন চলচ্চিত্রের পোস্টার; © Paramount Pictures

তবে তারপরেও গড়পড়তা সিনেমার চেয়ে ভালো। সামান্য কিছু ত্রুটি মেনে নিয়ে সিনেমা দেখা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ন্যাটালির অভিনয় যাদের কাছে ভালো লাগে তাদের কাছে সিনেমা খারাপ লাগবে না নিশ্চিত। মূলত তৃপ্ত হবার জন্য এখানে ন্যাটালির অভিনয়ই যথেষ্ট। আলাদা আর কোনোকিছুর দরকার নেই। তারপরও যদি থাকে তাহলে সেগুলো হবে বাড়তি পাওয়া।

সিনেমার পটভূমি

সিনেমার প্রসঙ্গের বাইরে যেতে হবে। নিজেদের দিয়ে একটি ব্যাপার ভাবুন। হঠাৎ করেই অজানা এবং অনিশ্চিত এক বিষয় এসে হাজির হলো সামনে। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ কখনোই হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে না। না বুঝে বেফাঁস কোনো কাজ করে বসবে না। এটা মানুষের স্বভাবজাত পদ্ধতি। বেঁচে থাকার জন্য এটা দরকারি। কাজে-কর্মে বেশি পরিমাণ সুবিধা পাবার জন্যও এটা দরকারি। শুধু মানুষই নয়, অন্য যেকোনো প্রাণীই অজানা ও অনিশ্চিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সতর্ক থাকে।

সায়েন্স ফিকশন লেখকরা পৃথিবীর প্রাণীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দিয়েই ভিনগ্রহের প্রাণীদের কল্পনা করে। সিনেমায় গল্পে সেসব প্রাণীদের দেখতে খুব উদ্ভট ও ব্যতিক্রমী দেখালেও আদতে তারা ঘুরেফিরে পৃথিবীর প্রাণীদেরই বৈশিষ্ট্য বহন করে।

সে হিসেবে সায়েন্স ফিকশনগুলোতে ভিন গ্রহের প্রাণীদের মধ্যেও মানুষ ও পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর মতো বৈশিষ্ট্য থাকে। এরকমই এক ভিনগ্রহী সত্ত্বার অস্তিত্ব আছে Annihilation (2018)-এ। এই সত্ত্বার কাছে অজানা এক ক্ষেত্র হিসেবে দেখা দেয় পৃথিবী নিজে। পৃথিবীর প্রাণী ও পরিবেশ নিয়ে জানার আছে অনেক কিছু। তাদের নাড়ি নক্ষত্র ভালোভাবে জানলেই না তবে এই গ্রহ সম্বন্ধে ভালোভাবে জানা যাবে। ভালো করে জানা গেলে দখলে নেয়া যাবে এবং শাসন করা যাবে এই গ্রহটিকে। তাই তারা পৃথিবীতে এমন একটি জিনিস পাঠাল যেটি নিজে নিজে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বেড়াবে।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশের এক উপকূল অঞ্চল। সেখানে একটি বাতিঘর আছে। ঠিক বাতিঘরটিতে এসে আছড়ে পড়লো পৃথিবীর বাইরের এক বস্তু। সেখান থেকে বিশেষ এক বিকিরণ ছড়াতে শুরু করল। সেখানে কোনো নেটওয়ার্ক কাজ করে না, কোনো চুম্বক কাজ করে না। সমগ্র পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে গেল এই অঞ্চল। এর ভেতরে যা যা আছে সবকিছু পড়লো বিরাট এক জেলখানার ভেতর। তাদেরকে নিয়ে চলবে এক্সপেরিমেন্ট।

আলাদা হয়ে গেছে একটি অঞ্চল; © Paramount Pictures

একেকটি প্রাণীকে ধরে বশ করছে আর তাকে নিয়ে উদ্ভট সব কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। কোনো হাত নেই, কোনো জোর নেই, জোর করার কেউ নেই। তাদের তৈরি করা অজানা এক পদ্ধতিতে তারা এই এই কাজগুলো সম্পন্ন হয়। ব্যাপারগুলো কেমন অদ্ভুত তার একটা নমুনা দেখাই।

অনেকেই জানেন, ক্ষুদ্র একটি কোষ থেকে মানুষের বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। শুধু মানুষই নয়। যেকোনো প্রাণই ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে বড় হয়। কোষগুলোর কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো আকার থাকে না। কিন্তু দেখুন, সেসব কোষ থেকে সবগুলো মানুষ মানুষের আকৃতিতেই বেড়ে উঠে একসময়। মানুষের কোষ থেকে কখনোই মাছের আকৃতির সন্তান জন্মায় না। একই কথা মাছের বেলাতেও। মাছের কোষ থেকে কখনোই মুরগির আকৃতির পোনা বের হয় না।

প্রাণীদের আকার আকৃতি কেমন হবে তা নিয়ন্ত্রণ করে একটি জিন। এর নাম হক্স জিন (Hox Gene)। এর মধ্যে রাসায়নিক যৌগের আকারে কিছু কোড বা নীতিমালা থাকে। এসব নীতিমালার প্রভাবে প্রাণী বা উদ্ভিদের দেহের আকার নিয়ন্ত্রিত হয়। এখন কোনোভাবে যদি এই নিতিমালাতে পরিবর্তন আনা যায় তাহলে প্রাণীর আকার ভিন্নরকম হবে। পৃথিবীতে আসা অনাহুত ভিনগ্রহী সত্ত্বাও এই কাজগুলো করেছে। গাছের মধ্যে হক্স জিন ঢুকিয়ে দিয়েছে। ফলে গাছের আকৃতি হয়ে যাচ্ছে মানুষের মতো। আবার মানুষের মাঝেও দেখা গিয়েছে গাছের পাতা জন্মাচ্ছে। বড় অদ্ভুত সব কর্মকাণ্ড।

মানুষের আকৃতিতে নিয়ে বেড়ে উঠছে গাছ; © Paramount Pictures

এটি শুধু একটি উদাহরণ। তাদের দখলকৃত অঞ্চলে আরো অনেক এক্সপেরিমেন্ট চলছে। কোনো কোনোটি দেখতে ভালো। কোনো কোনোটি দেখতে জঘন্য। চিকচিক করা কাচের মতো সুন্দর মাছ, ফুলের মতো সুন্দর হরিণের শিং, হাঙ্গরের দাঁত লাগানো ভয়ানক কুমির, বাঘের হিংস্রতায় পূর্ণ ভালুক ইত্যাদি অনেক কিছু।

ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে তাদের দখলকৃত অঞ্চল। এভাবে চলতে থাকলে পুরো পৃথিবীই হয়ে যাবে তাদের পরীক্ষার গিনিপিগ। সেজন্য তাদেরকে দমাতে হবে। আর দমাতে হলে জানতে হবে তাদের সম্পর্কে। তাই পরিকল্পনা করে এর ভেতরে পাঠাতে হবে মানুষ। তাদের দেয়া রিপোর্ট অনুসারে নিতে হবে ব্যবস্থা।

এই টিমে যায় মূল চরিত্র লিনার স্বামী। পরে লিনা নিজেও যায়। এরপর থেকেই শুরু হয় মূল গল্প। আর ঐ যে অজানা জিনিসে থাকে ভয় ও অনিশ্চয়তা। কী হবে তারপর?

পৃথিবীর বাইরের কোনোকিছু এসে পৃথিবীতে এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে- এটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? মানুষের নিজেদের কথাই বিবেচনা করুন। মঙ্গল গ্রহ নিয়ে কত বছর ধরে মানুষ গবেষণা করে যাচ্ছে। কতসব ব্যয়বহুল যান পাঠাচ্ছে সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে জানার জন্য। সেসব যান মঙ্গলের বুকে গিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট চালায়। এখন পর্যন্ত সেসব এক্সপেরিমেন্ট সাধারণ পর্যায়ে আছে। ধীরে ধীরে যে সেগুলো আরো বড় পরিসরে হবে এবং আরো বৈচিত্র্যময় গবেষণা চালাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব এক্সপেরিমেন্টে ইতিবাচক ফলাফল পেলে মানুষ গিয়ে স্থাপন করবে বসতি। আস্ত একটি গ্রহ হয়ে যাবে মানুষের।

অ্যানাইহিলেশন সিনেমার গল্পের মতো মানুষ নিজেও এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে অন্য গ্রহে; © NASA

এখন ভাবুন, মঙ্গলে যদি মানুষের মতোই অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব থাকতো? মানুষের এক্সপেরিমেন্টগুলোকে কেমন শোনাতো? পৃথিবীর ক্ষেত্রেও একইরকম পরিস্থিতি ঘটেছে অ্যানাইহিলেশন চলচ্চিত্রে।

ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে উপভোগ করতে খারাপ হবে না এই সিনেমা।

Related Articles

Exit mobile version