মধ্যবয়স্কা অনুতাপের সুরে কনফেস করতে শুরু করলেন গীর্জার নব্য এই যাজকের কাছে। ভদ্রমহিলার ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকার অভ্যাস গড়েছে। তার শত বারণসত্ত্বেও ছেলে সিগারেট ছাড়েনি। জেদের বশে তাই সেদিন ছেলেকে বেদম মারলেন তিনি। মা হিসেবে সন্তানকে শাসন তিনি করতেই পারেন। কিন্তু সন্তানকে পেটানোর পর নিজের ভেতর নিজে খুবই অনুতপ্ত বোধ করেছেন। পাপবোধ জেগেছে তার মনে।
এত দূর বলে, তিনি যাজককে জিজ্ঞেস করলেন, প্রায়শ্চিত্ত করতে এখন তার কী করা উচিত? ক্ষণিক নীরব থেকে যাজক বললেন, “ছেলেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে দিয়ে তোমার সামনেই খেতে বলো”। ভদ্রমহিলা যারপরনাই অবাক হলেন। সেটুকু বুঝতে পেরে যাজক ফের বললেন, “ছেলেকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে ঘুরে আসো। এটাই তোমার প্রায়শ্চিত্ত।” যাজককে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠে গেলেও, মহিলার অবাক হওয়ার পরিমাণ কিছু কমেনি বৈ বেড়েছে।
যাজক বলছেন এসব কথা! বিশ্বাস করতে বেগ পেতে তো হবেই। ‘যাজক’ অবস্থানে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিটির কাছ থেকে এমন কিছু তো তিনি আশা করেননি। খুব কঠিন করে ধর্মের ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হবে তার এই কর্মের ফলস্বরূপ, নৈতিকতাবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে, এমন কিছু ভেবেই এসেছিলেন। কারণ, এমনটাই তো হয়ে আসছিল বা আসছে। অথচ কত সরলভাবেই নতুন এই যাজক একটি অর্থপূর্ণ আদেশ দিয়ে মা-ছেলের বন্ধনটা শক্ত হওয়ার উপায় দেখিয়ে দিলেন।
একদম যুবক বয়সের এই ব্যক্তি সাধারণ কোনো যাজক নয়। আরে, এ তো যাজকই নয়। বন্দীদশা হতে ছাড়াই পেল এইতো সেদিন। ‘সেকেন্ড ডিগ্রী মার্ডার’-এর আরোপ ছিল তার ওপর। তরুণ অপরাধীদের বন্দীশালায় নৃশংস অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। টগবগ করতে থাকা উষ্ণ রক্তের এই তরুণেরা মতের অমিল কিংবা একটুখানি সুযোগ পেলেই এদিক-ওদিক চেয়ে বেমক্কা ঘুষি মেরে দেয় সামনের জনকে লক্ষ্য করে। কেন্দ্রীয় চরিত্র ড্যানিয়েলও একই অপরাধ করে এখানে এসেছে। তবে স্বভাবে সে ভিন্ন। অহেতুক মারামারিতে সে জড়ায় না। সুযোগ পেলেই নিজের কক্ষে বসে প্রার্থনা করে, কারাগারের ধর্মযাজককে নানান কিছুতে সাহায্য করে। তা করতে করতেই ড্যানিয়েলের মাঝে ইচ্ছা জাগে, ধর্মযাজক হওয়ার। এখান থেকে বেরুলে জীবনটাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর স্বপ্ন দেখে ড্যানিয়েল।
কারাগারের ধর্মযাজকের সহায়তায় তার মুক্তি পাওয়ার লগ্নও এসেছে অনেক তাড়াতাড়ি। এদিকে তার মুক্তির দিনই যে তরুণের খুনের দায়ে সে জেলে, সে তরুণের ভাই এসে হাজির প্রতিশোধ নেবে বলে। কপাল সহায় বলেই হাড্ডি, মাংস আর প্রাণটা একসাথে নিয়ে ড্যানিয়েল বেরুতে পারলো। কিন্তু বের হয়ে করবে কী ? যাজক হবে! তবে তার আগে একটা দিন থেমে মদ, মাদক আর মানবীতে নিজেকে ডুবিয়ে নিল তারুণ্যের ঝাঁঝ শেষবারের মতো অনুভব করতে। কাল ভোর থেকে তো ধম্মকম্মের দিকেই যাবে।
কিন্তু যাজক হতে পারাটা সহজ হলো না ড্যানিয়েলের জন্য। একজন কারাভোগ করা ব্যক্তি হবে আবার ধর্মপ্রচারক! এ যে ধর্মের গায়ে কালিমা লেপন রীতিমতো। বড়জোর স’মিলে তার জায়গা হতে পারে। কিন্তু সেসব মানল না ড্যানিয়েল। নিজের ইচ্ছায় অটল থেকে চলল সে পোল্যান্ডের উত্তরে। থামল ‘মিডল-অব নোহয়্যার’ এ। বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝ দিয়ে হাঁটতে লাগল দূর হতে ভেসে আসা গীর্জার ঘণ্টার শব্দ লক্ষ করে। এসেও পড়ল ছোট্ট এক মফস্বলে। কপালের জোরে কিংবা কাকতালীয়ভাবেই মফস্বলের একমাত্র গীর্জাটির যাজক কিছুদিনের জন্য শহরে যাওয়ার ভাবনাচিন্তা করছিলেন। ড্যানিয়েলের মিথ্যা যাজক পরিচয় আশ্বস্ত করল তাকে।
পোশাক চড়িয়ে যাজক তো ড্যানিয়েল বনে গেল। কিন্তু ওতে তো শেষ নয়। সারমন দিতে জানতে হয়, কনফেশন নিতে জানতে হয়। সেসব কী করে করবে, তা ভাবতে ভাবতে ড্যানিয়েল তার আইপ্যাড নিয়ে বসে যায়, গুগল করে জেনে নিতে। এ যেন যাজক ভার্সন ২.০ ! ড্যানিয়েলের অদ্ভুত কিন্তু সতেজ সব সারমন মফস্বলবাসীদের বিমোহিত করল, স্বস্তি এনে দিল। তাদের মুগ্ধ হওয়া অভিব্যক্তিগুলো ড্যানিয়েলের ভেতরে অনুনাদ জাগায়। দিন যতই যায়, ড্যানিয়েলের মাঝে ততই গাঢ় হয়ে উন্মেষ ঘটে আধ্যাত্মিক ভাবের। আবার একইসাথে অতীত দ্বারা তাড়িত হয় ড্যানিয়েল। তবে তার আধ্যাত্মিক যাত্রা আরো গভীর হয়, যখন এই মফস্বলের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি সে জানতে পারে।
‘কর্পাস ক্রিস্টি’ বাস্তব ঘটনার নিরীখে নির্মিত। বিশ্বাস করা কষ্টসাধ্য ঠেকলেও এমন ঘটনা বাস্তবেই স্থান নিয়েছে। তবে কর্পাস ক্রিস্টি গোঁড়া ধর্মতাত্ত্বিক সিনেমা নয়। ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবখানায় ভারি নয়। ভাবের দিক দিয়ে কর্পাস কিস্ট্রির সাদৃশ্য টানা যেতে পারে পরিচালক ‘পল শ্রেডার’-এর অসামান্য সিনেমা ‘ফার্স্ট রিফর্মড’ (২০১৮)-এর সাথে।
কর্পাস ক্রিস্টির মূল চরিত্রের বুনিয়াদ মিথ্যের মাঝেই। তাই এই সিনেমা মিথ্যাকে তড়িৎ ভালো বা মন্দের পাল্লায় না মেপে, সময় নিয়ে এই মিথ্যের বুনিয়াদের ভেতর দিয়েই সত্যের প্রকৃতি উন্মোচন করেছে। শুধুমাত্র ক্যাথলিক গীর্জা এবং বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের প্রকৃতি নিয়ে এই সিনেমা নয়, বরং বিশ্বাস এবং পাপের প্রকৃতি কেমন (?), ধর্ম মানুষের গভীর প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে কী বলে এবং কীভাবে মেটায় সেসব প্রয়োজন (?)- এমন সব প্রশ্নের গভীরে দেখতে চেয়েছে কর্পাস ক্রিস্টি। এই প্রশ্নগুলোর মাঝ দিয়েই ধর্মীয় ধারণার দিক হতে কারো প্রলোভন, অপরাধবোধ, বিচার, পরিত্রাণের উপায়, সংশোধনের মতো বিষয়সমূহের অর্থ নিয়ে আলোচনা করেছে।
তবে ‘মাতিউশ প্যাসেউইজ’-এর চিত্রনাট্য এমন নিগূঢ় সব বিষয়ের পাশাপাশি একদম সাধারণ মানবপ্রকৃতি তুলে আনতে ভুলে যায়নি। ড্যানিয়েলের ভুয়া যাজক পরিচয়ের হেতু ধরে তাকে দোষী হিসেবে বিচার করতে যায়নি মাতিউশের চিত্রনাট্য। আবার ড্যানিয়েলের হিপোক্রেসির কথাও ভুলে বসে থাকেনি। ড্যানিয়েল যেমন করে হিপোক্রেট, তেমন করে হিপোক্রেট চার্চ এবং অনুসারীরাও। ন্যায়ের ধারক-বাহক কর্পাস ক্রিস্টি নয়। কর্পাস ক্রিস্টির দুনিয়া ভালোমন্দের বিচারে নয়, ভালোমন্দের পারস্পরিক সহাবস্থান নিয়ে তৈরী। এবং ভালো-মন্দের বৈপরীত্যকে সহাবস্থানে রাখা বা মিশ খাওয়ানোতেই এই চিন্তা উদ্রেককারী, প্রগাঢ় সিনেমা তার মূল শক্তি খুঁজে পেয়েছে।
তবে চিত্রনাট্যের খানিক অনুমেয় প্রকৃতিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। কিছুটা প্রেমময় কোণ তৈরির চেষ্টা, ধরে পড়ে যাওয়ার একটা ভয় থাকা এবং ভয়ের সেই মুহূর্তগুলো, বিভিন্ন ছোটখাটো গ্যাগ আর অসংলগ্নতা- অনুমেয়তা আর কিছু প্রশ্নের জন্ম দিলেও এসবের পিঠে জড়িয়ে থাকা কমনীয়তা ভ্রুক্ষেপ করতে দেয় না।
তবে সত্য প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার ওই ভয় আবার গোটা সময়টাতেই একটা মানসিক পীড়নের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় দর্শককে। এই বুঝি চোর ধরা পড়ল, আর ধরা পড়লে তো জামিন নেই- সর্বদা এমন একটা ভাবের উপস্থিতি অনেকটা ক্লাসিক থ্রিলারের উপাদানের যোগান দেয় এই ড্রামায়। কিন্তু পরিচালক ‘ইয়ান কোমাসা’ ওই উপাদানগুলোকে ব্যবহার করে অ্যাকশন আবহ তৈরি না করে বরঞ্চ সিনেমার দার্শনিক প্রকৃতিকে আরো চাঁচাছোলা করেছেন। কোমাসা সময় নিয়ে কর্পাস ক্রিস্টির চরিত্রদের এবং তাদের ঘিরে থাকা দুনিয়াটি সম্বন্ধে দর্শককে জানিয়েছেন। সফট লাইটিং ব্যবহার করে পোল্যান্ডের গ্রামাঞ্চলের ল্যান্ডস্কেপ শটগুলোতে একটা মাতাল করা ভাবের জন্ম দিয়েছেন। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, বিছানা পেতে দেওয়ার মতো তৃণভূমি, গীর্জার ঘণ্টার প্রতিধ্বনিত শব্দে পাখিদের ছত্রভঙ্গ হওয়াতে গ্রামীণ ছন্দে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে দিয়েছেন দর্শককে। তবে একইসাথে বিষণ্ন আবহও অনুভূত হয়, কারণ গল্পের রথ তো সেদিকেই যাচ্ছে।
বিষয়াদির নিবিড়তা থাকলেও কর্পাস ক্রিস্টি দেখার অভিজ্ঞতা আশ্চর্যজনকভাবেই আনন্দদায়ক। হালকা চালের স্পর্শ যেন জড়িয়ে রেখেছে গোটা সিনেমাকে। অথচ বিষয়াদি বিবেচনায় কর্পাস ক্রিস্টি চাইলেই ধীরগতির এবং অতিশয় ভারি ‘ইউরোপিয়ান আর্ট-হাউজ’ ঘরানার সিনেমা হতে পারতো। কিন্তু এর অনুনাদি নাটকীয়তা এবং আবহসঙ্গীত ব্যবহারে একটা অসংহতির, সংহতিপূর্ণ তারতম্য রেখে তৈরি লাইট টোন এই সিনেমাকে একইসাথে মজাদার, সতেজ, মর্মস্পর্শী করেছে।
তবে কেন্দ্রীয় চরিত্রে ‘বার্তোশ বেইলেনিয়া’র অভিনয়ও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করছে। তার চোখ দুটো বড়ই অন্যরকম, যেন কোটর ঠিকরে বেরিয়ে পড়বে। ওই চোখজোড়া কাজে লাগিয়েই আবেগের গোটা বর্ণালী সীমাকে তিনি সূক্ষ্ম এবং চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত অভিনয় দিয়ে পূর্ণতা প্রদান করেছেন। এক বাক্যে, অনবদ্য তার অভিনয়।
শেষত বলতে হয়, কর্পাস ক্রিস্টি গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা। কারণ এর বক্তব্য সর্বজনীন। কুসংস্কার এবং নির্দিষ্ট পোশাকের প্রতি অন্ধভক্তিকে বিদ্রুপ করার পাশাপাশি কতটুকু ঠুনকো এই ভক্তি, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়- কর্পাস ক্রিস্টি।