Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ম্যালেনা: বিশ্বযুদ্ধ, কৈশোর এবং জীবনের দুর্ভাগ্যের গল্প

ম্যালেনা সিনেমাটির রেটিং খুব বেশি না হলেও, সিনেমা মহলে এটি বেশ আলোচিত। ‘আর রেটেড’ এই সিনেমাটির বেশকটি অঙ্ক জুড়েই যথেচ্ছ নগ্নতার ছড়াছড়ি। সিনেমাটি দেখানো হয়েছে সিসিলি শহরের এক কিশোরের চোখ দিয়ে। ছেলেটি সবেমাত্র বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে। শহরের সবচেয়ে সুন্দরী আবেদনময়ী নারী ম্যালেনাকে ঘিরে তার মনে তৈরি হয় যৌন বাসনা। ব্যাপার হলো, শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেওয়ার সময় যৌনতা নিয়ে অমন আগ্রহ তো হয়ই, তা এতো আলাদাভাবে দেখানোর কী আছে? কিশোরের চোখে নারীদেহের রূপায়ণ ছাড়া আর কী বা আছে এখানে? তাই সাধারণভাবেই অনেকেই সিনেমাটি অশ্লীল আখ্যা দিয়ে রেখেছেন।

‘ম্যালেনা’ চলচ্চিত্রের একটি পোস্টার; Image Credit: Miramax

কিন্তু আরেকটু চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলেই অনুভব করা যায় অনেক কিছু। দেখা যায়, ম্যালেনা শুধু বিশ্বযুদ্ধ বা যৌনতার গল্প নয়। এটি আমাদেরই শিশু থেকে কিশোর হয়ে ওঠার গল্প। যৌনতাবোধের প্রথম অনুভবে কিশোর মনের তোলপাড় যেমনভাবে এখানে এসেছে, একইসাথে সমাজ এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবকে জোসেপ্পে তোর্নাতোরে ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণ যত্নে। পাশাপাশি কিশোরের চোখে ফুটে উঠেছে সমাজের মানুষের নিম্ন মানসিকতা, সুবিধাবাদিতা এবং যুদ্ধকালীন বিরূপ পরিবেশে নিঃসঙ্গ ও অসহায় এক নারীর নিরীহ আত্মসমর্পণের গল্প। 

জুসেপ্পে তোর্নাতোরে ইতালীয় চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য নাম। ইতালীয় সিনেমা জগতকে পুরো বিশ্বের বুকে পরিচিত করে তুলতে তার অবদান অনস্বীকার্য। সিনেমা প্যারাডিসো (১৯৮৮), এভরিবডি ইজ ফাইন (১৯৯০), ম্যালেনা (২০০০), বারিয়া (২০০৯)’র মত কালজয়ী কিছু চলচ্চিত্রের পরিচালক তিনি। লুসিয়ানো ভিনসেনজেনির গল্প অবলম্বনে এ চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা এবং পরিচালনা করেছেন জুসেপ্পে তোর্নাতোরে। 

ম্যালেনা চরিত্রে মনিকা বেলুচ্চি; Image Source: IMDb

এ চলচ্চিত্রের গল্পটি বর্ণিত হয়েছে সাড়ে বারো বছরের কিশোর রেনাটো আমারোসোর চোখে। তখন ১৯৪০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তার ছোঁয়া এসে লেগেছে ইতালির ছোট্ট শহর সিসিলিতেও। গল্পের সূচনা হয়েছে এমনই এক দিনে যেদিন কিশোর রেনাটোর জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। ঐদিন ইতালি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি জড়িত হয়, রেনাটো তার বাবার কাছ থেকে একটি সাইকেল পায় এবং ঐ একই দিনে সে প্রথমবারের মত ঐ শহরের সুন্দরী নারী ম্যালেনাকে রাস্তায় হেঁটে যেতে দেখে। সাড়ে ১২ বছরের কিশোর রেনাটোর শরীর ও মনে তখন বয়ঃসন্ধিকালীন নানা পরিবর্তন এসেছে, নারীদেহের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তার সমবয়সী কিশোরদের মত সে সুন্দরী ম্যালেনার প্রতি তীব্রভাবে আকৃষ্ট হয়।

ম্যালেনা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে কিশোর রেনাটো; Image Source: IMDb

অন্যদিকে সিসিলি শহরের এক প্রান্তে বাস করে ম্যালেনা। তার স্বামী আর্মি অফিসার নিনো স্কোর্ডিয়া যুদ্ধে যেয়ে এখনো ফেরেননি। বৃদ্ধ শিক্ষক পিতা ছাড়া তার ঐ শহরে আর কোন আপনজন নেই। এক সময় খবর এল, যুদ্ধে নিনো স্কোর্ডিয়ার মৃত্যু হয়েছে। খবরটি ছড়ানোর পর, ম্যালেনার সৌন্দর্য এবং নিঃসঙ্গতার সুযোগে তার উপর নানা পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি এসে পড়ে। শহরের রাস্তাঘাটসহ সব জায়গায় তাকে নিয়ে প্রবল গুঞ্জন শুরু হল। শহরের প্রায় সব মহিলা ভাবতে শুরু করে, তার স্বামীও বুঝি ম্যালেনার সাথে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত। আর এই সন্দেহে সবাই তাকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত হওয়া শুরু করল। যদিও ম্যালেনা তার স্বামীকে গভীরভাবে ভালবাসত, কিন্তু যুদ্ধকালীন খাদ্যাভাব এবং পুরুষের লোলুপ দৃষ্টির কাছে এক সময় তাকে আত্মসমর্পণ করতেই হলো।

ম্যালেনা চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে কিশোর রেনাটো ও ম্যালেনা; Image Credit: Miramax

ম্যালেনার এই দুর্বিষহ এবং ভয়াবহ জীবনের একমাত্র সাক্ষী কিশোর রেনাটো। সুন্দরী ম্যালেনার প্রতি তার যে শুধু যৌন কামনা সৃষ্টি হয়েছে তা নয়, অসহায় ম্যালেনাই হয়ে উঠেছে রেনাটোর প্রথম প্রেম। যদিও ম্যালেনার প্রতি তার এই ভালোবাসা কোনভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি, তবু ম্যালেনার জীবনের এই কঠিন সময়ের প্রতিটি অংশকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করেছে সে।রেনেটো অনুভব করেছে যে, ম্যালেনার কষ্টই তার কষ্ট। প্রকৃতই ভালোবেসে ম্যালেনার সব কষ্ট সে দূর করতে চেয়েছে। দূর থেকে সে মনে মনে ম্যালেনাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, “আমি বড় হলে তোমার আর কোন কষ্ট থাকবে না।”

‘ম্যালেনা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে সিসিলির রাস্তায় ম্যালেনা; Image Credit: Miramax

ম্যালেনা চলচ্চিত্রের মৌলিকত্ব বা বিশেষত্ব এই যে, এখানে দুটো যুদ্ধ- প্রথমটি যৌনতার প্রথম বোধে কিশোরের মনের যুদ্ধ এবং অন্যটি বিশ্বযুদ্ধ, দু’টির যুগলবন্দি করা হয়েছে অসামান্য দক্ষতায়। ম্যালেনার প্রতি কিশোর রেনাটোর শারীরিক কামনা সময়ের প্রভাবে কিভাবে ভালবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে, তা পরিচালক দেখিয়েছেন তার আপন ভঙ্গিতে। চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র ম্যালেনা’র নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। এখানে রেনাটো চরিত্রে অভিনয় করেছে জুসেপ্পে সালফারো এবং ম্যালেনার ভূমিকায় অভিনয় করেছে প্রখ্যাত ইতালিয়ান মডেল ও অভিনেত্রী মনিকা বেলুচ্চি। দুজনেই তাদের চরিত্রগুলোর যথাযথ রূপায়ণে নিজেদের সর্বোচ্চটা ঢেলে দিয়েছেন।

কৈশোরের আবেগকে তার যথাযথ রূপে অসাধারণ যত্নে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। পাশাপাশি ভালবাসা এবং যৌন কামনার মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্যটিও উন্মোচিত হয়েছে। দূর থেকে ম্যালেনাকে পর্যবেক্ষণ করার ফাঁকে ফাঁকে রেনাটোর অনুভূতি ও কল্পনার নিখুঁত রূপায়ণ দর্শককে বিশেষভাবে মুগ্ধ করবে। ম্যালেনা কারো সাথে হেসে কথা বললে রেনাটোর মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ঈর্ষাবোধ। আবার ম্যালেনার সম্পর্কে কেউ বাজে মন্তব্য করলে সে তার নিজের জায়গা থেকে তার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। ঢিল ছুঁড়ে জানালা ভেঙে দেওয়া অথবা পানিতে থুতু মিশিয়ে দেওয়ার মত রেনাটোর প্রতিশোধগুলো যেমনিভাবে তার কৈশোরের আবেগকে প্রকাশ করে, তেমনিভাবে হাস্যরসেরও জন্ম দেয়।

সময়ের কাঠিন্যে ম্যালেনার দেহপসারিনী হয়ে ওঠা; Image Credit: Miramax

এ চলচ্চিত্রে খুব বেশি গাম্ভীর্য বা কাঠিন্য নেই, বরং বেশিরভাগ ঘটনা হাস্যরসের মধ্য দিয়ে খুব সহজভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এ সত্ত্বেও চলচ্চিত্রের মূলে যে বাণী, তা খুব সহজে দর্শকের হৃদয়ে যেয়ে পৌঁছায়। সৌন্দর্য এবং অভিভাবকহীনতায় একজন নারীর জীবন কিভাবে অসহনীয় কঠিন করে তোলে, পাশাপাশি তার প্রতি সমাজের নগ্ন এবং বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ দর্শকের হৃদয়ে আঘাত করে, ভাবিয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, অর্থাভাব এবং লোলুপ সমাজের তাড়নায় ম্যালেনার দেহপসারিনী হয়ে ওঠা কিংবা নাৎসি বাহিনীর শহর ত্যাগের পর ঈর্ষান্বিত এবং হিংস্র হয়ে ওঠা মহিলাদের অত্যাচারে ম্যালেনার মেসিনায় চলে যাওয়া, শুধুমাত্র কিশোর রেনাটোকে আঘাত করে না, তার মর্মবেদনা দর্শক হৃদয়েও পৌঁছায়। সমাজের মানুষের সুবিধাবাদী মনোভাবের নগ্ন রূপটি তার যথার্থ রূপে এসেছে এখানে। গল্পের পাশাপাশি এ চলচ্চিত্রের অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি এবং আবহসঙ্গীত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধের মত ধরে রাখতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

‘ম্যালেনা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে সিসিলির রাস্তায় নির্যাতিত ম্যালেনা; Image Credit: Miramax

ম্যালেনা চলচ্চিত্রটির আরেকটি চমকপ্রদ দিক হচ্ছে কিশোরের কল্পনাপ্রবণ মন এখানে অসামান্য দক্ষতায় উন্মোচিত হয়েছে। ম্যালেনাকে ঘিরে কিশোর রেনাটোর যৌনচেতনা এবং কল্পনাকে পরিচালক অনেকগুলো ফর্মে এ চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। কাজেই ম্যালেনাকে কেন্দ্র করে রেনাটোর যৌন কামনা- বিশেষ করে কল্পনায় সিনেমার নায়ক হওয়া অথবা গ্লাডিয়েটররূপে যুদ্ধ করার কল্পনাগুলো যেন আর শুধুমাত্র আর রেনাটোর থাকে না; এগুলোতে আমরা আমাদের হারানো কৈশোরের স্পষ্ট ছায়া দেখতে পাই। যৌনচেতনা অথবা ভালবাসার বাইরে এ চলচ্চিত্রের গল্প আরও গভীর। একটি যুদ্ধের ভয়াবহতায় কিভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সবকিছু, কিভাবে মানুষ হারিয়ে ফেলে তার মানবতাবোধ- চলচ্চিত্রের শেষের দিকে তার যথার্থ প্রকাশ অনুভূতির জগতে বিশেষভাবে নাড়া দেয়।

‘ম্যালেনা’ চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে কিশোর রেনাটো; Image Credit: Miramax

“অনেক সময় পার হয়ে গেছে এবং আমিও অনেক মেয়ের প্রেমে পড়েছি। তারা আমাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করেছে, আমি কি তাদেরকে মনে রাখব? আমি তাদেরকে বলেছি, মনে রাখবো। কিন্তু ম্যালেনাই একমাত্র নারী যে আমায় তাকে মনে রাখতে বলেনি, কিন্তু তাকে আমি কখনো ভুলিনি।”

পরিপক্ব বয়সে এসে এই উক্তিটি রেনাটোর। এ চলচ্চিত্রের একেবারে শেষ অংশে সে ম্যালেনাকে কয়েকটি পড়ে যাওয়া কমলা ঝুড়িতে তুলতে সাহায্য করে। তখনই প্রথমবারের মত ম্যালেনার সাথে রেনাটোর সরাসরি কথা হয়। বাকি পুরোটা সময়ে ম্যালেনাকে সে দেখেছে ঘরের ছিদ্র দিয়ে কিংবা দূর থেকে। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে সাইকেল চালিয়ে দূরে চলে যেতে যেতে সে এ কথাটি বলে। এ চলচ্চিত্রের সকল দর্শকের জন্য এ উক্তিটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। কারণ রেনাটোর এই উপলব্ধি শেষমেশ শুধু রেনাটোর একান্ত নিজস্ব থাকে না, বরং এই বক্তব্যটি এ চলচ্চিত্রের সকল দর্শকের নিজের কথা হয়ে ওঠে। সেরা সিনেমাটোগ্রাফি এবং সেরা অরিজিনাল স্কোর বিভাগে চলচ্চিত্রটি একাডেমি অ্যাওয়ার্ডের নমিনেশন পেয়েছিল। এটি জিততে না পারলেও ২০০১ সালের ক্যবোর্গ চলচ্চিত্র উৎসবে গ্রান্ড প্রিক্স জয় করেছিল ম্যালেনা। 

ম্যালেনা শুধু একটি চলচ্চিত্র নয়, এটি আমাদের প্রত্যেকের কৈশোরের গল্প। যৌনতার বাইরে যেয়ে হলেও আমাদের কৈশোরের আবেগের গল্প। শান্ত হৃদয়ে দু চোখ মেলে এ চলচ্চিত্রটি দেখলে অনুভব হয় অনেক কিছু। একই সাথে খুঁজে পাওয়া যায় একটি হারানো কৈশোর, যুদ্ধকালীন সংকটে বিপন্ন একজন নারী, জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ যৌনতা এবং একটি অন্য রকম ভালোবাসার গল্প। 

This is a review of the Italian film 'Malèna', released on October 17, 2000. From a story by Luciano Vincenzoni, it was directed and written by Giuseppe Tornatore. It won the Grand Prix at the 2001 Cabourg Film Festival.

Featured Image: prod.miramax.digital 

Related Articles