গিরিচূড়ার অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায় ওরা কয়েকজন খেলছে, কয়েকটি ছেলে ও মেয়ে। টিনের কৌটোমতন কিছু একটা দিয়ে ফুটবল খেলছে চোখ বেঁধে, অলস সময় পার করতে। তাদের সবার সঠিক বয়স আন্দাজ করে ওঠা যায় না। তবে মোটামুটি সাবালকত্ব ছুঁই-ছুঁই করছে- এমন সীমারেখায় বাধা যায়। কাছাকাছি এক গিরিখাতেই বাস। পাথুরে গুহামতন দেখতে। সেই গুহার মাথার ওপরে সুউচ্চ পাহাড়গুলো দাঁড়িয়ে আছে, শত্রুর থাবা থেকে গুহাকে আগলে রাখার ভঙ্গিতে। চারদিক ঘিরে থাকা মেঘ যেন তাদের ঢেকে রেখেছে শত্রুর চোখের আড়ালে। মিলিটারিদের মতো প্রশিক্ষণ নেয় তারা, উদ্দেশ্যহীন ঘুরে-ফিরে, লাভবার্ডসের মতো কাছে ঘেঁষে পরস্পরের শরীরে উষ্ণতা জাগায়, কাঁচা মাশরুম খেয়ে উন্মত্ত হয়ে মৃত পরিবেশে প্রাণের সঞ্চার ঘটায়।
ঝুপ করে অন্ধকার নামলে আগুন জ্বালিয়ে, আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে তারা। শরীরে ক্লান্তি নেমে আসলে জিরোয়। আবার শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে চিৎকার করে উঠে আনন্দে। সেই চিৎকার কম্পন জাগানোর ক্ষমতা রাখে বিশাল স্বর্গদ্বারে। তবে স্বর্গের ধারেকাছেও নেই তারা। কোথায় আছে তা কখনোই পরিষ্কার নয়। হতে পারে লাতিন আমেরিকার কোনো এক অচেনা গিরিখাতে। হতে পারে কলম্বিয়ায়। কিংবা হতে পারে ‘নেভারল্যান্ড’-এ।
তাদের সত্যিকারের নাম দর্শক কখনোই জানতে পারে না। বিগফুট, র্যাম্বো, বুমবুম, দ্য লেডি, স্মার্ফ- এসব সাংকেতিক নামে ডাকে তারা একে অপরকে। তারা ছাড়া এই দিকটায় তেমন কারো পদচিহ্ন পড়ে না। সারা দুনিয়া হতে বিচ্ছিন্ন যেন তারা। এই বয়সের অন্যান্য ছেলেমেয়ের মতো কোনো আধুনিক প্রযুক্তি তাদের হাতে শোভা পেতে দেখা যায় না। ‘ইন্টারনেট’ নামক কিছুর সাথে তাদের সখ্য গড়ে ওঠেনি, গড়ে উঠেছে বরং ভয়ানক অস্ত্রের সাথে। সেই সাথে উঠতি বয়সের হরমোনাল ক্রিয়া, যৌনতা নিয়ে নানা নিরীক্ষার দিকে তাদের ধাবিত করে। এই অঞ্চলে ওরা বাদে আর একজন মানুষের আনাগোনাই চোখে পড়ে। নাম তার ‘দ্য মেসেঞ্জার’। বেঁটে, পেশীবহুল, গাট্টাগোট্টা আকৃতির এই মেসেঞ্জার ‘দ্য অর্গানাইজেশন’ নামক এক রহস্যময় প্রতিষ্ঠানের বার্তা বহন করে ‘মনোস’ বলে নিজেদেরকে পরিচয় দেওয়া এই যোদ্ধাশিশুদের দলটির কাছে।
মিলিটারি প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদেরকে গুলি ছোড়া, গেরিলা আক্রমণের প্রশিক্ষণও দেয় সে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে যেন। কিন্তু যুদ্ধ কী, তা ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারার পরিপক্বতাই তাদের মাঝে আসেনি। তবে তাদের চপলতাপূর্ণ মুহূর্তগুলো উবে যায় যখন জিম্মি হিসেবে একজন আমেরিকানকে ধরে আনা হয়। জিম্মিকে তারা ডাকে ‘ডক্টোরা’ নামে। জিম্মিকে দেখভালের দায়িত্ব এই ছেলেমেয়েগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়ে গাট্টাগোট্টা মেসেঞ্জার ‘অর্গানাইজেশন’-এর নির্দেশ আনতে চলে গেলেন। এদিকে ভুল করে তারা মেরে ফেলে ‘শাকিরা’ নামের এক গাভীকে। সত্য লুকাতে নেয় মিথ্যার আশ্রয়।
এবং এর মধ্য দিয়েই তাদের একতায় চিড় ধরা শুরু হয় হালকা করে। এতক্ষণের আমেজ এবার বদলাতে শুরু করে। হরমোনাল ক্রিয়ার উপর এখনো নিয়ন্ত্রণ রাখতে না শেখা ছেলেমেয়েগুলোকে তত্ত্বাবধানহীন একটা অবস্থায় অস্ত্র এবং একজন জিম্মি হাতে ধরিয়ে দিলে পরিস্থিতি কেমন হতে পারে কিংবা কতটা বদলাতে পারে; তার কঠিন সীমার বয়ান রাখতে আরম্ভ করে সিনেমা। অস্ত্র এই ছেলেমেয়েগুলোর ভেতরে এক জলজ্যান্ত দানবের জন্ম দিয়েছে। ভেতরের সেই ওঁৎ পেতে থাকা দানব; বাড়িয়ে রাখা নোংরা, ভয়ংকর রোমশ থাবায় উচ্ছলতা আর সরলতাকে গ্রাস করে নিকৃষ্টতাকে স্থান দিচ্ছে।
নিয়ম, সভ্যতার বেড়ি যদি পায়ে আটকে না থাকত তবে জীবন কেমন হতো?- মানুষের এই ভাবনা সবসময়ই ছিল এবং থাকবে; কারো কাছে স্বপ্ন হয়ে, কারো কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে। এই ভাবনা বিশেষ করে তরুণ বয়সেই সবচেয়ে বেশি আলোড়ন জাগায় মনে। সমাজের নীতিতে নিজেকে বাধার সময়টা যে তখনও পুরোপুরি আসে না। কলম্বিয়ান পরিচালক আলেহান্দ্রো ল্যান্ডেস তার ‘মনোস’ সিনেমায় গেরিলা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সেই অনুভূতিই খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে তিনি স্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করেননি। এই তরুণ-তরুণীদের কোনো পূর্বপরিচয়ও খোলাসা করেননি। এমনকি কেন কিংবা কোন ধারণা থেকে তারা এই সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করল সেই ব্যাখ্যাও দেননি, যা হয়তো প্রচলিত ধারায় ল্যান্ডেসের না হাঁটতে চাওয়ার মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। বরং এই গেরিলাদলের প্রেক্ষাপটে কিছু তরুণ-তরুণীর বাহিরের কোনোরকম প্রভাব এবং প্রযুক্তি বিনা নিজেদের মতো করে জীবন চালানোর পন্থাকে কেন্দ্রে রাখাতেই ছিল ল্যান্ডেসের মনোযোগ। এবং এদের মধ্য দিয়েই সূক্ষ্ম সুতোয় বুনে বুনে গোটা সামাজিক বাস্তুসংস্থানই তৈরি করেন তিনি। একের উপর আরেক যেখানে নির্ভর করে।
স্বপ্নীল অনুভূতি জাগানো ‘মনোস’কে যুদ্ধের সিনেমা বলা যেতে পারে। তবে এ যুদ্ধ চিরস্থায়ী, অবিরত। আবার সংঘবদ্ধ চরিত্র নিয়ে এক সামাজিক নিরীক্ষার সিনেমা তো অনায়াসেই বলা যেতে পারে। ‘লেডি’ চরিত্রের কথাই ধরা যাক। একঘেয়েমির তিক্ততায় আর আকাঙ্ক্ষার ভেলায় সর্বদা অস্থির হয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে। হাত নিশপিশ করতে থাকে প্রতিনিয়ত। আবার ওদিকে আছে সংবেদনশীল চরিত্র ‘র্যাম্বো’, যার লিঙ্গপরিচয় কখনোই স্পষ্ট করে বলা হয় না সিনেমায়। অনেক অপরিচিত মুখের সন্ধান মেলে এই সিনেমায়। এদের মাঝে পরিচিত মুখ ‘ডক্টোরা’ চরিত্রে অভিনয় করা জুলিঅ্যান নিকলসন। কোনো গড়পড়তা সিনেমা হলে হয়তো এই চরিত্রকে ঘিরেই সিনেমার প্রধান উত্তেজনা, অ্যাকশনের মুহূর্তগুলো তৈরি হতো। তার বিহব্বল, ভীতসন্ত্রস্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই হয়তো গল্প বয়ান করা হতো। কিন্তু ল্যান্ডেস তেমনটি করেননি। অ্যাকশনকে অফ-স্ক্রিনেই রেখেছেন।
সিনেমার প্রথম অংকে খুব কম সময়ই নজরে পড়ে ডক্টোরাকে। তার চরিত্রের পেছনের কোনো গল্প দেখানো হয় না দর্শককে। এমনকি, জিম্মি হিসেবে তুলে আনা নিয়েও বিশদ আকারে কোনো ঘটনা সাজানো হয়নি। ল্যান্ডেসের এই সিদ্ধান্ত, শিকারীর প্রতি শিকারের বশ্যতা স্বীকার করার দিককে প্রতিফলিত হতে সাহায্য করেছে। এবং পরবর্তীতে শিকার ও শিকারির মধ্যকার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক’টাকেও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ধরা পড়ার নেপথ্যে কাজ করেছে। মনোস সৈন্যদলের কাছে ডক্টোরা যতটা না একজন ব্যক্তি হিসেবে অবস্থান করছে, তার চেয়েও বেশি অবস্থান করছে ‘রেসের ঘোড়া’ বা বাজি হিসেবে।
এবং জুলিঅ্যান নিকলসনের অভিনয়ে সুস্পষ্ট চোখে পড়ে পরিস্থিতি আর চরিত্রের সাথে তার বোঝাপড়া কতখানি নিবিড়। তার চরিত্রে সংলাপ খুব কম, তাই স্বভাবতই মানসিক পরিস্থিতি দর্শকের সামনে তুলে ধরতে অভিব্যক্তি এবং শারীরি অভিনয়েই তার জোর প্রদান করতে হবে। এবং গোটা সময় ধরে তিনি শারীরি ভঙ্গিমায়, তার নিজের অসহায়ত্বকে মর্মভেদী করে তোলার পাশাপাশি এই তরুণ-তরুণীদের প্রতি মাঝে মধ্যে মাতৃসুলভ আচরণকেও প্রগাঢ়তা দেন।
শিশুদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ভয়াবহতা এবং সেই ভয়াবহতার নীতিগত ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক চেতনার চিত্রই ‘মনোস’-এর মূলে অঙ্কিত হয়েছে, কোনো নির্দিষ্ট জাতি ও সীমানার কথা উল্লেখ্য হওয়া ছাড়াই। সীমানাবিহীন, বয়স, লিঙ্গ এবং ভৌগোলিক অবস্থানের ভেদাভেদকে তুচ্ছজ্ঞান করাই সিনেমার ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক নির্দিষ্টকরণকে অস্পষ্টতায় ঢেকে দিয়ে, বাস্তবতা আর কল্পিত রূপকথার মাঝে আটকে ফেলে। ‘মনোস’ জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল ভাবতে গিয়ে জট বেধে তৈরি হওয়া স্বপ্নের মতো তাই। কাব্যিক মূর্ছনা গায়ে জড়িয়ে ‘মনোস’ তার নিরন্তর এবং সার্বজনীন বক্তব্য পেশ করে। এবং তা পেশ করতে ল্যান্ডেস ঐশ্বর্যপূর্ণ এবং সুরিয়াল ইমেজারির সৃষ্টি করেন। ‘মনোস’ সিনেমার বক্তব্য অনেক সিনেমা অনেকভাবে প্রদান করলেও এই ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ কেউ আগে তৈরি করেনি। সিনেমাটোগ্রাফার জ্যাসপার ওল্ফের ইমেজারিতে একটি স্বপ্নিল জগতকে ক্রমশ নরকে রূপ নিতে দেখে দর্শক।
কিন্তু নরকের অনুভূতি দেবার জন্য কড়া লাল ব্যবহার করা হয়নি। বরং সবুজ ব্যবহার করা হয়েছে, যা উপস্থাপন করে এক বৈপরীত্য এবং বৈচিত্র। আবার নীল আকাশ, তরঙ্গময় মেঘের ভেলার বিপরীতে সিলহ্যয়েট শটে আগুন আর প্রকৃতিকে ঘিরে চরিত্রদের উন্মত্ততার মুহূর্তগুলো অনাবিল আনন্দে ভরা কল্পিত এক জগতের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠায় দর্শকের চোখে। সিনেমার প্রথম অংকের দীর্ঘ সময় ধরে এই নীল আকাশ আর মেঘ গোটা ফ্রেমের উপর তার কর্তৃত্ব আরোপ করে এবং এমনটা করতে দিয়ে ল্যান্ডেস, মানব-মনের সংবেদনশীল ভাবখানি কতটুকু গাঢ় হতে পারে, তা জাগিয়ে তুলেছেন। আর এই অসামান্য ভিজ্যুয়াল স্টাইলকে আরো মহিমান্বিত করেছে মিকা ল্যাভির পারলৌকিক অনুভূতি জাগানো আবহসঙ্গীত। পাহাড়ের বিশাল খাঁজগুলোতে দুলে বেড়ানো মাতাল হাওয়া, বনের পোকাদের কিচিরমিচিরের শব্দের মতো প্রকৃতির পারিপার্শ্বিক শব্দগুলোকে তার আবহসঙ্গীতে প্রবাহিত হতে দিয়েছেন মিকা ল্যাভি।
তবে, মনোসের এই পারলৌকিক অনুভূতি সময় গড়ানোর সাথে পাল্লা দিয়ে আদিম হতে থাকে। টোনের দিক থেকে যথেষ্ট তাড়াহুড়ো সিনেমার মাঝে লক্ষ্য করা যায়। ডক্টোরার পালানোর চেষ্টা, আপাতদৃষ্টিতে বেড়ে ওঠা এই ছোট্ট সমাজগোষ্ঠীকে ছত্রভঙ্গ করে ফেলে। বৃষ্টি ঘাড়ে নিয়ে রক্তপাতের এক বিধ্বংসী জঙ্গল অভিযানে দর্শককে নিয়ে এই চলে এই সিনেমা, যে অভিযান জোসেফ কনরাডের ‘হার্ট অভ ডার্কনেস’-এর কথা মনে করায়। সিনেমার তৃতীয় অংকে পরিচালক ল্যান্ডেস অ্যাকশন ফিল্মমেকিংকে বুদ্ধিদীপ্ততা আর বিবরণের সাথে ব্যবহার করার পাশাপাশি পরিস্থিতিভেদে মানুষের নোংরা প্রকৃতিকেও সামনে আনেন।
নান্দনিকতার দিক দিয়ে এই সিনেমাকে বেশ সমসাময়িক মনে হলেও, বিষয়াদির দিক হতে মনোস নিরন্তর হয়ে থাকবে। খুনি জন্মায় না, তৈরি করা হয়, এবং পরিস্থিতির মুখে ধসে যেতে পারে নীতির মানদণ্ড- ‘মনোস’ তার এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা করতে শব্দ ব্যয় করেছে যৎসামান্য। ধারণাকে বিস্তৃত করেছে শক্তিশালী ইমেজারি আর অনুভূতি দিয়ে। সমাপ্তি দৃশ্যকে আশাবাদী, নিরাশাবাদী উভয় দৃষ্টিকোণ হতেই ব্যাখ্যা করা যায়। তবে যে অভিজ্ঞতা দর্শকের মাঝে ‘মনোস’ প্রদান করে, তা দর্শকের হৃদয়ে আঁচড় কাটার পাশাপাশি এক সম্মোহনী ক্ষমতায় বেধে রেখে যায়।
… … …
Film’s Name: MONOS (2019)
Country: Colombia
Genre: Drama, war, Apocalyptic
Director: Alejandro Landes