বিস্তৃত রহস্যের ‘অস্পৃশ্যতা’ নাকি ফস্কে যাওয়া সম্ভাবনা?

খুনীর সামনে তার অসহায় শিকার। বাঁচবার আকুতি চোখে-মুখে। ওদিকে খুনী প্রমাণ মুছে এটাকে আত্মহত্যা হিসেবে সাজানোর কাজগুলো করে যাচ্ছে। এরপর যথারীতি খুনীর পলায়ন। এমনই উপন্যাসের পূর্বকথা। এই কথা বলার বিশেষ প্রয়োজন পড়ে না যে, থ্রিলার গল্প/উপন্যাস কিংবা সিনেমা আরম্ভের জন্য এটা খুবই পরিচিত একটা অলংকার। বহুল ব্যবহারে জীর্ণ এবং অতি ক্লিশে রূপেই যাকে বর্ণনা করতে হয়। এই প্রত্যাশিত, পরিচিত পূর্বকথার মাঝে একমাত্র অপ্রত্যাশিত ব্যাপার হিসেবে আসে লেখায় বর্ণিত পাশের কোনো এক মিউজিক স্টোর থেকে ভেসে আসা অর্ণবের ‘তোমার জন্য’ গানের কয়েকটি লাইন। গোটা উপন্যাসে আরো কয়েক জায়গাতেই অবশ্য আধুনিক বাংলা গান, ব্যান্ডের গান ব্যবহার করা হয়েছে। যেসব জায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে, মুডের সাথে মিলিয়ে গানের লাইনগুলো রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

শুরুর এই খুন অতীতের এক বিশাল ঘটনারই সংযোগবিন্দু। তদন্ত করতে গিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর ফাইয়াজ একটি ক্লু খুঁজে পান। তিনি বুঝতে পারেন- ৮ বছর আগে খুন হওয়া শফিক আহমেদের কেসের সাথে এর একটা সংযুক্তি অবধারিত। কারণ, নিহত শফিক আহমেদের স্ত্রী আফসানা আক্তার সদ্য খুন হওয়া জামাল আহমেদের একাউন্টে প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন। এই পয়েন্টে পাঠকের মাথায় যে কথা খেলছে তা যদি হতো, তবে তো আর এই গল্প ২৫৪ পৃষ্ঠা অব্দি প্রলম্বিত হতো না!

ফাইয়াজ এই ঘটনা নিয়ে যান আট বছর আগে তদন্ত করা হোমিসাইড ডিটেক্টিভ ফারুক আব্দুল্লাহর কাছে। এই কেসের কোনো রকম সুরাহা তিনি করতে পারেননি। শেষপর্যন্ত অবসরও নেমে এলো ক্যারিয়ারে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে। একটা দগদগে ঘা ছিল এই কেস, যার ক্ষত এতদিনে অনেকটাই শুকিয়ে এসেছিল। কিন্তু ফাইয়াজ আসেন সমীকরণ পাল্টে দিতে। নিজের উপরও বিপদ ডেকে আনেন। ফারুক আবদুল্লাহ অনেক চেষ্টা করেও এই কেস থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে আর পারেন না। আবার নামতে হয়। 

আট বছর আগে, শফিক আহমেদের সেই খুনের প্রধান সন্দেহভাজনেরা সেই সময়েই খুন হয়। শফিক আহমেদের পর প্রথম খুনের শিকার হয় সোহরাব নামের এক ব্যক্তি। তারপর আসমা শারমিন নামের একজন। প্রথমত, আত্মহত্যা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ঘটনা জটিল। এই আসমা শারমিনের সাথে যোগাযোগ ছিল শফিক আহমেদের। আবার আসমার সাথে ভাব ছিল সোহরাবেরও। তিনজনই মৃত। শফিক আহমেদের এক ছেলে আছে- আবির। অদ্ভুত শান্ত স্বভাবের ছেলে। ওদিকে আসমা মারা যাবার পর তার মেয়ে লাবণীকে দত্তক নেয় তার ফুফু। সেখান থেকে লাবণীর জীবনের আখ্যান হয়েই গল্প চলে। সুন্দরী, বুদ্ধিমতি মেয়ে লাবণী। তার এক স্কুলের বান্ধবী তাবাসসুম লাঞ্ছিত হয়। স্কুলের অংশে আরো কিছু চরিত্র ঢোকে; জহির, মিন্টু, রুস্তম নামে। আবিরও থাকে এককোণে।

Image Source: Wallpaper Cave

 

তারপর গল্প অতীতে থেকেই আরেকটু এগিয়ে যায় তাদের ভার্সিটির জীবনে। লাবণীর সেই ফারজানা নামের স্কুলবান্ধবী হঠাৎ খুন হয়। পুলিশ কাউকেই ধরতে পারে না। আবিরের অংশ আসে। তার আর বন্ধু রাজীবের কথা আসে। ইউনুস আলী নামের এক কুখ্যাত অপরাধীও গল্পে ঢোকে। ব্যাংক ডাকাতি হয়। আবির, ইউনুস আলী নিরুদ্দেশ হয়। লাবণীও আরো বড় হয়। গল্প বর্তমান ধরে আবার এগোয়। সাব-ইন্সপেক্টর ফাইয়াজ নিখোঁজ হন। ফারুক আব্দুল্লাহ সবকয়টা খুনকে একসুতোয় বাঁধতে নামেন। গল্পে রিয়ান খান, প্রাইভেট ডিটেক্টিভ সাফায়েত ইসলাম, রাফিউল, উর্মিদের আগমন ঘটে। ডালপালা বেড়ে আট বছর আগের এবং বর্তমানের জামাল আহমেদের খুনসহ বাকি সবকয়টা খুন একটি নির্দিষ্ট বৃত্তে ঘুরতে শুরু করে এই বিস্তৃত সময়ের উপন্যাসে।

নজরুল ইসলামের প্রথম উপন্যাস ‘অস্পৃশ্যতা’, জাপানি লেখক কিয়েগো হিগাশিনোর ‘মিডনাইট আন্ডার দ্য সান’ অবলম্বনে লেখা। দেশজ উপাদান, সাবপ্লটে একটা ভিন্ন সংযোজন হিসেবে দেখা যেতে পারে। অবশ্য লেখায় এমনিতেই জাপানিজ উপন্যাসের ছায়াটা চোখে পড়ে। কয়েকটা চরিত্রের প্রকৃতিতে, ক্লাইম্যাক্সে উন্মোচিত হওয়া রহস্যের মোটিফে, নিগূঢ় বিষয়ে জাপানি থ্রিলার উপন্যাসের তমসাচ্ছন্ন প্রকৃতিই এখানে অনুভূত হয়। তাছাড়া এক বিষণ্ণতার সুর অনুরণিত হয় গোটা উপন্যাস জুড়েই। সেটার প্রকৃতিতেও জাপানি থ্রিলারের প্রভাব আছে। জাপানের থ্রিলার উপন্যাসের প্রতি লেখকের ভক্তির বিষয়ে অবশ্য ভূমিকাতেই তিনি উল্লেখ করেছেন। 

কিয়েগো হিগাশিনোর সেই বই; Image Source: Alphagirl

থ্রিলার হলেও উপন্যাসের গতি ছিল ড্রামার। ভাবেও সেই ড্রামার আমেজ ছিল। আরো গভীর এবং অন্তর্ভেদী ড্রামা দিয়েই গল্প এগোতে পারত। তবে থ্রিলারই যেহেতু, সেই কড়চা আর দানগুলো ধরেও তো এগোতে হবে। কিন্তু এই দুটো টোনের মাঝে সমতা রাখার ক্ষেত্রে লেখক দক্ষতা দেখাতে পারেননি। বারবারই সমতা হারিয়ে যাচ্ছিল। প্রচুর চরিত্র আর অনেক সাবপ্লটের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে। কিন্তু সুতোর শেষপ্রান্তে সবকিছু এক সুঁতোতে এসে জোড়া লাগলেও ন্যারেটিভ তার সংহতি হারিয়েছে। উপন্যাসের গোটা ন্যারেটিভটা দেখলে ভালো পরিমাণ অসংহতিরই সম্মুখীন হতে হয়।

লেখক এক সময় থেকে আরেক সময়ে যেভাবে লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন, এক্ষেত্রে আরেকটু কম বিক্ষিপ্ত হবার দরকার ছিল। বিষয়টি অহেতুক জটিলতা তৈরি করেছে। আট বছর আগে যখন প্রথম খুন হয়, তখন শেষ অব্দি যে দুটো চরিত্রকে সবকিছুর পেছনে জড়িত দেখা হয়েছে, তাদের বয়স আরো দুটো বছর বেশি দেখালে গোটা ব্যাপারটা আরো বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতো। জাপানের সমাজব্যবস্থা এবং বাকিসব মিলিয়ে হয়তো ঐ বয়সটাই ঠিক। তবে এই দেশের প্রেক্ষাপটে আরেকটু বেশি বয়সের দেখানো উচিত ছিল।

অনেক চরিত্র আর সাবপ্লটের ভারে গাঁজন নষ্টের ব্যাপারে তো উল্লেখ করা হলোই। এবার একটু বিশদ আলোচনা করা যাক। প্রথমে আসে রাফিউলের কথা। লবণীর সাথে তার বিয়ে- এই তথ্য গল্পে প্রকাশ পাবার আগে দীর্ঘ পরিসরেই রাফিউলের আচরণ ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে বলা হয়েছে। উর্মি নামের আরেকটি মেয়ের সাথে তার অব্যক্ত অনুভূতির কোণ দেখানো হয়েছে। পরে এক জায়গায় তো এই দুই চরিত্র আর তাদের সাবপ্লট পৌঁছেছে, কিন্তু সেটা আসলে একটা সমাপ্তি দেওয়ার জন্য দেওয়া। খুবই গড়পড়তা একটা সাবপ্লট। চরিত্র দুটোর এই কোণ না থাকলেও মূল চরিত্রের মোটিফ ঠিকঠাক থাকত। অহেতুক কিছু পৃষ্ঠা এদিকে না বাড়িয়ে বিষয়টাকে অন্য কোণ দিয়ে প্রকাশ করা যেত। ব্যাংক ডাকাতির কোনো বর্ণনা নেই। অবশ্য মূল ঐ চরিত্র যেহেতু সশরীরে সেখানে উপস্থিত ছিল না, তাই বর্ণনা না দেওয়ার ব্যাপারটি বোঝা যায়।

তবে যে উপায়ে সেটা সম্ভব হলো এবং এই ঘটনার পরবর্তী কোনো ফলোআপ কিংবা ইউনুস আলীর অমন পরিণতি কী করে হলো- সেসবের কিছুই নেই শেষে দায়সারাভাবে একটা লাইন বলে দেওয়া ছাড়া। যদি বলা হয়, ডাকাতির পরবর্তী কোনো ঘটনার বিবরণ দেওয়া হয়নি কারণ ওই জায়গায় থার্ড পারসন ন্যারেটিভ রেখেই রাজীবের দৃষ্টিকোণ ধরে ঘটনা বলা হয়েছে। তাই এই জায়গায় পাঠক অন্ধকারে। তবে, শেষে সেই দৃষ্টিকোণ সরিয়ে ফেলাটা এক্ষেত্রে অদূরদর্শিতা এবং দুর্বলতাই প্রকাশ করে। মিন্টু, জহিরের ভূমিকা থাকলেও তাবাসসুম, রুস্তমদের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। 

ফ্ল্যাপ থেকে নেয়া; Image Courtesy: Mamunur Rashid Tanim

‘পনেরো বছরের রোজনামচা’ নামে একটি অধ্যায় দিয়ে উপন্যাসের শেষে ছড়ানো-ছিটানো বাঁকগুলোকে এক দাগে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বেশ কিছু ব্যাপারই ‘খেলো’ হয়ে গেলো। ফারজানা, ফাইয়াজদের ইতিবৃত্ত দুই লাইনে শেষ করে দিলেই সংহতি আসে না। যৌক্তিকতা মেলে না। ২৫৪ পৃষ্ঠার উপন্যাসে এগুলো একটু বিশদ করার সুযোগ মেলেনি, সেটা শুনতে বিশ্বাসযোগ্য লাগে না। সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে ‘রেড হেরিং’ নামে একটা ডিভাইস আছে। মিস্ট্রি, থ্রিলার জনরাতেই মূলত যার ব্যবহার দেখা যায়। সোজা কথায়, রেড হেরিং হলো এমন কিছু যা দর্শককে কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিংবা প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন থেকে দূরে সরায়। মানে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেয়, গোটা জিনিস আরো টুইস্টেড করার জন্য। এটা ব্যবহারের অসুবিধা হলো, যেহেতু জিনিসটি আনাই হয় দর্শককে বিভ্রান্ত করার জন্য, তাই খুব সতর্কতার সাথে ব্যবহার না করলে বন্দুকের নল নিজের বৃত্তেই ঘুরে যেতে পারে। এক্ষেত্রে লেখকের অসতর্কতায় সেটাই হয়েছে। 

মূল ঘটনার পেছনে কারা থাকবে, তা পাঠক আঁচ আগেই করতে পারে। তবে এখানে বিষয়টা কে বা কারা নয়, কেন এবং কীভাবে (?)। ওই জায়গায় লেখক বেশ ভালোভাবেই একটা ফলাফলে আসতে পেরেছেন। তবে মূল দুই চরিত্রের যে সাইকোপ্যাথিক আচরণ, ব্যক্তিত্ব আরেকটু সিরিয়াসলি দেখা উচিত। অত ছোট ব্যাপার তো নয়। বলা চলে, প্রচন্ড নিগূঢ় বিষয়াদি আছে এতে। ওদিকে লেখা আরো বিবরণ-সমৃদ্ধ এবং তীক্ষ্ণ হলে উপন্যাসের অনেক অংশে, সাবপ্লটে ছড়িয়ে থাকা দুর্বলতাগুলো একটা প্রান্তে পৌঁছত।

‘অস্পৃশ্যতা’ সমাপ্তিতে যে নিগূঢ় বিষয়ের সাথে দর্শকের পরিচয় করিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। তবে আরো অনেক সম্ভাবনাকে অসতর্কতায় ফস্কে যেতে দিয়েছেন লেখক নজরুল ইসলাম। গল্পের বিন্যাসরীতি, বয়ানভঙ্গী, এবং সর্বোপরি লেখনশৈলীতে ক্লিশের ব্যাগটা আরো ভারমুক্ত করবেন লেখক পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে- সেটাই প্রত্যাশা। মৌলিকত্ব তবেই আসবে দেশীয় সাম্প্রতিক থ্রিলার বইগুলোতে।

বই সংক্ষেপ

উপন্যাস: অস্পৃশ্যতা
ধরন: মিস্ট্রি, সাইকোলজিক্যাল ড্রামা/থ্রিলার
লেখক: নজরুল ইসলাম
প্রকাশনী: বাতিঘর
প্রকাশকাল: ২০১৮

 

This bengali article is a book review of the বাতিঘর প্রকাশনীজ thriller book অস্পৃশ্যতা. It's the debut novel of young thriller novelist Nazrul Islam. It's a Mystery, Psychological drama/thriller novel. Inspired from the japanese novel 'Midnight Under The Sun'.

Feature Image- @tanim

Related Articles

Exit mobile version