একজন সাধারণ সিনেপ্রেমীর কাছে জনরা অথবা ঘরানা শব্দগুলো নতুন হবার কথা নয়। একজন সিনেমাপ্রেমী মানুষের কানে যখন নতুন অথবা পুরনো কোনো ভালো সিনেমার নাম আসে, তখন তার মনে প্রথম যে প্রশ্নটি জাগে, তা হলো, ‘সিনেমার জনরা কী?’ অনেকে একটি অথবা দুইটি নির্দিষ্ট জনরার সিনেমাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, আবার অনেকেই মোটামুটি সব ঘরানারার সিনেমা দেখতেই ভালোবাসেন। তবে ব্যক্তিবিশেষে রুচি, আগ্রহ ও মানসিকতা ইত্যাদি বিষয়ের ভিন্নতা থাকার ফলে সবারই প্রিয় একটি বা দুটি জনরা থাকে।
কেউ মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্পের রোমান্টিক- ড্রামা জনরা সিনেমা পছন্দ করেন তো কেউ ধুমধাড়াক্কা অ্যাকশন ঘরানার সিনেমা। আবার কারো কারো তো থ্রিলারে ডুবে থাকা একদম নেশায় পরিণত হয়ে ওঠে। থ্রিলারের নামক শাখার ভেতর আবার নানা প্রশাখা আছে। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, ক্রাইম থ্রিলার, মিস্ট্রি থ্রিলার, এরোটিক থ্রিলার ইত্যাদি। তবে নির্বিশেষে, থ্রিলার জনরাই যেন একটি চমকপ্রদ ও আকর্ষণীয় সিনে-জনরা (Cine-Genre)।
আর প্রায় সকল দেশ, ভাষা অথবা ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেই থ্রিলার জনরার জনপ্রিয়তা একদম তুঙ্গে। হলিউড, কোরিয়ান ও স্প্যানিশ ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রে অবশ্য এই জনরার সিনেমাগুলোর মান অনেক এগিয়ে। এসব ইন্ডাস্ট্রির থ্রিলার সিনেমাগুলো সিনেমা জগতে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে যাচ্ছে। সিনেমাপ্রেমীদের সামনে নিত্যনতুন গল্পে থ্রিলারের আমেজ সৃষ্টি করে, সিনেমা দেখার ইচ্ছা ও আনন্দকে অন্যমাত্রা দিচ্ছে।
আর আজকের এই ক্ষুদ্র আয়োজন এমন ৩টি স্প্যানিশ থ্রিলার নিয়ে সাজানো হয়েছে। এই সিনেমাগুলো শুধু স্প্যানিশ সিনেমা জগতেই আলোড়ন তোলেনি, পুরো বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে যেন সিনেপ্রেমীদের হৃদয়ে স্প্যানিশ থ্রিলারকে পাকাপোক্তভাবে স্থান গড়তে সাহায্য করেছে।
১. দ্য বডি (২০১২)
ক্রাইম থ্রিলার জনরার এই সিনেমা যেন স্প্যানিশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যতিক্রমী এক যুগের সূচনা ঘটায়। ইংরেজি ভাষা বাদে অন্যান্য দেশের সেরা থ্রিলারের তালিকা করা হলে এই সিনেমা একদম শীর্ষের দিকে থাকবে। স্প্যানিশ পরিচালক ওরিওল পাউলোর নির্মিত এই সিনেমার ব্যাপ্তিকাল প্রায় ১০৭ মিনিট। সিনেমার প্রথম দৃশ্যে দেখানো হয় একজন লোক বনের ভেতর দিয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে দৌড়াতে মেইন রোডে উঠতেই রাস্তার ওপাশ থেকে আগত গাড়ির উপর এসে পড়ে।
ঘটনাস্থলে লোকটির মৃত্যুর মধ্যদিয়েই মুভির কাহিনীর সূত্রপাত ঘটে। স্বাভাবিকভাবে, লোকটির এভাবে ছুটে এসে গাড়ির নিচে পড়ার পেছনের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে পুলিশ একটি মেডিক্যাল ফরেনসিক ইন্সটিটিউশনে পৌঁছায়। লোকটি সেই ইন্সটিটিউশনে সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিল। সেখানকার সি.সি.টিভি ফুটেজ থেকে পুলিশ জানতে পারে যে, লোকটির পাঁচ মিনিটের জন্য নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে উপর তলায় গিয়েছিল। আর সেখানে এমন কিছু ঘটেছিল, যার ফলে সে নিজের জীবন নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে কী দেখেছিল? অথবা কী ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিল?
তবে এখানেই গল্পের রহস্যের শেষ নয়। এর থেকেও অদ্ভুত ও ভৌতিক ব্যাপার ছিল। ইন্সটিটিউশনের লাশ ঘরে রাখা একটি লাশও গায়েব হয়ে গিয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে, লাশটা কি নিজ পায়ে হেঁটে মর্গ থেকে চলে গেছে? নাকি কেউ লাশটা তুলে নিয়ে গেছে? এভাবেই পুলিশের অনুসন্ধানের সূচনার মধ্যদিয়ে সিনেমাটি জমজমাট রূপের দিকে এগিয়ে যায়।
উপরের অনুচ্ছেদ দুইটি পড়ার পর, আপনার মনে হতে পারে, এটি নিশ্চয়ই নিতান্ত নিম্নমানের কোনো গল্পের ভুতুড়ে সিনেমা হবে। কিন্তু এরকম কিছু ভেবে নিজেকে মোটেও এমন একটি অসাধারণ থ্রিলার দেখা থেকে বঞ্চিত করবেন না। কারণ মাত্র তো শুধু মুভির প্রারম্ভের অংশটুকু বলা হয়েছে। মুভির আসল স্বাদ তো মুভির যত গভীরে যাবেন ততই বুঝতে পারবেন। মুভিটি দেখার পর, “শেষ ভালো যার, সব ভালো তার” কথাটা আপনাআপনি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
‘দ্য বডি’ সিনেমাটি ক্রাইম ও মিস্ট্রির সমন্বয়ে এমন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সিনেমা যাতে একটি অভিশপ্ত অতীতের ফলে বর্তমান ও ভবিষত জীবনে কেমন বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, তা দেখানো হয়েছে। অতীতের পাপ যে সহজে পিছু ছাড়ে না, মানুষ তার কর্মের ফল দুনিয়াতেই ভোগ করে যায়, এই ব্যাপারগুলোও সিনেমার গল্পে ফুটে উঠেছে। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ, পরকীয়া ও প্রেম এই চারটি উপাদান সিনেমাটিতে দারুণভাবে পাশাপাশি অবস্থান করে সিনেমাটিকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে।
২. থিসিস ( ১৯৯৬)
‘থিসিস’ শব্দটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। সাধারণ স্নাতক (সম্মান) অথবা স্নাতকোত্তর অথবা আরো উচ্চতর ধাপে পড়াকালীন নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত যেকোনো বিষয়ের উপর গবেষণা ও অনুসন্ধান করে, প্রাপ্ত ফলাফলের সাথে নিজস্ব মতামত মিলিয়ে যে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, সেটাকেই থিসিস বলে। কিন্তু এই থিসিস যদি কারো জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়, তখন?
অ্যাঞ্জেলা কিছুটা গম্ভীর, তবে দারুণ মিশুক ও সুন্দরী একটি তরুণী। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অ্যাঞ্জেলা নিজের থিসিসের বিষয় হিসেবে বেছে নেয়, বর্বরতা। সে এমন কিছু ভিডিও ক্লিপের সন্ধানে ছুটতে থাকে, যেগুলোতে বাস্তব জীবনে ঘটা বর্বর ও হিংস্রতার ছাপ ফুটে উঠেছে। হতে পারে সেটা যৌন নির্যাতনের সাথে জড়িত অথবা এর থেকেও পাশবিক কোনো ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত।
আর এই থিসিসের চক্করে সে চেমা নামের একটি পাগলাটে ছেলের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলে। চেমা অ্যাঞ্জেলাকে তার থিসিসের জন্য উপযুক্ত যোগানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু সবকিছু বদলে যায় যখন অ্যাঞ্জেলার হাতে একটি ভিডিওটেপ এসে পড়ে। গল্পের মোড় যেন পাল্টে যেতে থাকে। এরপর থেকে সিনেমার গল্প এমন এক ভয়াবহতা ও নিষ্ঠুরতার পথে আগায় যে, দর্শকের মাথা কিছুক্ষণের জন্য হলেও গুলিয়ে যাবার অবস্থা হতে বাধ্য হবে।
আজ থেকে প্রায় বাইশ বছর আগে স্প্যানিশ ইন্ডাস্ট্রিতে এমন গল্পের উপর ভিত্তি করে এত দারুণ নির্মাণশৈলীর সিনেমা যে বানানো হয়েছে, তা ভাবতেই আসলে ভালো লাগে। সিনেমার প্লট থেকেও সিনেমার চিত্রনাট্য, অভিনয় ও নির্মাণ কৌশল বেশি উন্নতমানের ছিল, যা কিনা প্রশংসনীয়।
১২৫ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই সিনেমার পরিচালক ছিলেন আলেহান্দ্র আমেনাবার। মজার ব্যাপার হলো, সিনেমাটি নির্মাণকালে তার বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ বছর। এত অল্প বয়সে এত নিখুঁত সৃষ্টিকর্ম জন্ম দেওয়ায় তিনি স্পেনের অন্যতম নন্দিত নির্মাতাদের সারিতে নিজের নাম লিখিয়ে নিয়েছিলেন।
‘থিসিস’ সিনেমাটি অন্তত একবার হলেও সবার দেখা উচিত বলে, আমি মনে করি। আপনাদের আগ্রহ আরও একটু বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য বলে রাখা ভালো, সিনেমাটি সিরিয়াল কিলিং এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। তবে সরাসরি সিরিয়াল কিলারের কর্মকাণ্ড ও নৃশংসতা না দেখিয়ে, একজন সিরিয়াল কিলারকে সনাক্ত করতে একটি সাধারণ তরুণীর তদন্ত প্রক্রিয়াই ছিল সিনেমাটির আলোচ্য বিষয়।
৩. স্লিপ টাইট ( ২০১১)
একজন ভিনদেশী সিনেমাপ্রেমী হিসেবে স্প্যানিশ এই সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারটি না দেখলে, নিজেকে থ্রিলারপ্রেমী হিসেবে পরিচয় দিতে পারেন না। শুধুমাত্র স্প্যানিশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্যই নয়, এই সিনেমাটি সমগ্র সিনেমা দুনিয়ার জন্য একটি মাস্টারপিস থ্রিলার। যারা নতুনত্ব ভরপুর কোনো থ্রিলার মুভির সন্ধানে মরিয়া হয়ে উঠেছেন, তাদের জন্য এই মুভিটি একদম ‘সোনায় সোহাগা’। একে তো দারুণ আকর্ষণীয় প্লটের সিনেমা উপভোগ করার সুযোগ মিলবে। আবার সিনেমা জগতের অন্যতম সেরা এক থ্রিলার নিজ চোখে পরখ করে দেখারও সৌভাগ্য হবে। তাহলে আর দেরি কেন? চলুন, সিনেমা সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
আচ্ছা, ‘সুখ’ নামক বস্তু কি আসলেই অলৌকিক? সুখের দেখা কি সবাই পায় না? নাকি সুখ- দুঃখের মিলনে গড়ে উঠা এই জগতে সুখী হবার অধিকার সবার নেই? মানুষ কি নিজে থেকে সুখের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়? নাকি প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে সুখ একটি নিজস্ব নিয়মে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অতিথি হয়ে আগমন ঘটিয়ে থাকে? না, পাঠক। এখানে মোটেও ‘সুখ’ নামের এই অপার্থিব উপাদানের উপর গবেষণা করা হচ্ছে না। এই বিষয়টা তোলার কারণ, এখন যে সিনেমাটি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, সেটির গল্পের অন্যতম উপজীব্য বিষয় হচ্ছে, ‘সুখ’।
সিনেমার গল্পটি এমন এক ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে গড়ে উঠেছে যে কিনা বড্ড অসুখী এক মানুষ। শুধু অসুখীই নয়, সে একই সাথে হতাশ, অবহেলিত, অনাদরে ভোগা এক মানব। সে বেঁচে থাকার একটি, শুধুমাত্র একটি কারণ হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আর অবশেষে, সে সেটা পেয়েও যায়। সিনেমার গল্প এতটুকু শুনে আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন এটা ড্রামা জনরার সিনেমা। কিন্তু সিনেমার নির্মম দিক যা কিনা যেকোনো দর্শককে চমকানোর পাশাপাশি খানিকটা আবেগপ্রবণ করে তুলতে পারে, তা বড়ই জটিল।
সিনেমার এই অসুখী ব্যক্তি সিজার একটি বড়সড় অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার হিসেবে কর্মরত ছিল। অ্যাপার্টমেন্টের সকল ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলাকে সিজার নিজের মানসিক শান্তি পাবার উপায় হিসেবে বেছে নেয়। আর অ্যাপার্টমেন্টের মার্তা নামের এক অবিবাহিত তরুণী তার এই কুৎসিত মানসিকতার আসল শিকারে পরিণত হয়।
একজন মানুষ নিজের মানসিক প্রশান্তির জন্য অন্য একজনের উপর কী পরিমাণ অত্যাচার করতে পারে, তা এই সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। শুধু ধর্ষণ, হত্যা অথবা শারীরিক নির্যাতনই একটি নারীর জীবনকে তছনছ করে দেয়, এমন নয়। একজন মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকের ঠাণ্ডা মাথায় রচিত অমানবিক পরিকল্পনা একটি হাসিখুশি ও সুখী রমণীর জীবনে অন্ধকার ডেকে আনার গল্প নিয়েই মুভিটি নির্মিত হয়েছে।
মাত্র ১০২ মিনিট ব্যাপ্তিকালের এই মুভির সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, শেষের দৃশ্যটি। একটি থ্রিলারকে সার্থক করতে শেষে এক সেকেন্ডের জন্য হৃদস্পন্দন থামিয়ে দেওয়ার মতো একটি টুইস্ট থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও, এই সিনেমার ক্ষেত্রে তেমনটা ছিল না। সিনেমায় আগেই রোমহর্ষক পর্বটা দেখানো হয়ে গেলেও, শেষ দৃশ্যটা কয়েক মিনিটের জন্য দর্শককে বোবা করে রাখার জন্য যথেষ্ট। সিনেমাটি রটেন টমেটোস থেকে ৯৩% রেটিং প্রাপ্ত হয়েছে।
ফিচার ইমেজ-Pinterest