Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্যান্টম থ্রেড: এক অভিলাষী প্রেমগাথা

আবছা মোমের আলোয় একটি সোফাতে একজন রমণী বসে আছেন। চেহারাতে হালকা ক্লান্তি ও উদ্বেগের ছাপ থাকলেও তার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা মুচকি হাসি ও চোখের মণি থেকে ঠিকরে বের হওয়া দ্যুতির সামনে বাকি সবকিছু যেন নিতান্তই তুচ্ছ। রমণী তার সামনে বসা কোনো এক পুরুষ কণ্ঠের সাথে তৃতীয় কোনো এক ব্যক্তি সম্পর্কে নিজের অভিব্যক্তি মেলে ধরছেন। তার বাচনভঙ্গি, কথার ধরণ ও চেহারার ভাব থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা হয়ে যাবে যে, সেই তৃতীয় ব্যক্তিটি আর কেউ নন, বরং এই রমণীর নিজের প্রিয়তম মানুষটি। তার প্রেমময় কণ্ঠের আবেগকে সাধুবাদ জানাতেই যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছিল পিয়ানোর ঘোর লাগানো সুর।

– রেনল্ডস আমার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
– আর বিনিময়ে, আমি তাকে তা-ই দিয়েছি, যা তিনি সবথেকে বেশি চাইতেন।
– আর সেটা কী?
– আমার সমস্ত কিছু।
– তিনি ভীষণ অভিলাষী পুরুষ, তাই না? নিশ্চয়ই, তার সাথে পথচলাটা বেশ কষ্টসাধ্য।
– হ্যাঁ, হয়তো, তিনি এ পৃথিবীর সবথেকে অভিলাষী পুরুষ।

যে সিনেমার প্রারম্ভটা এমন মোহাচ্ছন্ন পরিবেশ ও মনকে ছুঁয়ে যাওয়া সংলাপের মধ্য দিয়ে হয়, সেই সিনেমার প্রতি দর্শকের আগ্রহ স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ারই কথা। আর সত্যি কথা বলতে কি, সিনেমার প্রথম দৃশ্যকে এমন আকর্ষণীয় করে নির্মাতা দর্শক মনে পুরো সিনেমা নিয়ে কৌতূহল জন্ম দেবার যে ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করেছেন, তা কিন্তু সেই দৃশ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়নি। সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্যে ও কাহিনীর ধারাবাহিকতায় তিনি এই সচেতন মনোভাব বজায় রেখে চলেছেন। আর তাই তো যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ শেষে, সমীকরণের ফলাফল মেলানোর পর সিনেমাটিকে একটি সার্থক সিনেমা হিসেবে গণ্য করা যাবে, নিঃসন্দেহে।

তারা একে অপরের প্রেমে খুঁজে পেয়েছিল জীবন রহস্যের সমাধান; Source: Goomba Stomp

উপরে এতক্ষণ যে সিনেমাটি নিয়ে কথা বলা হয়েছে, সেটি গত বছরে আলোড়ন তোলা সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। ‘ফ্যান্টম থ্রেড’ নামের এই সিনেমাটি আলোচনা আসার পেছনে যেসকল বিষয় প্রভাবক হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে, তার মধ্যে সিনেমাটির পরিচালক ও প্রধান অভিনেতার জুটি বেঁধে দ্বিতীয়বারের মতো কাজ করাটা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেয়ার উইল বি ব্লাড’ নামের ড্রামা জনরার ফিল্মটি যারা দেখেছেন, তারা খুব ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছেন, কেন এই সিনেমার কথা তোলা হচ্ছে। মূলত, এই সিনেমার পরিচালনার দায়িত্বভার যিনি বহন করেছিলেন, সেই পল টমাসই ‘ফ্যান্টম থ্রেড’ সিনেমার পরিচালনারও দায়িত্বে ছিলেন। আর সেই সিনেমার প্রধান চরিত্রে যে শিল্পী অভিনয় করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, ‘ফ্যান্টম থ্রেড’ সিনেমার মূল চরিত্রে অভিনয়কারী কিংবদন্তী অভিনেতা ড্যানিয়েল ডে-লুইস। তাছাড়া অস্কারে ছয়টি ও গোল্ডেন গ্লোবে দুটি মনোনয়নের অর্জন তো আছেই বটে।

সিনেমার কাহিনী নিয়ে আলোকপাত করার আগে সিনেমার টাইটেল নিয়ে অল্প একটু কথা বলে নেওয়াটাই শ্রেয়। কারণ সিনেমার রূপরেখা, চিত্রনাট্য, চিত্রায়ন, আবহসঙ্গীত, সংলাপ, ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি উপাদানগুলো একটি সিনেমার অভ্যন্তরীণ কারুকার্য সাধনে যতই তাৎপর্যই বহন করুক না কেন, সিনেমার যুতসই একটা টাইটেল না থাকলে সেগুলোর সৌন্দর্য ফ্যাকাসে হয়ে ওঠে। তাই সিনেমার টাইটেলকে অলংকাররূপে ব্যবহার সিনেমার প্রতি দর্শকদের আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলাটাও একটি মুখ্য বিষয়। আর সবথেকে মজার ব্যাপার হলো, এই সিনেমার বেলায় নির্মাতা আন্ডারসন অনেকটা তড়িঘড়ি করে ও প্রাথমিকভাবে সিনেমাটির টাইটেল ‘ফ্যান্টম থ্রেড’ রাখলেও, পরবর্তী সিনেমার গল্পের সাথে মিল রেখে এর থেকে মানানসই নাম আর খুঁজে না পাওয়াতে, এতেই থিতু হয়ে যান তিনি।

সিনেমাটি মুক্তি পাবার পর এক টিভি সাক্ষাতকারে আন্ডারসন নিজ মুখেই স্বীকার করেছিলেন, সিনেমার নামের পেছনে কোনো যৌক্তিক ও রহস্যময় তত্ত্ব নামটি রাখার সময় একফোঁটাও কাজ করেনি। তবে সময়ের সাথে সাথে সিনেমার কাহিনীর সাথে নামটি ওতপ্রোতভাবে মিলে যাওয়াতে, পরে আর পরিবর্তনের আদিখ্যেতাও করতে হয়নি। সিনেমার টাইটেলের সাথে কাহিনীর সেতুবন্ধনের গল্প না হয় পরে হবে, আগে কাহিনী সম্পর্কে একটু ধারণা নিয়ে আসা যাক।

এভেবেই এলমা রেনল্ডসের জগতে পুরোপুরি মিশে গিয়েছিল; Source: bolsamania.com

সময়টা ১৯৫৪ সাল। সে সময়ে গ্রেট ব্রিটেনের লন্ডন শহরে সামাজিকভাবে উঁচু শ্রেণী হিসেবে পরিচিত হয়ে আসা লোকজনের ভিড়ে রেনল্ডস উডকক নামের একজন সুদর্শন ও প্রভাবশালী ড্রেসমেকারের বসবাস ছিল। ‘উডকক হাউজ’ নামে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা হস্তনির্মিত জামা সেলাইয়ের জন্য দুনিয়া জুড়ে বেশ নামডাক ছিল উডকক পরিবারের। রেনল্ডস উডকক নিজের দূরদর্শী চিন্তাশক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে নিত্যনতুন নয়নাভিরাম সব নকশার জন্ম দিতেন আর সেগুলোকে নিজেদের হাতের শৈল্পিক ছোঁয়াতে বুনে চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর সব ড্রেসে রূপ দিতেন তার ড্রেস হাউজের কর্মচারীবৃন্দ।

উডকক হাউজ এর ব্যবসায়িক লেনাদেনা ও কাগজপত্রের দায়ভার পটু হাতে চালিয়ে যাচ্ছিলেন রেনল্ডসের সহোদরা সিরিল উডকক। এভাবেই উডকক হাউজ ব্রিটেনের ধনাঢ্য পরিবার থেকে শুরু করে বিশ্বব্যাপী রাজকীয় পরিসরেও নিজেদের ব্যবসাকে একচেটিয়া পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। অতঃপর একদিন রেনল্ডসের ক্ষুদ্র জীবনে বিশাল পরিবর্তন হিসেবে আগমন ঘটায় এক মায়াবিনী মানবী। আর তারপর সবকিছু নতুন দিকে মোড় নিয়ে একদম নতুন এক গল্পের রচনা করে।

‘ফ্যান্টম থ্রেড’ সিনেমাটি এমন এক গল্পের ঘনঘটা দিয়ে আবর্তিত হয়েছে যে, এর অন্তর্নিহিত বার্তা ও প্রতিপাদ্য সারমর্মকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে যেকোনো সাধারণ দর্শককে বেশ বেগ পেতে হবে। কেউ যদি একে একজন বয়স্ক অভিজাত পুরুষ ও একজন প্রাণবন্ত তরুণীর সাদামাটা ও বোধগম্য প্রেমকাহিনী বলে ধারণা করে সিনেমাটি দেখতে বসে যান , তাহলে তার সেই আশায় গুড়েবালি। সিনেমাটি যে প্রেম-ভালোবাসাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে সৃষ্টি হয়নি, তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এই প্রেম যেনতেন প্রেম নয়। এই প্রেমের পরিধি “আমরা একে অপরকে ছাড়া বাঁচবো না” সংলাপের বেড়াজালে আবদ্ধ অথবা প্রেমের করুণ পরিণতির মধ্য দিয়ে গল্পের সমাপ্তি টানা প্রেমকাহিনী নয়। এটি দুই ভিন্ন মেরুর বাসিন্দার নানা পারস্পারিক দ্বন্দ্ব, ঘাত-প্রতিঘাত, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও অহমিকার অগ্নিপরীক্ষা পেরিয়ে ‘অলীক সুতা’র বাঁধনে আটকা পড়ে যাওয়ার অলৌকিক এক প্রেমগাঁথা।
যে প্রেমগাঁথা শুধু “তার প্রেমেই তো খুঁজে পেয়েছি, জীবন রহস্যের সমাধান” সংলাপ ভাবার্থ বিশ্লেষণ করতে গেলেই লিখে ফেলা যাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, এমনকি আস্ত একটি উপন্যাস। আর তাই তো, এই সিনেমার গল্পে অতলে হারিয়ে যেতে হলে, শ্রবণ ও দর্শনেন্দ্রিয় ব্যতীত আত্মিক শক্তিরও সান্নিধ্যে যেতে হবে।

অতঃপর আমি তাহাকে পাইলাম; Source: thrillist.com

সিনেমার প্রধান চরিত্রগুলোর পরিচয় ও চিত্রনাট্যে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেকে অল্প বিস্তর তুলে ধরার পাশাপাশি সিনেমার কাহিনীকে আরও খানিকটা খন্ডন করলেই সিনেমাটি নিয়ে আরও পরিষ্কার মতবাদ পাবেন বলে আশা করি। তাহলে এবার সেই দিকেই নজর দেওয়া যাক।

‘ফ্যান্টম থ্রেড’ সিনেমার প্রধান দুটি চরিত্রের একটি হলো রেনল্ডস উডকক। রেনল্ডস উডকককে নিয়ে উপরে অল্প একটু বলা হয়েছে। সেই যুগের স্বনামধন্য ড্রেসমেকার রেনল্ডস উডককের কাছে তার ড্রেস শুধুই তার জীবিকা নির্বাহের মাধ্যমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কৈশোরে শখের বশে শুরু করা এই কাজটি, সময়ের সাথে তার পেশা ও নেশা দুটোতেই রূপান্তরিত হয়েছিল। তার কাছে তার প্রতিটা ড্রেস ছিল তার নিজের একেকটা শিল্পকর্ম, তার অহংকার।

ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে তিনি যে নিজের কর্মব্যস্ত দিনের শুরু করেন, সেই ছুটে চলার অবসান ঘটে নিস্তব্ধ মধ্য রাতে। তার দৈনন্দিন রুটিনে শুধু কাজ আর কাজ। তবে এতে তিনি কখনো হাঁপিয়ে ওঠেন না অথবা অবসাদ ও ক্লান্তি কখনো তাকে প্রতিরোধ করতে পারে না। এমনকি নিজেকে গর্বের সাথে ‘কারিগর’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসা রেনল্ডস সৃষ্টিশীলতার বিনিময়ে সংসার ধর্মের বলি দিতেও পিছপা হননি। এ নিয়ে অবশ্য তার বিন্দুমাত্র আক্ষেপও ছিল না। নিজের বোন সিরিলের সাহচর্যে ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে বেশ নির্ভেজাল দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি।

ব্যক্তি হিসেবে তিনি পরিস্থিতি বিশেষে কখনো আমুদে, কখনো গাম্ভীর্যপূর্ণ, কখনো অভিলাষী ও কখনোবা অবুঝ ছোট বালকের ন্যায় আচরণ করেন। তবে রেনল্ডস কয়েকটি ব্যাপার খুব কড়াকড়িভাবে প্রতিপালন করে চলতেন। অনুশাসন, নীতিবোধ, নিয়মানুবর্তিতা ও সময়ানুবর্তিতা- এই গুণগুলোকে নিজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এতটাই শক্তিশালীভাবে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন যে, এগুলোর কোনো একটা যে কারো দ্বারা ভঙ্গ হলে, নিজের ভেতর দমিয়ে রাখা সত্তাটি জেগে উঠে সামনে চলে আসতো।

রেনল্ডসের চোখে নিখুঁত এলমা; Source: vanityfair.fr

আর সিনেমার নায়িকা এলমার কথা তো বলতে গেলে যেন শেষ করাই মুশকিল। রেনল্ডস এলমাকে খুঁজে পেয়েছিলেন একটা রেস্টুরেন্টে, তা-ও কোনো বিলাসবহুল ভোজনের আসরের মধ্যমণি কোনো চোখ ধাঁধানো অপরূপার বেশে নয়, সামান্য এক রেস্টুরেন্টের কর্মীর বেশে। কিন্তু প্রথম দর্শনেই তাদের মন দেওয়া-নেওয়ার পালা যেন চুকে যায়। যে মানুষটা জীবনের তিন-চতুর্থাংশ সময় একাকী কাটিয়ে দিয়েছেন সম্পর্কের মায়াকে তুচ্ছজ্ঞান করে, সেই মানুষটা এলমা নামক মেয়েটির ভাঙা ভাঙা ইংলিশ ও চাকচিক্যহীন স্নিগ্ধতায় নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছিলেন। আর এলমাও সারাটা জীবন অতি সাধারণ একজন মেয়ে হিসেবে সবার অলক্ষ্যে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পর, এই প্রথম অন্য কারো চোখ দিয়ে নিজেকে দেখতে শুরু করেছিল।

এলমা রেনল্ডসের ছায়াতলে এসে নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করে। নিজেকে নিখুঁত রমণী রূপে নতুন পরিচয়ে মিশে যেতে শুরু করে। আর রেনল্ডসের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে নিজের সমস্ত কিছু তাকে উজাড় করে দেওয়ার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু ধীরে ধীরে, যখন সে ধ্যানজ্ঞান, সময়, পরিশ্রম থেকে শুরু করে দেহ-মন-আত্মা সবকিছু তিল তিল করে রেনল্ডসের সেবায় সঁপে দেবার পরেও, তাকে নিজের করে নিতে ব্যর্থ হয়, তখন সে ধারণ করে অন্য এক ভাবমূর্তি। এলমা এমন এক মানবী যাকে চরিত্রের প্রয়োজনে কখনো একদম সরল, কখনো অভিমানী, কখনো পাষাণ, এমনকি কখনো খানিকটা ছলনাময়ীও হতে দেখা যাবে। তবে সবদিক বিবেচনা করলে, এলমা ছিল এমন এক নারী যে মায়ার স্পর্শে আগলে রেখেছিল রেনল্ডস ও তার সৃষ্টিকর্মকে।

এই সিনেমাকে আরও সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতমভাবে নানা দৃশ্য, ঘটনা ও সংলাপের ভিত্তিতে মেলে ধরা সম্ভব হলেও, এতে করে পাঠকের সিনেমার প্রতি আগ্রহ কমে যেতে পারে বলে, এখানেই কাহিনী ও চরিত্র বিশ্লেষণের ইতি টানাটাই বাঞ্ছনীয়।

এলমা, তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? Source: YouTube

সিনেমাটি নিয়ে অভিমত প্রকাশের বাহুল্যতা যদি করতেই হয়, তাহলে বলতেই হয়, সিনেমাটিকে যেকোনো দর্শক দুভাবে রূপায়িত করতে পারেন। প্রথমটি হলো, সিনেমাটি অতিরঞ্জিত এক প্রেমকাহিনী, যাতে একজন বদরাগী লোক ও একজন কুচক্রী নারীর মধ্যকার নাটকীয় প্রেমকেই মূল বিষয়বস্তু হিসেবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এই শ্রেণীর দর্শকদের কাছে সিনেমাটি আকর্ষণীয় তো লাগবেই না, বরং তাদের সিনেমাটিকে অত্যন্ত ধীরগতিসম্পন্ন ও চিত্রনাট্যকে অতি সাধারণ বলে মনে হবে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর দর্শকদের ক্ষেত্রে, ‘ফ্যান্টম থ্রেড’ সিনেমাটি তাদের দেখা অন্যতম সেরা রোমান্টিক-ড্রামা জনরার সিনেমা হিসেবে স্থান পাবে। অনেকেই, সিনেমাটিকে শৈল্পিক চলচ্চিত্র হিসেবেও আখ্যায়িত করে থাকবেন। তারা সিনেমাটিতে কপালে নিচে থাকা দুটি চোখ ছাড়াও, আরও একটি চোখ দিয়ে উপলব্ধি করতে সার্থক হবেন। সিনেমাটির নান্দনিকতা তাদের হৃদয়কে শিহরিত করে তুলবে। তবে হ্যাঁ, দুই শ্রেণীর দর্শকের মতামতের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। কারণ, সিনেমা একটা হলেও, মানুষভেদে রুচির তারতম্য থাকার ফলে, এই সিনেমা সবার ভালো না-ও লাগতে পারে।

সিনেমাটি দেখবেন কী দেখবেন না, সেটা সম্পূর্ণ আপনার সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিলেও, কিছু কারণে সিনেমাটি মিস করা মোটেও উচিত নয় বলে মনে করি। একে তো রেনল্ডস চরিত্রে অভিনয়ের মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্র জগত থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন অভিনেতা ড্যানিয়েল ডে-লুইস। তার অমায়িক ও নন্দিত অভিনয়শৈলী শেষবারের মতো কোনো সিনেমাতে দেখার লোভ সামলাতে না পারলেও সিনেমাটি দেখা দরকার। ‘ফ্যান্টম থ্রেড’ সিনেমার একটি অনন্য সাধারণ দিক হলো, এর অভিনয়শিল্পীদের চরিত্রের সাথে একদম খাপে খাপে মিলে যাওয়ার দারুণ প্রচেষ্টা। শুধু ড্যানিয়েলই নন, এলমা চরিত্রে অভিনয়কারী ভিকিকে দেখলেও তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া সিরিল চরিত্রটিও সিনেমার গল্পে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই চরিত্রটি ঠিক এমন এক চরিত্র, যাকে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কেউ মনে না হলেও, তার অনুপস্থিতি সিনেমা করে তুলতে পারে অসম্পূর্ণ।

সিনেমার বাইরে সিনেমার তিন প্রধান চরিত্র; Source: My Blog

এছাড়া পল টম আন্ডারসনের সাথে এর আগে আরও তিনটি সিনেমাতে মিউজিক কম্পোজারের দায়িত্ব পালন করে আসা গ্রিন উডকক এই সিনেমাতেও দারুণ দারুণ সব আবহসঙ্গীতের আয়োজন করেছেন। সিনেমাটির সৌন্দর্যবর্ধনে এই আবহসঙ্গীত খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া পল টমাসের নিজের রচিত চিত্রনাট্যের হৃদয়স্পর্শী ও দার্শনিক ভাবাপন্ন সংলাপের জাদুকরী প্রভাব তো আছেই। এসবের পাশাপাশি সিনেমাতে ব্যবহৃত পোশাকগুলোর কথা না তুললেই নয়। পুরো সিনেমাতে মনোরম ও নজরকাড়া সব পোশাকের আনাগোনা বিদ্যমান ছিল।

‘ফ্যান্টম থ্রেড’ সিনেমাটি বক্স অফিসে তেমন ঝড় তুলতে না পারলেও, সিনে সমালোচক ও ক্লাসি শ্রেণীর দর্শকদের নজরে ঠিকই চিত্তাকর্ষক সিনেমার কাতারে স্থান করে নিয়েছে। রটেন টমেটোসে ২৭৬টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯১% রেটিং ও মেটাক্রিটিকে ৫১টি রিভিউয়ের ভিত্তিতে ৯০% রেটিং প্রাপ্তিই সিনেমাটির মানদণ্ড নির্ধারণ করা যেতে পারে। আর অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা পরিচালক, সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী, সেরা আবহসঙ্গীত, সেরা কস্টিউম ডিজাইন এই ছয়টি শাখায় মনোনয়ন ও কস্টিউমের জন্য পুরস্কার অর্জনের কৃতিত্ব তো আছেই। এছাড়া আরও অনেক মনোনয়ন ও পুরস্কার লাভের গৌরবও অর্জন করেছে সিনেমাটি।

এই সিনেমাটি চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সেরা রোমান্টিক সিনেমার তালিকায় থাকবে কিনা, সেটা নিয়ে হয়তো অনেকের কিঞ্চিৎ অথবা বড়সড় সন্দেহ থাকবে। তবে গত বছরের অন্যতম সেরা সিনেমা হিসেবে যে থাকবে তা তো চোখ বন্ধ করেই বলে ফেলা যাচ্ছে। তবে খুব পর্যবেক্ষণ করে যদি দেখেন, অভূতপূর্ব গোথিক রোমান্টিক জনরা হিসেবে গণ্য করা হলে, এটি কিন্তু সবমিলিয়ে আসলেই একটি মাস্টারপিস সিনেমা।

ফিচার ইমেজ : Venue Cymru

Related Articles