ছোট্ট মেয়ে তোত্তো-চান। প্রথম শ্রেণিতে থাকতেই তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে স্কুল থেকে। তার শিশুসুলভ দুষ্টুমিকে বাঁকা চোখে দেখেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। শিক্ষিকা তোত্তো-চানের মাকে বহিষ্কারের ব্যাপারে জানালেও মা তার ছোট্ট মেয়েটিকে বুঝতে দেয়নি তা। তাকে জানানো হয়নি তার বহিষ্কারের কথা। এমনই এক পরিস্থিতিতে তোত্তো তার মায়ের সাথে রওনা হয় এক নতুন স্কুলের উদ্দেশে। একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে মা স্কুলটিতে পৌঁছানোর পরই বুঝতে পেরেছিলেন, একেবারে সঠিক জায়গায় এসেছেন তিনি।
স্কুলের সামনে আসতেই তোত্তো-চান এমন কিছু একটা দেখে, যা তার স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল। তার সামনে দাঁড়ানো স্কুলের ফটকটি আদৌ কোনো ফটক ছিল না। ছিল দু’টি গাছের গুঁড়ি, যার গায়ে ঝোলানো ছিল স্কুলটির নাম ‘তোমোয়ে গাকুয়েন বিদ্যালয়’। আরেকটু এগোতেই তোত্তো-চান যা দেখল, তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ক্লাসরুমের বদলে সেখানে ছিল সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করানো রেলগাড়ির বগি। ছোট্ট তোত্তো তখনও জানত না, আরও অসাধারণ কিছু অপেক্ষা করছে সামনের দিনগুলোতে।
স্কুলটির হেডমাস্টার ছিলেন সোশাকু কোবায়শী মশায়। হেডমাস্টারের সাথে প্রথম দেখায়, তিনি তোত্তো-চানকে বলেছিলেন নিজের ব্যাপারে কিছু বলার জন্য, এক্ষেত্রে সে তার যা ইচ্ছা তাই নিয়ে কথা বলতে পারবে। তোত্তো-চান কথা বলতে খুবই ভালোবাসত এবং এভাবে কথা বলার সুযোগ তাকে কখনও দেওয়া হয়নি। তাই এই সুযোগটি সে হাতছাড়া করেনি। ফলস্বরূপ তাদের এই কথোপকথন স্থানী হয়েছিল চার ঘণ্টা! একজন বৃদ্ধ লোক চার ঘণ্টা ধরে ছোট্ট এক বাচ্চামেয়ের কথা শুনছে, এই ব্যাপার টা আমাদের কল্পনা করতে কষ্ট হলেও এমনটাই ঘটেছিল সেদিন। কোবায়শী মশায়ের এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দেখে তোত্তো-চান নিজেও অবাক হয়েছিল। সাথে সাথেই তার মনে জায়গা করে নিয়েছিল স্কুলটি।
স্কুলের হেডমাস্টার কোবায়শী মশায় ছিলেন এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সব শিশুই জন্মায় সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে, কিন্তু পরিবেশ আর বয়ষ্কদের প্রভাব তাদের স্বভাব নষ্ট করে দেয়। তার লক্ষ্য ছিল, শিশুরা যেন তাদের এই মানবিক সত্তাকে বিকশিত করে নিজস্বতা নিয়ে বড় হতে পারে। তাই তিনি এ স্কুলে এমনই এক পরিবেশ তৈরি করেন, যেখানে শিশুরা তাদের সহজাত প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে আলোকিত মানুষ হতে শিখবে। তোমোয়ে স্কুলটি বিভিন্ন দিক থেকেই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিল।
স্কুলটিতে একটি নির্দিষ্ট কারিকুলাম থাকলেও, শিশুদের ছিল নিজেদের পছন্দের বিষয় ও কার্যক্রম নির্বাচনের স্বাধীনতা। এখানে শিক্ষকদের ভূমিকা ছিল শুধুই পথ প্রদর্শকের, নির্দেশনা দানকারী হিসেবে নয়। গ্রন্থগত বিদ্যা শিক্ষার একটি অংশ হিসেবে কাজ করলেও শিশুরা বেড়ে উঠছিল প্রকৃতির সাথে নিয়মিত মিথস্ক্রিয়ায়। যেমন, দুপুরের টিফিনের সময় তারা শুধু খাবার খাওয়াই নয়, শিখত খাবারের গুনগত মান সম্পর্কেও। তাদের সময়টা শুধুই রেলগাড়ি ক্লাসরুমে আবদ্ধ থেকেই কাটত না। তারা প্রকৃতির মাঝে ঘুরে ঘুরে শিক্ষা নিত পারিপার্শ্বিক জীবনের।
সমসাময়িক স্কুলগুলো থেকে ভিন্ন নিয়মে চলত তোমোয়ে গাকুয়েন। কারণ সোশাকু কোবায়শী মশায় মনে করতেন, প্রচলিত শিক্ষা ব্যাবস্থা শিশুদের সহমর্মিতা, নিজস্বতা, মানবিকতাকে বলি দিয়ে তৈরি করে এক ছাঁচে বানানো কলের পুতুল। তিনি মনেপ্রাণে চাইতেন, অন্তসারশূন্য শিক্ষার কালো থাবা থেকে বাঁচিয়ে শিশুদের দেহ ও মনের যথার্থ সমন্বয় ঘটাতে, তাদের পরিপূর্ণ বিকশিত হওয়ার সুযোগ দিতে।
এমনই এক স্বপ্নময় স্কুলের গল্প ‘তোত্তো-চান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি’। বইটি জাপানি লেখিকা তেৎসুকো কুরোয়ানাগি রচিত স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ। লেখিকার ছয় বছর বয়সের স্কুলের চমৎকার সব স্মৃতি স্থান পেয়েছে এতে। গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হত কোদানশা পত্রিকার ‘ইয়ং ওম্যান’ নামক ম্যাগাজিনে (১৯৭৯-১৯৮০)। সেই গল্পগুলোকে সংকলিত করে ১৯৮১ সালে বইটি প্রকাশের পরই জায়গা করে নেয় জাপানি বেস্টসেলার বইয়ের তালিকায়। ১৯৮২ সালের ভেতরেই পাঁচ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয় এ বইয়ের। এত দ্রুত জাপানি সাহিত্যে পাকাপোক্ত আসন গড়ে নেওয়ায় এটি নজরে আসে পাশ্চাত্যেরও। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সালে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ডরথি ব্রিটন।
পরবর্তী সময়ে আরবি, ফরাসি, ইতালিয়ান, জার্মান, কোরিয়ান, সিনহালা ইত্যাদি ভাষাসহ এ বইয়ের অনুবাদ করা হয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের মুখ্য ভাষাগুলোতে, যার ভেতর আছে হিন্দি, বাংলা, গুজরাটি, তেলেগু, আসামি, কন্নড়, তামিল, মালায়াম এবং ওড়িয়া। বাঙালি পাঠকদের জ্ঞাতার্থে, এ বইয়ের বাংলা অনুবাদ রয়েছে দু’টি। একটি মৌসুমী ভৌমিক অনূদিত এবং চিহিরো ইবাসাকির ইলাস্ট্রেশন সংবলিত, অপরটি সাম্প্রতিক দুন্দুভি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত চৈতী রহমান অনূদিত। শেষোক্ত সংস্করণটি বর্তমানে বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকেই সংগ্রহ করতে পারবেন।
লেখিকার পরিচয়
তেৎসুকো কুরোয়ানাগি ১৯৩৩ সালে জাপানের টোকিওতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি টোকিওর সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ে অপেরা সঙ্গীত বিষয়ে লেখাপড়া করলেও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন অভিনয়শিল্পী ও উপস্থাপিকা হিসেবে। ১৯৭৫ সালে জাপানের ইতিহাসে প্রথম দৈনিক টকশো উপস্থাপনার দায়িত্ব নেন তিনি। এই টকশো’র কারণে জাপানের ঘরে ঘরে পরিচিত মুখ হয়ে উঠলেও তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ১৯৮১ সালে প্রকাশিত তার এই বইটি। শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ও তার প্রিয় মাস্টার মশায়কে উৎসর্গকৃত এই বইটি তাকে এনে দেয় বৈশ্বিক পরিচিতি। জাপানের মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেন এক প্রিয় ব্যক্তিত্ব। বর্তমানেও তিনি থেমে নেই। শিশুদের কল্যাণ মনোবাসনা নিয়ে কাজ করছেন ইউনিসেফের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে।
আড়ালে লুকোনো কষ্টগুলো
এই বইটিতে যে সময়ের গল্প বলা হয়েছে, তখন চতুর্দিকে বেজে চলেছিল যুদ্ধের দামামা। ছোট্ট তোত্তো-চান প্রথমদিকে এগুলো উপলব্ধি না করলেও ধীরে ধীরে তার জীবনেও পড়েছিল এর প্রভাব।
তোমোয়ে স্কুল স্থাপিত হয় ১৯৩৭ সালে। বহু বছর শিক্ষা নিয়ে গবেষণা ও দেশ-বিদেশে ঘুরে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর সোশাকু কোবায়শী এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। স্কুলের সাথে সাথে তিনি স্থাপন করেন ‘জাপান ইউরিদ্মিক্স সোসাইটি ‘। বহু মানুষ তাকে জাপানে ইউরিদমিক্সের প্রচারক ও গবেষক হিসেবে চিনলেও তোমোয়ে স্কুলের হাসিখুশি প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাকে চেনে খুব কম লোকেই।
তোমোয়ে স্কুল বোমার আগুনে পুড়ে যায় ১৯৪৫ সালে। কোবায়শী মশায় নিজের টাকায় স্কুলটি তৈরি করেছিলেন। যুদ্ধের পর এটি পুনর্নির্মাণের ইচ্ছা থাকলেও মৃত্যু তাকে সে সুযোগ দেয়নি। খুব অল্পদিন, অধরা স্বপ্নের মতোই যেন স্থায়ী হয়েছিল স্কুলটি।
আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি শিশুতোষ বই মনে হলেও আপনি যখন পাতা ওল্টানো শুরু করবেন, অন্যরকম এক জগৎ ধরা দেবে হাতের মুঠোয়। সেখানে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো যায়, পাখির মতো প্রাণোচ্ছল শিশুদেরকে আবদ্ধ থাকতে হয় না নিয়ম-নীতির বেড়াজালে। এটা এমন এক স্কুলের গল্প, যেখানে প্রতিটি শিশু যেত মনে আনন্দ আর বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে। স্কুলের কার্যক্রম ছিল তাদের কাছে সাত রাজার মণি-মাণিক্যের মতো। সেখানে পেটব্যথার অজুহাত দিয়ে কামাই দেওয়ার কথা কারো মনেই আসত না। প্রতিদিন তারা স্কুল শেষে বাড়ি ফিরত ঝুলিভর্তি অভিজ্ঞতা নিয়ে।
এখানে রাশভারি মাস্টারের ভয়ে মিথ্যা বলা শেখেনি কেউ। তারা শিখেছিল স্বপ্ন দেখতে, কল্পনার ডানা মেলতে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য হয়ে যেতে হয়, এমন জায়গা ছিল না তোমোয়ে গাকুয়েন, ছিল শিশুদের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠা এক স্বপ্নের দেশ। পাতায় পাতায় আনন্দ মাখা দুষ্টু তোত্তো-চানের মিষ্টি গল্পগুলো আপনাকে উপলব্ধি করাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনায় লুকিয়ে থাকা জীবনের গভীরতাগুলো। বইটি পড়ার পর আপনার মন হয়তো অজান্তেই আফসোস করে বলবে,
“ইশ! যদি আমিও তোমোয়ে গাকুয়েন ইশকুলে পড়তে পারতাম!”