পৃথিবীর জনপ্রিয়তম সুপারহিরোগুলোর মধ্যে সবসময়েই প্রথম সারিতে থাকে স্পাইডার-ম্যান। ডিসি কমিকসের পক্ষ থেকে দুর্দান্ত সব অ্যানিমেশন মুভি আসলেও এই প্রতিযোগিতায় মারভেল যেন কিছুটা পিছিয়েই ছিল। মারভেলের তুরুপের তাস এবং জনপ্রিয়তম সুপারহিরোর একজন স্পাইডার-ম্যান এর আগে বড় পর্দায় এসেছে ৮বার, রিবুট হয়েছে দুবার। মাত্র ছ’মাস আগেই অ্যাভেঞ্জারস: ইনফিনিটি ওয়ারে আমরা পেয়েছি টম হল্যান্ডের স্পাইডার-ম্যানকে। সুতরাং দর্শকদের একঘেয়েমি আসার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সকল সম্ভাবনাকেই উড়িয়ে দিলো স্পাইডার-ম্যান: ইনটু দ্য স্পাইডার-ভার্স। এর কাহিনী এতটাই অভিনব আর অসাধারণ যে, অনেকেই একে সেরা স্পাইডার-মুভি বলে আখ্যা দিয়ে দিয়েছেন।
মাইলস মোরালেস থাকে নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত শহর ব্রুকলিনে। সেই শহরকে বহুদিন ধরে আগলে রেখেছে স্পাইডার-ম্যান। প্রায় কেউই বলতে গেলে তার পরিচয় জানে না, পুলিশেরা তাকে কিছুটা বাঁকা চোখে দেখে। তারপরেও শহরজুড়ে তার জনপ্রিয়তার কোনো সীমা নেই। আর তা হবেই না বা কেন, এই ‘ফ্রেন্ডলি নেইবারহুড’ সুপারহিরো তো বরাবরই নিজের জীবন বাজি রেখে ভয়ানক সব ভিলেনকে পরাহত করে আসছে।
অর্ধেক আফ্রিকান-আমেরিকান, অর্ধেক পুয়ের্তোরিকান মাইলস নতুন স্কুলে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। ছোট্ট এক অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে অবধারিতভাবেই একটা রেডিও-অ্যাকটিভ মাকড়সার কামড় খায় সে। অদ্ভুত সব ক্ষমতার অধিকারী হবার পাশাপাশি ভারি অবাক হয় সে। আমাদের মতো সে-ও কমিক বইয়ের পাতায় পড়েছে স্পাইডার-ম্যানের কথা। কিন্তু তা-ই বলে নিজেই স্পাইডার-ম্যান হয়ে যাওয়াটা কি একটু বেশি বেশিই হয়ে যায় না!
রহস্যের সমাধানে দুরন্ত মাইলস একদিন মাটির নিচে দেখা পায় আসল স্পাইডার-ম্যানের। কমিক কিংবা পত্রিকার পাতায় দেখা চিরচেনা স্পাইডার-ম্যানকে চোখের সামনে ভিলেনদের সাথে লড়াই করতে দেখে সে। একইসাথে স্পাইডি সেন্সের মাধ্যমে আসল স্পাইডার-ম্যান টের পায় যে, মাইলসও আরেকজন স্পাইডার-ম্যান।
এদিকে শহরের প্রভাবশালী গডফাদার উইলসন ফিস্ক ওরফে কিংপিন নিজের স্বার্থে এক পোর্টাল খুলছে ব্রুকলিন শহরের তলায়। এতে যদি পুরো শহর কিংবা পুরো বিশ্বও গায়েব হয়ে যায়, তাতেও তার কিছু যায় আসবে না। নেটফ্লিক্সের মারভেল সিরিজ ‘ডেয়ারডেভিল’ এর কুখ্যাত ভিলেন কিংপিন এখানে আরো বেশি নৃশংস। ঐ পোর্টালের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন কিছু বাস্তব এবং পরাবাস্তব জগত থেকে অন্যান্য স্পাইডার-ম্যানেরা চলে আসে মাইলসের জগতে। সবাই মিলে এই ভিলেনদের মোকাবেলা করার পালা এবার। সেই সাথে নিজেদের জগতে ফিরে যাবার মিশনেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তারা।
‘অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান’ এর চরিত্র গুয়েন স্ট্যাসিকে এখানে দেখতে পাওয়া যাবে স্পাইডার-ওম্যান হিসেবে। লুনি টিউনসের বাগস বানি কিংবা টুইটি বার্ডের মতো কার্টুনগুলোর জগত থেকে এসেছে পিটার পোর্কার ওরফে স্পাইডার হ্যাম। স্পাইডার-নোয়া চরিত্রটি আবার ত্রিশের দশকের সাদা-কালো নয়্যার মুভিগুলোর চরিত্রের আদলে দেখানো হয়েছে। নাৎসিবিরোধী এই গোয়েন্দার চরিত্রে প্রচ্ছন্নভাবে হামফ্রে বোগার্ট অভিনীত চরিত্রগুলোর ছায়াও খুঁজে পাওয়া যায়। আর এতকিছু থাকলে জনপ্রিয় জাপানি অ্যানিমেশন তথা অ্যানিমের জগতই না বাদ যাবে কেন? ৩১৪৫ সালের পৃথিবী থেকে আসে অ্যানিমে/মাঙ্গা চরিত্র পেনি পার্কার। রেডিও অ্যাকটিভ মাকড়সার সাথে তার যোগাযোগ, ঠিক যেন ‘ঘোস্ট ইন দ্য শেল’ এর মতোই। হিরোদের পাশাপাশি ভিলেনদের সমারোহও ঘটেছে এখানে। কিংপিনের পাশাপাশি ভিলেন হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রাওলার, ডক্টর অক্টেভিয়াস, গ্রিন গবলিন, স্করপিয়ন এবং টুম্বস্টোনকে।
চলচ্চিত্র পরিচালক এবং কমিকের বিশাল ভক্ত কেভিন স্মিথ তার পডকাস্ট ফ্যাটম্যান বিয়োন্ডে বলেছেন,
আমি সবসময়েই স্পাইডার-ম্যানকে পছন্দ করতাম, কিন্তু এই মুভির কারণে ওকে ব্যাটম্যানের মতো পছন্দ করা আরম্ভ করেছি!
কমিক বই মুভির পর্দায় আনার ক্ষেত্রে পরিচালকের মূল চিন্তা থাকে মূলত দুটি বিষয়কে ঘিরে। প্রথমত, সেটা কমিক বই পড়ুয়া দর্শকদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, এবং দ্বিতীয়ত, সেটা কমিক বই সম্পর্কে একেবারেই না জানা দর্শকদের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কিন্তু লেখক ফিল লর্ড আর রডনি রথম্যান মিলে ইনটু দ্য স্পাইডার-ভার্সে এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ কাহিনী উপস্থাপন করেছেন যে, দুই ধরনের দর্শকই পরিতৃপ্ত হয়েছেন। টবি ম্যাগোয়ারকে দিয়ে স্পাইডার-ম্যানকে চেনা দর্শকদের জন্য ঐ ট্রিলজির কাহিনী হালকাভাবে দেখিয়েছেন, এদিকে কমিক ভক্তদের জন্য এখানে সেখানে ছড়িয়ে রেখেছেন অজস্র ইস্টার এগ। মজার সংলাপ এবং হাস্যরসাত্মক মুহূর্তগুলোর কারণে অতিপরিচিত স্পাইডার-ম্যানকেই আবার নতুন করে ভালো লেগে যাবে।
মূল চরিত্র টিনেজার মাইলস মোরালেসের কণ্ঠ দেয়া শামেইক মুর মনে করিয়ে দিয়েছেন ‘কোকো’র অ্যান্থনি গঞ্জালেসকে। মাইলসের ক্ষোভ, অভিমান কিংবা আশ্চর্য হয়ে যাবার মুহূর্তগুলো প্রাণ পেয়েছে তার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে। অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান টাইমলাইনের পিটার বি পার্কারের কণ্ঠ দিয়েছেন জেক জনসন। এই অ্যানিমেশনের যদি কখনো চলচ্চিত্রায়ন হয়, তবে এই চরিত্রে ‘অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান (২০১২)’ এর অ্যান্ড্রু গারফিল্ড ছাড়া আর কাউকে ভাবা যায় না। এছাড়াও এখানে ক্রিস পাইন, হেইলি স্টেইনফিল্ড, অস্কারজয়ী মাহেরশালা আলীসহ ভেটেরান অভিনেতা নিকোলাস কেজ, লিয়েভ শ্রাইবারসহ অনেকের কণ্ঠই শোনা যাবে।
বিভিন্ন ইউনিভার্সের অসংখ্য চরিত্রকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। অ্যানিমেশন, সংলাপ কিংবা কাহিনী, কোনোদিক দিয়েই কাজটা সহজ ছিল না। প্রত্যেক স্পাইডার-ম্যানেরই ক্যারেক্টারিস্টিক এবং অ্যানিমেশন স্টাইল ছিল স্বতন্ত্র। স্পাইডার-নোয়ায় লেগেছে বিস্তারিত টেক্সচার এবং শেডিং। সাধারণত অ্যানিমেশন মুভিগুলোর ফ্রেমরেট থাকে প্রতি সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেম। কিন্তু এখানে বিভিন্ন চরিত্রের ফ্রেমরেট ছিল বিভিন্ন। কিছু শটে মাইলসকে দ্রুতগামী দেখানোর জন্য এক ফ্রেমে, কিছু শটে ধীর দেখানোর জন্য দুই ফ্রেমে দেখানো হয়েছে। একপর্যায়ে ডক্টর ওক বনের মধ্যে পিটার বি পার্কার এবং মাইলসকে তাড়া করে। সেই দৃশ্যে পিটার পার্কারকে এক ফ্রেমে কিন্তু মাইলসকে দুই ফ্রেমে দেখানো হয়েছে। কারণ পিটার ছিল বেশি দ্রুতগামী।
স্পাইডারভার্সকে রিয়েলিস্টিক না বানিয়ে নিজের মতো কিছু বানাতে চেয়েছিলেন নির্মাতারা। ক্যারেক্টার অ্যানিমেশনের প্রধান জশ বেভারিজ বাস্তবকে অনুকরণ করতে চাননি, কার্টুনও বানাতে চাননি। ফলে বিভিন্ন টেকনিকের সংমিশ্রণে এটি একটি যুগান্তকারী মুভিতে পরিণত হয়েছে। এরকম অভিনব নজরকাড়া অ্যানিমেশন স্টাইল আগে কখনোই দেখা যায়নি।
মুভি নির্মাণের কিছু ফ্যাক্ট শুনলে আসলেই অবাক হয়ে যেতে হয়। একপর্যায়ে এসে ১৭৭ জন অ্যানিমেটর কাজ করছিলেন মুভিটিকে নিয়ে। বর্তমানের অন্যান্য অ্যানিমেশনে এর অর্ধেক মানুষ কাজ করে থাকেন। ১ সেকেন্ড ফুটেজ বানাতে সময় নিয়েছেন ১ সপ্তাহ, যেখানে সাধারণত ১ সপ্তাহে ৪ সেকেন্ড ফুটেজ বানানো যায়। ১ বছর শেষে তারা নিজেদের বানানো ফুটেজের মাত্র ১০ সেকেন্ড নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। মাইলসের রুমমেটের চোখ এড়ানোর জন্য যে দৃশ্যে সবাই ছাদে উঠে যায়, সেই দৃশ্যটি বানাতে সময় লেগেছে পাক্কা দুই মাস।
সাধারণত অ্যানিমেশন মুভিকে বাস্তব রূপ দেবার জন্য মোশন ব্লার টেকনিক ব্যবহার করা হয়। তবে এখানে মোশন স্মিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে। কিংবদন্তী জ্যাক কারবির উদ্ভাবিত ‘কারবি ক্র্যাকল’ স্টাইল ব্যবহার করা হয়েছে। পুরো মুভিকেই একটি চলমান কমিক বই বলা যায়। সহপ্রযোজক ফিল লর্ডস বলেছেন, মুভিটিকে যেকোনো অবস্থায় হঠাৎ করে থামালে হাতে আঁকা কমিক বইয়ের ইলাস্ট্রেশন বলে মনে হবে। কিছু কিছু দৃশ্যে কাহিনীর সাথে মিল রেখে সত্যিকারের কমিক বইয়ের পাতাও শটে চলে এসেছে।
কাহিনী এবং অ্যানিমেশনের পাশাপাশি এর সাউন্ডট্র্যাকও ছিল দুর্দান্ত। এর হিপহপ প্রধান সাউন্ডট্র্যাক দারুণভাবে মানিয়ে গেছে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ স্পাইডার-ম্যান মাইলস মোরালেসের সাথে। ‘সানফ্লাওয়ার’, ‘হোয়াট’স আপ ডেঞ্জার’, ‘সেভ দ্য ডে’ সহ সবগুলো গানই অসাধারণ অ্যানিমেশনটিকে আরো বেশি উপভোগ্য করে তুলেছে। মারভেল কিংবদন্তী স্ট্যান লি স্ক্রিনে ছিলেন একাধিকবার। থিমের সাথে মিলিয়ে বিভিন্ন দৃশ্যে মেটাফোরের ব্যবহারও করা হয়েছে। যেমন- মাইলসের ছাদ থেকে নিচে ঝাঁপ দেবার দৃশ্যে পরিচালক ক্যামেরাকে উল্টো করে ধরেছেন। এর মানে, সে নিচে পড়ছে না, বরং উপরে উঠছে।
দর্শক সমালোচক সবার মন জয় করে নেয়া মুভিটির এখন আইএমডিবি রেটিং ৮.৬/১০, রোটেন টমেটোসে ৯৭% ফ্রেশ।সুপারহিরোময় এই বছরের অন্যতম সেরা উপহারটি বিশ্বজুড়ে আয় করে নিয়েছে ৩৬১ মিলিয়ন ডলার। সেই ২০১২ সালের ‘র্যাঙ্গো’র পরে এই প্রথম ডিজনি/পিক্সারের বাইরের কোম্পানি হিসেবে সনিকে জিতিয়ে দিয়েছে সেরা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের অস্কার। এছাড়াও গোল্ডেন গ্লোব, ক্রিটিকস চয়েজ অ্যাওয়ার্ডসহ আরো ৫৫টি পুরস্কার জিতে নিয়েছে। শুধু অ্যানিমেশন জনরায় নয়, সুপারহিরো জনরাতেও একে অন্যতম প্রভাবশালী একটি মুভি হিসেবে মনে করা হচ্ছে। আফসোস একটাই, স্পাইডার-ম্যানের দুই জনক স্ট্যান লি আর জন ডিটকোর কেউই স্পাইডার-ম্যানের এই অসাধারণ উপস্থাপনাকে দেখতে পারলেন না।