পঞ্চপাণ্ডবের একজন জীবনানন্দ দাশ। বাংলা সাহিত্যের এক মহারথীর নাম। মূলত কবিতায় স্বতন্ত্র ধারা নিয়ে এসেছিলেন। তার কবিতায় অদ্ভুত এক মোহিত করার শক্তি ছিলো। প্রকৃতি কিংবা মানবমন তার লেখার অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছিলো।
তবে তিনি শুধু কবিতাই লেখেননি। লিখেছেন গোটা বিশেক উপন্যাস, প্রায় শতাধিক গল্প, প্রবন্ধ এবং ডায়েরি। তার জীবদ্দশায় এসব গল্প আশ্রয় পায় ঘরের কোণায় পড়ে থাকা এক ট্রাঙ্কে। কী ছিলো তার সেসব গল্পে?
জীবনানন্দ দাশের বিয়ের আগে প্রকাশিত হয়েছিলো কিছু কবিতা। এগুলো প্রকাশিত হয়েছে মূলত বুদ্ধদেব বসুর ‘প্রগতি’ পত্রিকায় এবং আধুনিক কবিতা প্রকাশের আরেক পত্রিকা ‘কালি কলম’-এ। বুদ্ধদেব বসু তার পাশে ছিলেন যখন তার দিকে তীরের মতো সমালোচনা আসতে থাকে। যখন বিশ্বের অন্যতম এক সাহিত্যিক এবং কবি তাকে রীতিমত হেয় করেন, সমালোচনা করেন, তখন এক বুদ্ধদেব বসু তার কবিতা লেখাকে করেন উৎসাহিত।
কিন্তু লাবণ্যের সাথে জীবনানন্দের বিয়ের পর বুদ্ধদেবের এই ‘প্রগতি’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় ‘কালি কলম’ পত্রিকাও। বেকায়দায় পড়ে যান আধুনিক যুগের প্রতিনিধিত্বকারী এই কবি। জীবনানন্দ তখন চিন্তা করলেন তিনি গল্প লিখবেন, লিখবেন উপন্যাসও। তার কাছে মনে হলো, জীবন তাকে নিয়ে যে খেলায় মেতে উঠেছে তা খোলাসা করার জন্য গল্প, উপন্যাসই চমৎকার পন্থা। আগ্রহের তাগিদেও তিনি এসব লেখার দিকে ঝুঁকতে পারেন হয়তো।
জীবন থেকে রেহাই পাননি তিনি। তাই তো তার গল্পগুলো তার প্রতিকূলতাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। জীবনের সংগ্রামের সামনে মোকাবিলা করার এটি হয়তো তার এক শৈল্পিক পন্থা। কিন্তু তার ‘জামরুল তলা’ গল্পের কিছু কথা আমাদের ভাবায় অন্যভাবে-
সারাদিন গল্পটা লিখতে গিয়ে গ্রন্থিমাংশের পুনরুক্তি এবং জীবনের জীর্ণশীর্ণ পুরনো বিষন্নতা ও মূল্যবোধের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে কোথাও চলে যেতে পারি তাহলে আমার কাজ হবে।
তাহলে কি বাস্তব জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি গল্প কিংবা উপন্যাসের কলম হাতে তুলে নিয়েছেন? হয়তো তা-ই। কেননা তার গল্প বা উপনাসের চরিত্ররা তো তার বাস্তব জীবনকেই তুলে ধরে। হয়তো সময়টাকে ছুড়ে দিতে চেয়েছেন এসব লেখায়। কিন্তু এর কোনোটাই প্রকাশ করতে চাননি তিনি।
এর অন্যতম কারণ হয়তো তার প্রচারবিমুখতা। আরও একটি বড় কারণ হতে পারে তার লেখার প্রতি অন্যদের ব্যাপক ধারালো তীর থেকে বাঁচা।
তার সেসময়কার গল্পের কয়েকটি দিক হলো- মূল চরিত্রের চাকরি নেই, সে নববিবাহিত, স্ত্রীর মনের সাথে তার মনের বিস্তর ফারাক। তিনি যে তার নিজের গল্প লিখছেন তার ইঙ্গিত রয়েছে তার লেখা ‘কুয়াশার ভিতর মৃত্যুর সময়’ গল্পে-
“বিনোদ নিজের জীবনের একটা গল্প লিখছে”
এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করা দরকার। জীবনানন্দ কিন্তু তার এসকল গল্পের শিরোনাম লিখে যাননি। শুধু গল্পগুলো লিখে গেছেন। এখানে প্রতীয়মান হয় তার না প্রকাশ করার ইচ্ছা।
জীবনানন্দের গল্পগুলোর আরেকটি দিক হচ্ছে তিনি তার বাস্তব ঘটনার সময়ের সাথে মিল রেখেই তার গল্পের বিষয়বস্তু নির্বাচন করেছেন। প্রথম দিককার গল্পে দেখা যায় তার চরিত্রের বিয়ে হচ্ছে। সেই ছেলে যাকে পছন্দ করে তার সাথে বিয়ে হয় না। বিয়ে হয় অপরিচিত এক মেয়ের সাথে। কিন্তু তার সেই প্রাণের মানুষটি ঠিকই লোকটির বিয়েতে উপস্থিত হয়।
জীবনানন্দ দাশ পছন্দ করতেন শোভনাকে। কিন্তু বিয়ে হয় লাবণ্যর সাথে। তার বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন তার প্রেয়সী শোভনা। প্রায় একই রকম কাহিনীকে উপজীব্য করে তার বিয়ের পরের এই সময়টাতে তিনি লিখেছেন আরও কয়েকটি গল্প। সেগুলো হলো- উপেক্ষার শীত, বিবাহিত জীবন কিংবা আকাঙ্ক্ষার কামনা বিলাস। এগুলোতে রয়েছে অদৃশ্য এক কাব্যের ধারাও।
এ তো গেলো মনের খোরাকের গল্প। এবার তিনি বেছে নিয়েছেন তার মুখের খোরাকের গল্পকে। তার চাকরি নেই, নেই টাকা-পয়সা। তিনি বিত্তশালী নন। বিয়ে করে বউকে খাওয়ানোর মতো কিছুই নেই তার কাছে। তার ‘বাসর রাত’ গল্পের চরিত্র প্রেমনীহারের স্ত্রী মনিকা স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছে-
নিজেরা কায়ক্লেশে যে সংসার চালাতে পারে না সেখানে একজন পরের মেয়েকে এনে যারা কষ্ট দেয় তারা কি সৎ?
তার নিজের জীবনের ফানুশটা বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হবার পর কেমন যেনো চুপসে যায়। তার ‘চাকরী নেই’ গল্পের উপজীব্যও প্রায় একই। এই গল্পের চরিত্রের ভাবনা যেন তারই ভাবনা। বিয়ের পর বেলুনটা চুপসে যাওয়া। তার কয়েকটি গল্পে নারী আর সংসার নিয়ে চলতে থাকে দ্বন্দ্ব। ‘বত্রিশ বছর পর’ গল্পে তিনি নারীবিমুখতার গল্প উপস্থাপন করেন। তবে এটি শুধুমাত্র মনের কল্পনামাত্র। পরে দেখবো তিনি নারীর পক্ষেও কথা বলেছেন। গল্পে রয়েছে বিয়ের পর সংসারের প্রতি তার উদাসীনতার চিত্র। একই চিত্র রয়েছে ‘আঘ্রাণের শীত’ গল্পেও।
তার গল্পে তিনি দেখান স্ত্রীর সাথে শারীরিক দূরত্বের গল্পও। ‘বাসর শয্যার পাশে’ কিংবা ‘প্রেমিক স্বামী’ গল্পে এই দূরত্ব দেখা যায়। পরিবারের অন্যতম দুই সদস্য স্বামী এবং স্ত্রীর দ্বন্দ্বের মাধ্যমে তার বিবাহিত জীবনের গল্পও হয়তো খানিকটা উঠে এসেছে। গভীর রাতে প্রেমের টান রেখে স্বামী ঘুরে বেড়ায় মাঠে। বিয়ের আগের দিনের মতোই দিন পার করে সে। যেন বিয়েটা তার কাছে ঘরহীন এক দরজার মতো। তার ‘অশ্বত্থের ডালে’ গল্পে এমন চিত্র দেখা গেছে।
এই পরিস্থিতিতে তার ডিভোর্সের দিকে ধাবিত হবার কথাও বর্ণনা করা হয়। ‘মাংসের ক্লান্তি’ গল্পের চরিত্রগুলো ডিভোর্স নেয়ার চিন্তা করে। কারণ তাদের বিবাহিত জীবন সুখের করা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। জীবনানন্দের স্ত্রী লাবণ্য যখন গর্ভবতী হয় তখন তার গল্পের স্ত্রী চরিত্রও গর্ভবতী হন। ‘মা হবার কোন সাধ’ গল্পে রয়েছে এর চিত্র। স্ত্রী গর্ভবতী হবার ফলে স্বামী নিজেকে অপরাধী ভাবেন। এ যেন নারীর প্রতি এক সহমর্মিতার চিত্র। এই গল্পের একটি লাইন এমন-
“বাচ্চাটাকে তার একটা বিজাতীয় টিউমারের মতো মনে হয়”
তার গল্পগুলোতে শুধু যে স্বামীর মনের অবসাদ রয়েছে এমনটা নয়। স্ত্রীর মনোবেদনাকে তিনি হেয় করে কিংবা দলিত করে রেখে দেন না। তার গল্পের স্বামীরা যে অবসাদে থাকেন তার অন্যতম কারণ তো স্ত্রীকে সুখে না রাখতে পারা। নিজের জীবনে লাবণ্য যেমন তার কাছে চিঠি লিখতো তার গল্পের নারীরাও স্বামীকে চিঠি লিখে। চিঠির ভাষা আর মনের কথা যেন একই ফ্রেমের উপাদান।
তার গল্পে প্রেমের চিত্র রেখে তিনি আবার ধ্যান দিয়েছেন তার চাকরি জীবনের হাহাকারের দিকে। তার চাকরি না পাওয়া আর কষ্টের জীবন অতিবাহিত করার চিত্র রয়েছে ‘নিরূপম যাত্রা’ গল্পে। গল্পের কয়েকটি কথা এমন,
বিপদ এ যে সামান্য দাড়ি কামাতে, একটা দেশলাই ব্যবহার করতেও যার সাহায্যের দরকার, সেই পয়সাই নাই। বয়স ত্রিশ বছর- আরো কুড়ি কি ত্রিশ বছর যদি সে বাঁচে তাহলে তিন টাকা সোয়া আনায় হয় না
জীবনানন্দ দাশ কি সাহিত্যিক দুনিয়া থেকে পাওয়া তিরস্কারগুলো তার গল্পে লিখেছেন? ধারণা করা হয়, তার কবিতা দিয়ে তিনি তৈরি করেছেন প্রতিবাদ। কিন্তু তার গল্পেও প্রায়ই উঠে আসতো কবি হবার যে অবসাদ যে অনাহারের লেশ, তার চিত্র। ‘আর্টের অত্যাচার’ গল্পে এমনটি দেখা গেছে। একজন কবি তার জীবনে কতই না বাধার সম্মুখীন হন। তার জীবন তাকে নিয়ে উদ্দাম খেলায় মেতে উঠে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মহান কবিদের চিত্রই যেন এগুলো। ফলে এসব গল্প তার নিজের জীবনের গণ্ডিতে না থেকে মহাকালের গণ্ডির ভেতর স্থান করে নেয়।
তার কাছে ধরা দিয়েছিলো আর্টিস্ট একজন প্রথাবিরোধী মানুষ। সমাজ কিংবা চলমান ধারা তাকে উপেক্ষা করেই যাবে। এটাই নিয়ম। তার লেখায় ভবিষ্যৎ উপস্থাপনের চমৎকার চিত্র থাকায় তিনি অনেক আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তাকে প্রচুর সমালোচনা করার পরেও লেখার রসদ পেয়েছিলেন কোত্থেকে? এ প্রশ্ন হাজার বছরের। বাংলা সাহিত্যের সৌভাগ্য যে, তার লেখাগুলো তিনি ছিঁড়ে ফেলেননি। লুকিয়ে রেখেছেন ট্রাঙ্কে। কারণ পরের সমাজের গল্প উপজীব্য করে লেখা এ গল্প পরের সমাজ হয়তো এগুলো গ্রহণ করতেও পারে।
কিন্তু জীবনানন্দের গল্পগুলো কালকে ছাপিয়ে গেছে। যেমন কালকে ছাপিয়ে গেছে তার কবিতাগুলো। তার গল্পগুলোও মহাকালের চিরায়ত ধারাকে উপস্থাপন করে। যেখানে একজন সৃষ্টিশীল মানুষের বঞ্চনার গল্প বিদ্যমান। এসব নিজের লেখায় নিয়ে এসে তিনি যেনো মহাকালের সেসকল আর্টিস্টদের একজন নেতা হয়ে উঠছেন যিনি তাদের হয়ে কথা বলবেন। ব্যক্ত করবেন মনের গহিনের বেদনাগুলো। বর্ণনা করবেন বাস্তব জীবনের সাথে তাদের বহমান দ্বন্দ্বকে।