ম্যান্ডালোরিয়ান, ওবি-ওয়ান কেনোবি, আহসোকার মতো জনপ্রিয়, ফ্যান ফেভারিট স্টার ওয়ার্স প্রজেক্টের ভিড়ে এক স্পিন-অফ সিনেমার স্পিন-অফ সিরিজ নিয়ে কে-ই বা এক্সাইটেড হবে? ২০১৬ সালের ‘Rogue One’ মুভির ক্যাসিয়ান অ্যান্ডরকে নিয়ে সিরিজ ঘোষণার পরে এমনটাই ছিল অনেকের চিন্তাভাবনা। কিন্তু স্টার ওয়ার্স থেকে পাওয়া এযাবৎকালের সবচেয়ে পরিণত এবং চিন্তা-উদ্দীপক গল্প এই ‘অ্যান্ডর’ থেকেই পাওয়া গেল। চোরাকারবারিতে লিপ্ত এক পেশাদার চোরের অতি ক্ষমতাধর গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগদান করার গল্প ‘অ্যান্ডর’।
বর্তমান ডিজনি-স্টার ওয়ার্সের ফ্যান সার্ভিস আর নস্টালজিয়ার উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার ট্রেন্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হেঁটেছে এই সিরিজ। ‘Rogue One’ যেরকম স্টার ওয়ার্সের ভেতরে থেকেও স্বাধীন একটি গল্প বলেছে, ঠিক সেরকমই অ্যান্ডরও এই ইউনিভার্সে থেকেও সম্পূর্ণ আত্মনির্ভর একটি সিরিজ। কোয়ালিটির দিক থেকেও অন্য সব স্টার ওয়ার্স কনটেন্ট থেকে একদমই অন্য এক লীগে এই শো।
ডিয়েগো লুনা, স্টেলান স্কার্সগার্ড, জেনেভিভ ও’রাইলি, অ্যান্ডি সার্কিস, অ্যাড্রিয়ানা এয়োর্না- কাস্টের প্রত্যেক অভিনেতার সে কী পারফর্মেন্স! সিনেম্যাটোগ্রাফি, সাউন্ডেরও কী অসাধারণ কাজ! এখানে নেই বিশাল বড় সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের বোঝা, নেই ইস্টার এগের সস্তা বিনোদন, অথবা ফ্যান্টাসি জনরার প্রচলিত অপূর্ণতা। একটা বড় ইউনিভার্সের সাথে যুক্ত থাকার সুবিধা নিতে গিয়ে একবারও কোয়ালিটিতে ছাড় দেননি শো রানার টনি গিলরয়।
আপনি যদি স্টার ওয়ার্স সম্পর্কে কিছুই না জেনে থাকেন, তারপরও উপভোগ করা সম্ভব সিরিজটি। স্টার ওয়ার্সের মতো বিশাল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের স্পিন-অফ মুভির স্পিন-অফ শো হওয়া সত্ত্বেও যে এতটা স্বাধীনতা বজায় রাখতে পেরেছে- ব্যাপারটা প্রশংসার দাবীদার।
সিরিজের শুরুতে আমরা ক্যাসিয়ান অ্যান্ডরের দেখা পাই স্বার্থসম্পন্ন চোরাকারবারির রূপে। গ্যালাক্টিক এম্পায়ার, রেবেলিয়ন, ফ্যাসিজম- এসব বৃহত্তর ব্যাপারস্যাপারে তার বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। গল্পের প্রোটাগনিস্টের এই চরিত্রায়নেই লুকিয়ে আছে সিরিজের প্রথম ব্রিলিয়্যান্স। ‘অ্যান্ডর’ তৈরি করার সময় টনি গিলরয়ের মূল লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী এক গল্প লেখা। ক্যাসিয়ানের মতো অখ্যাত, অতি সাধারণ একজন মানুষ কীভাবে রেবেলিয়নের গুপ্তচরে পরিণত হয় সেই গল্পের মূলে রয়েছে ফ্যাসিজমের প্রকৃতি ও স্বভাবচরিত্র। ফ্যাসিজম জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, সমাজের প্রতিটি অংশে কীভাবে ভয়াবহ প্রভাব ফেলে যার কারণে সবচেয়ে নগণ্য, গুরুত্বহীন এক চোর এম্পায়ারের বিরুদ্ধে রেবেলিয়নে যোগদান করে সেই বিশ্লেষণই ছিল ‘অ্যান্ডর’ সিজন ১-এর মূল বক্তব্য।
শুরুতে আমরা একবারও ক্যাসিয়ানকে এম্পায়ারের ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দও করতে দেখিনি। গ্যালাক্সির সবার মতো সে-ও গ্রহণ করে নিয়েছিল এম্পেরর প্যালপাটিনের শাসন। রাজনীতিতে নির্লিপ্ত এই চরিত্রকে এরকম প্রচন্ড রাজনৈতিক গল্পের মূল চরিত্র বানানো টনি গিলরয়ের চমৎকার একটি সিদ্ধান্ত ছিল।
স্টার ওয়ার্সের জগতে এরকম সিরিয়াস গল্প বলার জন্য সিরিজের টোন ঠিক করা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কাজটি সফলভাবে করা হয়েছে সিরিজের একদম প্রথম দৃশ্যেই। মোরলানার আঁধার গলিতে অ্যান্ডরের ঐ অ্যাকশন একইসাথে সিরিজের টোন এবং ক্যাসিয়ানের চরিত্র দুটোই সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এখানেই থেমে থাকেনি এই সাটল স্টোরিটেলিং। ক্যাসিয়ানের আরো কিছু সিদ্ধান্ত, সেনেটর মন মথমার নৈতিক উভয়সঙ্কট, লুথেন ও স গেরেরার মতাদর্শের বিতর্ক, এম্পায়ারের ভয়াবহতা, বিদ্রোহীদের অপারেশন- সব ক্ষেত্রেই এরকম সূক্ষ্ম ও কৌশলী স্টোরিটেলিং রয়েছে।
ফ্যাসিজমের প্রকৃতি নিয়ে দু’দিক থেকে এক্সপ্লোর করা হয়েছে সিরিজে। একদিকে আমরা দেখি অত্যাচারিত মানুষদের প্রতিরোধ, ঘুরে দাঁড়ানো; অন্যদিকে দেখি এম্পায়ারের অন্তর্গত কার্যকলাপ, ব্যবস্থাপনা। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের গল্প কোনোভাবেই নতুন না ফ্যান্টাসিতে, কিন্তু এই সিরিজে অরিজিনাল ট্রিলজিতে দেখা রেবেলিয়নকে যে পরিমাণ যত্নের সাথে তুলে ধরা হয়েছে এটা বেশ বিরল। স্টার ওয়ার্সের কোথাও, এমনকি মূল ট্রিলজিতেও রেবেলিয়নকে এতটা গভীরভাবে বা বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়নি।
বিদ্রোহের মূল্য বা স্যাক্রিফাইস নিয়ে স্টেলান স্কার্সগার্ডের এক মনোলগ রয়েছে ১০ম পর্বে, যা একদম তীরের মতো আঘাত করে হৃদয়ে। সিজন ফিনালেতে রয়েছে ফিয়োনা শ’-র আরেক মনোলগ ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে, যা শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাবে! তবে এই বড় স্পিচগুলো ঠিকভাবে কাজ করে এর পেছনে যত্নসহকারে প্লট পয়েন্টগুলো প্রতিষ্ঠা করার কারণে। এখানেই প্রচলিত বিদ্রোহের গল্পের চেয়ে অ্যান্ডরের বিদ্রোহের গল্প শ্রেয়। শুধুমাত্র বিগ স্পিচ, লাইটসেবার বা স্পেসশীপ ব্যাটলের বাইরে গিয়ে মানবিক, গ্রাউন্ডেড একটা আবহ তৈরি করা হয়েছে বিদ্রোহীদের গল্পে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বাস্তবতাকে বাস্তবিকভাবেই তুলে ধরা হয়েছে।
এম্পেরর প্যালপাটিন, ডার্থ ভেডারের নৃশংসতার জন্য এম্পায়ারকে যতটা ভয়ঙ্কর লেগেছিল তার চেয়েও কয়েকগুণ ভয়াবহ এক চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে এই সিরিজে। অ্যান্ডরে দেখানো এম্পায়ারের সবচেয়ে ভীতিকর দিক হচ্ছে আসলেই কার্যকর এই শাসন। সিরিজের অন্যতম ইন্টারেস্টিং দুই চরিত্র, এম্পায়ারের কর্মকর্তা ডেড্রা মিরো আর সিরিল কার্নের মধ্য দিয়ে আমরা এম্পায়ারের গঠনপ্রণালী ও ব্যবস্থাপনার একদম ভেতরে ঢুকতে পারি।
এম্পায়ারের আমলাতন্ত্রের উপর ফোকাস করাটা টনি গিলরয়ের খুবই স্মার্ট একটি সিদ্ধান্ত ছিল। ভয়াবহতা চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে দিয়ে গিলরয় এম্পায়ারকে যেকোনো কর্তৃপক্ষের মতোই কয়েক ভাগে ভাগ করেছেন। সকল ডিভিশনকে আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন সম্পূর্ণরূপে। পুলিশ ফোর্স, ইন্টেলিজেন্স অফিস, কোরাসন্টের পলিটিক্স, জেইল সিস্টেম- সবগুলো সেক্টরকে এতটা পূর্ণতা দেয়া হয়েছে যে মনেই হবে না দূর-দূরান্তের কোনো গ্যালাক্সির কাহিনী দেখছেন। এবং এখানেই এই এম্পায়ারের ভয়াবহতা বেড়ে যায়, কারণ এই এম্পায়ার অনেক বেশি বাস্তবসম্মত এবং আরও আতঙ্কের ব্যাপার, পরিচিত। সিথ লর্ডদের ডার্ক ম্যাজিক দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গ্যালাক্টিক এম্পায়ারের চেয়ে তাই সাধারণ, আমলাতান্ত্রিক এম্পায়ার অনেক বেশি ভয়ংকর। এই কারণেই সিরিজের ফ্যাসিজমবিরোধী মেসেজ এতটা প্রভাবশালী হয়েছে। দর্শকরা অতি সহজেই চিনতে পারবে এম্পায়ারের ফ্যাসিজমের প্রকৃতি, যার মাধ্যমে সিরিজের মেসেজও অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারবে।
একটা স্টার ওয়ার্স শো যখন ফ্যাসিজম, পাওয়ার, কন্ট্রোল, রেবেলিয়ন ইত্যাদি নিয়ে এত গভীরভাবে ভাবাতে পারবে তখন বুঝে নিতে হবে এখানে বিশেষ কিছু রয়েছে। ‘অ্যান্ডর’ সেই বিশেষ কিছু। আশির দশকে শুরু হওয়া জর্জ লুকাসের এই দূর-দূরান্তের গ্যালাক্সির সবচেয়ে পরিণত ও যুগোপযোগী অধ্যায় ‘অ্যান্ডর’।