নব্বইয়ের দশকের গল্প। মফঃস্বল এক শহর। প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই বললেই চলে। ল্যান্ডফোনের দেখাও মেলে কম। মা-বাবা এবং অপু, রুপু আর বিপু তিন ভাই। এই পাঁচজন নিয়ে ছোট্ট সংসার। একদিনের এক আচানক তুফান বদলে দিল সবার জীবন। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ইফতেখার উদ্দিন রুপু হয়ে উঠল অত্র এলাকার ভয়ঙ্কর মাস্তান। কোনো অনুতাপ বা আক্ষেপ নেই। অথবা আছে কে জানে? একজন মাস্তানের মনের খবর আর কে রাখে?
রুপু মাস্তান বলেই হয়তো কিংবা মানবিকতার খাতিরে মির্জাপুর শহরের কেউ তাকে ঘাটায় না। আর যদি কেউ ঘাটায়, তার পরিণতি মৃত্যু। খুন করা রুপুর কাছে এত সহজ যেন একটা পিঁপড়াকে মেরে ফেলছে কেউ। সমীহ করে চলে, সে এলাকার পাতি নেতা হোক, দোকানদার কিংবা কলেজের প্রিন্সিপাল। একদিকে কেউ বিপদে পড়লে যেমন রুপুর ডাক পড়ে, আবার কেউ কেউ তার কারণেই বিপদে পড়ে। কিন্তু রুপুর এলাকায় তাকে কেউ অসম্মান করতে পারে না, আবার তার কারণে অন্য কাউকেও অসম্মান করতে পারে না। রুপুকে সবাই ভয় করে, আবার শ্রদ্ধাও করে।
কেবল এই মির্জাপুর না, প্রায় পুরো দক্ষিণাঞ্চলের সবাই তাকে এক নামেই চেনে। রুপুর দুই হাত- শফিক আর মিলন। সার্বক্ষণিক সঙ্গী এরা রুপুর; চোরাচালান থেকে শুরু করে মানুষ খুন করা কিংবা গুম করা- সব কাজেই আছে এরা। আবার রুপুর আনন্দ শোভাযাত্রাতে জীবন বাঁচাতে এরাই এগিয়ে থাকে সবার আগে। রুপু এলাকার নামকরা ব্যক্তিত্ব জামাল খন্দকারকে মেনে চলে। তার নিয়ন্ত্রক তিনি। কিন্তু কে এই জামাল খন্দকার?
অনেক বছর আগে, স্কুল পাস করে কলেজে ভর্তি হবার পরে রুপুর পড়াশোনা খুব আগায়নি। ছোট ভাই বিপুও বখাটেদের কাতারে নাম লিখিয়েছে। কিন্তু তাদের বড় ভাই অপু, শহরে থাকে, পড়াশোনা করে। আরো সামনে এগোনোর ইচ্ছা। মির্জাপুরে সে কমই আসে। দুই ছেলে আর স্মৃতি নিয়ে রুপু-বিপুর মা পড়ে আছেন এই মির্জাপুরে। ‘মাস্তানের মা’ বলে পরিচিত হতে হচ্ছে তাকে, তবুও তিনি এখানেই আছেন।
শহরের নামকরা উকিল, সাজ্জাদ হোসেন। তার একমাত্র মেয়ে অনিন্দিতা অনি সদ্য কলেজে পা দিল, উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। হেনা আর নাসরিন তার দুই বান্ধবী। সবসময় একসাথে চলে। তারা আড্ডা দেয়, কলেজ শেষে কোনো দিন সিনেমা দেখে, বিরিয়ানি খায়। অনির স্বপ্ন ডাক্তার হওয়া। সাজ্জাদ হোসেন, স্ত্রী মারা যাবার পরে আর বিয়ে করেনি, মেয়েকে নিয়েই আছেন। মাঝে মাঝে প্রিয় বন্ধু জামাল খন্দকারের সাথে আড্ডা দেন। জামাল খন্দকার যদিও খুব কম আসেন এই শহরে।
বাবার চাকরির সুবাদে নতুন আসে নিবিড়। বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভালো না। নানা কারণে, পরিবারের নানা সমস্যাসহ অনেক কিছু মিলে বদলে যেতে থাকে তার জীবন। বখে যেতে থাকে। সঙ্গদোষে সিগারেট, গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ ধরে ফেলে; ঠিকমতো ক্লাস করে না আর। জাহাঙ্গীরের দলের সাথে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা জমায় ক্যান্টিনে। বাইকের পেছনে কোথায় না কোথায় চলে যায় কে জানে? জাহাঙ্গীর আজ নিবিড়ের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। রহস্যময় এই জাহাঙ্গীর কে?
এদিকে নিবিড় বাবার কাছে কখনও বকা খায়, মারও খায়। নেশার ঘোরে প্রিয় কাজ কবিতা লেখা কি সে ভুলে গেল? এদিকে প্রথম দিন থেকেই সে পছন্দ করা শুরু করে অনিকে। যদিও মেয়েদের অন্য চোখে দেখে রুপু। তবু এই প্রথম রুপুর চোখে ভালো লাগে অনিকে, অনিকে অদ্ভুত স্টাইলে সে প্রপোজও করে বসে। অনি কি সাড়া দেবে রুপুর ডাকে? রুপু না নিবিড়, কাকে পছন্দ করে অনি?
রুপুর কারণে শহরছাড়া আলম আর শাহান। রুপুর চিরশত্রু তারা। কেন? বহু বছর পর এই মির্জাপুরে। কিন্তু কেন আর কীভাবে পা রাখল তারা? শহরে ঢোকার অনুমতি কে দিল তাদের? আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে রুপুর চেনা জগত। বারকয়েক জীবনের উপর হামলা হলো। কে করছে এই কাজ? একেকটা ঘটনার পর সবার জীবন বদলে যেতে থাকল। ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন, কিন্তু কোথাও মিল আছে। কী আছে সেই বদলে যাওয়া জীবনে? ভালো না খারাপ কিছু?
নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেয়া, বেড়ে ওঠা মানুষের কাছে এই গল্পটা খুব চেনা লাগবে। কারণ রুপু, অনি, নিবিড় জাহাঙ্গীরের মতো মানুষেরা কোনো না কোনো বাস্তব চরিত্রের প্রতিফলক। গল্পের ছোট ছোট ঘটনাগুলো পড়ে মনে হয়েছে, লেখক সেই সময়টা দুই মলাটের মাঝে তুলে ধরেছেন।
রুপু কিন্তু খুব অচেনা কেউ নয়। নব্বইয়ের প্রতি শহরে এরকম চরিত্র ঠিকই ছিল। হয়তো এত বড় খুনী কিংবা মাস্তান না, তবে কেউ না কেউ ছিল। অনি নামের মেয়ে আর হেনা নাসরিন নামের এই সঙ্গীরা এত সাধারণ চরিত্র, বাংলাদেশের সব ছোট ছোট শহরে তাদের খুঁজে পাবেন। গল্প পড়ার সময় মনে হয়নি যে আমি একটা উপন্যাস পড়ছি, মনে হচ্ছিল নিজের চেনা কিছু গল্প আর শব্দ দেখছি চোখের সামনে। আবার নিবিড় নামের এই চরিত্র; বাবার চাকরির সুবাদে প্রতি বছর কত মানুষ এ শহর-সে শহরে যায়। বন্ধুর পাল্লায় পড়ে কত মানুষের জীবন এভাবে বদলে যায়। এত চরিত্রের একটা প্যাকেজ এই বই- ‘যেখানে রোদেরা ঘুমায়’।
শরীফুল হাসানের লেখা ‘সাম্ভালা’, ‘ছায়া সময়’, ‘ঋভু’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে গত কয়েক বছর ধরে। অন্য বইগুলো থেকে বেশ আলাদা ‘যেখানে রোদেরা ঘুমায়’, বাংলাদেশের একটা শহরের খুব সাধারণ আর চেনা ছবি। রুপুর চরিত্রে এত ভিন্নতা তিনি দেখিয়েছেন, ভিলেন হলেও যে কেউ তাকে ভালোবাসবেই। ছোট ছোট কিছু ঘটনা, যেমন- এখানে সেখানে কারো উপর হামলা, এটা বোধহয় আমরা সবাই দেখেছি। কারো নামে মিছিল, বাইক নিয়ে সাড়া শহরে আনন্দ করা এরকম। পুরনো বন্ধুত্বের গল্পগুলো এত নিখুঁতভাবে লেখক লিখেছেন, ছবির মতো সব দৃশ্য চোখে ভাসবে। অনি চরিত্রটি ভালো লেগেছে, তবে কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, মেয়েটা আরেকটু দৃঢ় হলেও হতে পারত, হয়তো। খুব নির্লিপ্ত লেগেছে তাকে কিছু কিছু সময়।
এদিকে নিবিড় চরিত্র একদিকে মূল চরিত্র না, কিন্তু কাহিনির প্রতি ক্ষেত্রে তার ভূমিকা আছে। অনেকে বলতে পারেন, ছোটখাট চরিত্র, কিন্তু না এরকম চরিত্র না থাকলে কোনো গল্প এগোত না।
এদিকে সাজ্জাদ বা জামাল হোসেনের চরিত্র রহস্যময়। তারা যে আসলে কার ভালো কিংবা খারাপ চান কেউ বোঝে না। অনেক সময় আমরা বুঝি না কে আমাদের বন্ধু, কে আমাদের শত্রু- এই উপন্যাসে লেখক সেটাও তুলে ধরেছেন। কে আমাদের খারাপ চায়, কে ভালো সেটা জানা বা বোঝা সম্ভব না হলেও আমাদের আসলে বোঝা উচিত। বন্ধুত্ব করতে হলে আসলেই অনেক কিছু মাথায় রাখা উচিত। কারণ আমরা জানি না যে আমাদের ভাগ্য কোনদিকে নিয়ে যাবে, কীভাবে বদলে দেবে জীবন। মানুষ চেনা দরকার আমাদের বেঁচে থাকতে হলে- এই কথা লেখক আমাদের আবার মনে করিয়ে দিলেন।
সব মিলে বাংলার, বাংলাদেশের যেকোনো ছোট কোনো এক শহরের একটা দশকের গল্প। মজার ব্যাপার হলো, সবাই এই গল্পের সাথে নিজেকে মেলাতে পাড়বে, কেউ চরিত্র হয়ে, কেউ দর্শক হয়ে। খলনায়কভিত্তিক এই উপন্যাসে খলনায়ক তো আমাদের ইফতেখার উদ্দিন রুপু। তাহলে এই গল্পে কোনো নায়ক কি আছে? যদি থাকে কে?
লেখক খুব সুন্দরভাবে একের পর এক প্লট সাজিয়েছেন। প্রতিটি চরিত্রকে মোটামুটি সমান প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে জাহাঙ্গীর চরিত্রকে যদি আরো কিছু সময় দেয়া যেত, আমার মনে হয় ভালো হত। শেষদিকটা এত সুন্দর করে লিখেছেন, মনে একটা অতৃপ্ত বাসনা রেখে শেষ করেছেন। মনে হচ্ছে, এখনও গল্পের অনেক কিছু জানার বাকি আছে। আসলেই কি তাই? কে জানে, কিছুটা আমাদের নিজের ও কল্পনা করে নিতে হয় বাস্তবতার খাতিরে।
আপনি যে দশকের মানুষ হন না কেন, এই বইয়ের প্রতিটা চরিত্র আপনার, আমার, আমাদের খুব চেনা। কারণ, জীবন থেকেই গল্প হয়। তাই নয় কি?