এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি অ্যামাজন সিইও জেফ বেজোস। ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সম্পদ নিয়ে মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের চেয়ে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি এগিয়ে তিনি। তারপরও এতদিন বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী কোম্পানির তালিকায় মাইক্রোসফটের পেছনেই ছিল অ্যামাজন।
তবে দৃশ্যপট পাল্টে গেছে গত সোমবার। মাইক্রোসফটকে টপকে বিশ্বের এক নম্বর কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে অ্যামাজন। স্টক মার্কেটে পরদিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার আরও এক দফা ১% বেড়েছে অ্যামাজনের মূল্যমান। তাই এখন মাইক্রোসফটের ৭৯০ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে অ্যামাজনের সম্পদের পরিমাণ ৮১০ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরে ইতিমধ্যেই ১০% বেড়ে গেছে অ্যামাজনের মূল্যমান, এবং কোম্পানিটির ১৬% মালিকানার সুবাদে প্রচুর লাভবান হয়েছেন বেজোসও। অ্যামাজন ছাড়াও তিনি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ব্লু অরিজিন এবং সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টেরও মালিক।
তবে এটুকু পড়েই যারা ভাবছেন জেফ বেজোসের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে, তারা অনেক বড় ভুল করছেন। অর্থনৈতিকভাবে তিনি যতই অভূতপূর্ব সাফল্যের দেখা পান না কেন, তার ব্যক্তিজীবনে এসেছে বিশাল বড় ঝড়। আর সেই ঝড়ের ঝাপটায় অদূর ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও।
হ্যাঁ পাঠক, ঠিকই ধরেছেন। বলছি জেফ বেজোসের বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারেই। দীর্ঘ ২৫ বছর তিনি বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন ম্যাকেনজি বেজোসের সাথে। কিন্তু গত বুধবার একটি যৌথ টুইটের মাধ্যমে তারা ঘোষণা দিয়েছেন, স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তাদের পথচলার এখানেই ইতি ঘটতে চলেছে। আর এর ফলে দ্বিখন্ডিত হয়ে যাবে জেফ বেজোসের সম্পদের পাহাড়। এতে তিনি নিজে যেমন হারাতে পারেন বিশ্বের সম্পদশালী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষস্থান, তেমনই ম্যাকেনজি বেজোসের সামনেও রয়েছে বিশ্বের শীর্ষ নারী ধনীতে পরিণত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। আর তাদের বিচ্ছেদের ফলে বড় ধরনের রদবদল আসতে পারে অ্যামাজনের অংশীদারিত্বেও।
কীভাবে ভাগ হবে সম্পদ?
প্রথমেই একটি কথা জানিয়ে রাখি, অ্যামাজনের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত ওয়াশিংটন স্টেটে। এবং এখানেই রয়েছে বেজোস পরিবারের একটি বাড়ি। ওয়াশিংটন স্টেটের অধিবাসীদের যাবতীয় সম্পদকে বিবেচনা করা হয় ‘কমিউনিটি প্রপার্টি’ হিসেবে। এর মানে হলো, যদি কোনো দম্পতি বিচ্ছেদের আবেদন করে, তাহলে তাদের যাবতীয় সম্পদ ও ঋণের বোঝা দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। বিদ্যমান আইন বলছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পদ ‘ন্যায্যভাবে’ ভাগ হবে, যদি না বিয়ের প্রাক্কালেই তারা ভিন্ন কোনো সমঝোতা করে থাকেন।
তবে সম্পদের ন্যায্য ভাগ মানেই যে ৫০-৫০ হিস্যা, তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আছে। এমনভাবে সম্পদ দু’ভাগে ভাগ করা হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে দুই পক্ষেরই অর্থনৈতিক অবস্থা অভিন্ন থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন, স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে একজন যদি বেশি বেতনের চাকরি করে থাকে এবং দশ বছরে অন্যজনের চেয়ে তার স্বাভাবিকভাবেই আয়কৃত অর্থের পরিমাণ বেশি থাকার নিশ্চয়তা থাকে, তাহলে সে বিদ্যমান সম্পদের কম অংশ লাভ করবে। আবার যার বর্তমান আয়ের পরিমাণ কম, সে বিদ্যমান সম্পদের বেশি পরিমাণ পাবে। এমন আইনের কারণ হলো, বিচ্ছেদের নির্দিষ্ট সময় পরও যেন স্বামী বা স্ত্রী যেকোনো একজনের অর্থনৈতিক অবস্থা ভঙ্গুর হয়ে না পড়ে।
তবে অনুমান করা হচ্ছে, বেজোস দম্পতির ক্ষেত্রে সম্পদের ন্যায্য ভাগ করার প্রয়োজন মনে করবে না আদালত। কারণ তারা এতটাই ধনাঢ্য যে, দশ বছর বাদে আর যা-ই হোক, কোনো একজনকে নিঃস্ব অবস্থায় উপনীত হতে হবে না। তাই খুব সম্ভবত আদালত ন্যায্য ভাগের পরিবর্তে, ১৩৭ বিলিয়ন ডলার স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে সমান দু’ভাগে ভাগ করে দেবে।
ফলাফল কী হবে?
সম্পদ ভাগ বাঁটোয়ারার ক্ষেত্রে দুটি সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমটি হলো, জেফ ও ম্যাকেনজি বেজোস দুজনই অ্যামাজন স্টক শেয়ার থেকে আনুমানিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার করে পাবেন। এর ফলে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির খেতাব হাতছাড়া হয়ে যাবে জেফ বেজোসের। এবং শীর্ষস্থানে ফিরে আসবেন বিল গেটস। অপরদিকে এক লাফে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী নারীতে পরিণত হবেন ৪৮ বছর বয়সী ঔপন্যাসিক ম্যাকেনজি বেজোস। এই মুহূর্তে শীর্ষস্থানটি রয়েছে ফ্র্যাঙ্কোইস বেটেনকোর্ট মায়ার্সের দখলে। তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৪৫.৬ বিলিয়ন ডলার।
অপর সম্ভাবনাটি হলো, জেফ ও ম্যাকেনজি বেজোসের স্টকটি একটি অভিন্ন একাউন্টে স্থানান্তর করা হবে, কিন্তু সেখানে সাবেক স্বামী ও স্ত্রী উভয়েরই যৌথ নিয়ন্ত্রণাধিকার থাকবে। সেক্ষেত্রে জেফ বেজোসের বিশ্বের সেরা ধনী ব্যক্তিত্বের সম্মান অক্ষুণ্ন থাকবে, অপরদিকে ম্যাকেনজি বেজোসের পক্ষেও এককভাবে বিশ্বের সেরা নারী ধনী হওয়া হবে না।
অ্যামাজনের ভবিষ্যৎ কী?
জেফ বেজোস শ্রেষ্ঠত্ব হারালেন কি না, কিংবা ম্যাকেনজি বেজোস শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করলেন কি না, এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি তা হলো: এই বিচ্ছেদের ফলে সামগ্রিকভাবে অ্যামাজন কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ জেফ বেজোসের হাত ফসকে বেরিয়ে গেল কি না।
ইতিপূর্বে এত বড় একটি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা দম্পতির বিচ্ছেদের ফলে মালিকানার অনিশ্চয়তা খুব বেশি দেখা যায়নি। অনুরূপ দৃষ্টান্তের দেখা পেতে গেলে আমাদের পেছন ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৯৯ সালে, যখন মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডকের বিচ্ছেদ হয়েছিল তার দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যানার সাথে। রুপার্ট মারডক অ্যানার সাথে সংসার করেছিলেন ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়, এবং ঐ সময়ের মাঝেই তিনি তিনি গড়ে তুলেছিলেন বিশাল মিডিয়া সাম্রাজ্য। তবে সেবারও বিচ্ছেদের ফলে তাকে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি, কেননা বিয়ের আগে থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মাঝে অর্থনৈতিক ব্যাপারে সমঝোতা হয়েই ছিল।
কিন্তু এখন পর্যন্ত যেহেতু জেফ ও ম্যাকেনজি বেজোসের মধ্যকার তেমন কোনো সমঝোতার ব্যাপারে শোনা যায়নি, তাই নিঃসন্দেহে তাদের জন্য অ্যামাজনের মালিকানাকে প্রভাবিত না করে বিচ্ছেদের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা সহজ ব্যাপার হবে না।
সাধারণত কোনো বড় কোম্পানির মালিককে এ ধরনের অসুবিধায় পড়তে হয় না। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা তাদের সবচেয়ে বেশি আয়ের উৎস যে ব্যবসাটি, সেটির গোড়াপত্তন করেন বিয়ের আগেই। তাই বিচ্ছেদ ঘটলেও, সেই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানটির শরিকানা তাদের হাতছাড়া হয় না। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকরা ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দ্বিখন্ডিত না করে, তাদের স্ত্রীর নামে অন্যান্য সম্পদ যেমন রিয়েল স্টেট, নগদ অর্থ প্রভৃতি লিখে দেন।
কিন্তু জেফ বেজোসের ক্ষেত্রে এই দুই উপায়ের কোনোটিই খোলা নেই। অ্যামাজনের সূচনা হয় ১৯৯৪ সালের ৫ জুলাই, আর ম্যাকেনজিকে তিনি বিয়ে করেন ১৯৯৩ সালে। সুতরাং ওয়াশিংটনের আইন অনুযায়ী অ্যামাজনের যাবতীয় সম্পদই তার ও ম্যাকেনজির কমিউনিটি প্রপার্টি। অপরদিকে জেফ বেজোসের স্থাবর সম্পদও তেমন নেই বললেই চলে। তার অধিকাংশ সম্পদই রয়েছে অ্যামাজনের স্টক হিসেবে। তাই ওখান থেকেই তার সম্পদ দ্বিখন্ডিত করতে হবে।
এর ফলে বিপাকে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে অ্যামাজনের। হতে পারে এখন অ্যামাজনের মাত্র ১৬% শরিকানা রয়েছে জেফ বেজোসের হাতে, কিন্তু কোম্পানিটির মূল নেতা তিনিই। তার হাত ধরেই এতদূর এসেছে কোম্পানিটি। এখন যদি অ্যামাজনে তার শরিকানা ১৬% থেকে ৮%-এ নেমে যায়, তাহলে আর সেখানে তার একক আধিপত্য থাকবে না। ফলে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারও তার একার হাতে আর থাকবে না। এর ফলে লম্বা দৌড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে অ্যামাজনকে।
তবে এখনই অ্যামাজনের ভবিষ্যতকে একেবারে অনিশ্চিত হিসেবে রায় দেয়ারও সময় বোধহয় আসেনি। দুটি উপায়ে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। প্রথমত, যদি অ্যামাজনের বাকি সকল অংশীদাররা মিলে সম্মতি প্রদান করে কোম্পানিটির গঠনগত পরিবর্তন আনতে, যাতে করে কোম্পানির ‘বৃহত্তর স্বার্থে’ শরিকানা কমে যাওয়ার পরও সর্বোচ্চ ক্ষমতা সিইও হিসেবে জেফ বেজোসের হাতেই থাকে। অপর উপায়টি হলো, যদি জেফ বেজোস ব্যক্তিগতভাবে তার সাবেক স্ত্রীর সাথে একটি সমঝোতায় আসেন যে, কোম্পানির ৮% শরিকানা ম্যাকেনজি নিজে বুঝে নিলেও, তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারটি তিনি তার সাবেক স্বামীর কাছেই রেখে দেবেন।
মানসিকভাবে কি ঠিক থাকবেন জেফ বেজোস?
অ্যামাজনের অংশীদারদের জন্য আরেকটি বড় চিন্তার বিষয় হতে পারে কোম্পানির সিইও’র বর্তমান মানসিক অবস্থা। যদি জেফ বেজোসের সম্পদ দ্বিখন্ডিত না-ও হয়, এবং কোম্পানির নিয়ন্ত্রণও তার হাতেই থাকে, তারপরও প্রশ্ন রয়েই যায়, ২৫ বছর ধরে যার সাথে ঘর করে এসেছেন, তার সাথে বিচ্ছেদের ফলে জেফ বেজোসের মনোজাগতিক স্থিতিশীলতা আদৌ বিদ্যমান থাকবে কি না।
অনেকের কাছেই এই বিষয়টিকে অবান্তর মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি এমনকি বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের জীবনেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেই স্ট্যানফোর্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক ডেভিড লারকার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন ২০১৩ সালে, যেখানে তিনি দেখান বৃহৎ প্রতিষ্ঠানসমূহের সিইও’র বিবাহ বিচ্ছেদ কীভাবে বাদবাকি অংশীদারদেরও প্রভাবিত করে।
বিচ্ছেদের ফলে সিইও’রা তো মানসিকভাবে ভেঙে পড়েনই, পাশাপাশি আইনি জটিলতায় তাদের সম্পদের পরিমাণও অনেক কমে যাওয়ায়, পরবর্তী সময়ে তারা বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে ভয় পান। ফলে ঐ প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি নিশ্চল হয়ে পড়ে। আর সেজন্য বাকি অংশীদাররাও নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে। সামগ্রিকভাবে ঐ প্রতিষ্ঠানের অবনমন শুরু হয়, এবং প্রতিযোগিতার বাজারে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কাও দেখা দেয়।
শেষ কথা
একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, অ্যামাজন আর দশটা প্রতিষ্ঠানের মতো নিছকই কোনো ‘সাধারণ প্রতিষ্ঠান’ নয়। এটি সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি সাম্রাজ্য, যার পতন এত সহজে হওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি জেফ বেজোসও আর দশজন সাধারণ সিইও’র মতো নন। তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা বলেই আজ বিশ্বের এক নম্বর ধনী। তাই জেফ বেজোসের ব্যক্তিজীবনে যে ঝড় এসেছে, তা তার পেশাদার জীবন ও অ্যামাজনকে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, এমনটিই পূর্বানুমান বিশেষজ্ঞদের।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/