করোনাভাইরাসের এই সংকটময় সময়ে চাকরি হারানোর পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন নাটোরের বড়াইগ্রামের এক নারী। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, চাকরি হারানোর হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করেন তিনি। এদিকে করোনা মহামারীর ভেতরই রাঙামাটিতে স্থানীয় এক ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উঠেছে ধর্ষণের অভিযোগ। ধর্ষণের শিকার নারীর অভিযোগ, তাকে চাকরি ও বিয়ের প্রলোভন দেখানো হয়েছিল।
খেয়াল করে দেখুন, উপরের দুটি ঘটনাতেই একটি মিল রয়েছে- চাকরি। এক নারী চাকরি হারিয়ে আত্মহত্যা করেছেন, আরেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে। এই দুটি কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। চলমান বিপর্যয়ের সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকারত্বের সম্মুখীন হচ্ছে, কিংবা অভাব-অনটন ঘোচাতে চাকরির সন্ধান করেও পাচ্ছে না। আর তাদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে নারী ভুক্তভোগীর সংখ্যাই বেশি।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। কিন্তু কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বরাবরই নারীরা অনেকটা পিছিয়ে ছিল পুরুষদের চেয়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬-১৭ সালে শ্রমশক্তির হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ১৩ লাখ, যার মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১০ লাখ আর নারী ৮ কোটি ৩ লাখ। মোট ৬ কোটি ৮ লাখ ২৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান থাকলেও, এর মধ্যে ৪ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার পুরুষের বিপরীতে নারীর কর্মসংস্থান ছিল মাত্র এক কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার। করোনাভাইরাসের প্রকোপে এই ব্যবধান আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ, করোনাভাইরাসের ফলে নারীদের সম্পৃক্ততা বেশি এমন খাতগুলোই বেশি ধাক্কা খেয়েছে।
বিবিএসের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক খাতে (সরকারি, ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক) কর্মসংস্থান ছিল ৯০ লাখ ৯৪ হাজার, যার মধ্যে পুরুষ ছিল ৭৫ লাখ ৬৯ হাজার আর নারী ১৫ লাখ ৫০ হাজার। অন্যদিকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে (বেসরকারি, ব্যক্তি কর্মসংস্থান ও শিল্প-কারখানায়) কর্মসংস্থান ছিল ৫ কোটি ১৭ লাখ, যার মধ্যে পুরুষ ছিল ৩ কোটি ৪৬ লাখ ১৩ হাজার আর নারী ছিল ১ কোটি ৭১ লাখ ২১ হাজার।
বাংলাদেশে নারীদের সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ ছিল পোশাক খাত, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ সেবা খাত, আবাসন ও কৃষিখাত এবং গৃহকর্মে। কিন্তু করোনা দুর্যোগের ফলে এই সকল খাতে কর্মরত নারীরাই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। চাকরি হারাচ্ছেন পুরুষরাও, কিন্তু তাদের জন্য এক চাকরি গেলে অন্য চাকরি খুঁজে নিয়ে বা পেশা পরিবর্তন করে টিকে থাকার যে সুযোগ রয়েছে, নারীদের জন্য তা নেই বললেই চলে। ফলে একবার চাকরি হারালেই পুরোপুরি আয়হীন হয়ে পড়ছেন অধিকাংশ নারী।
সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফই) দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা পরিস্থিতি শুরু হওয়ার পর ১৫,৯৬৫টি কারখানা বন্ধ হওয়ায় কাজ হারিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ শ্রমিক। বন্ধ হওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা ছিল ১,৯১৫টি। তৈরি পোশাক খাতে দেশে বর্তমানে ৪২ লাখ কর্মসংস্থান, যার ৮০ শতাংশই নারী। সুতরাং ধরে নেয়া যেতেই পারে, বন্ধ হয়ে যাওয়া পোশাক কারখানাগুলোর বেকার হওয়া শ্রমিকদেরও সিংহভাগ নারী। বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগও বলছে, করোনার কারণে সারা দেশের গার্মেন্ট কারখানা থেকে ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন, যার ৭০ শতাংশ নারী। এছাড়া যেসব কারখানা এখনো চালু রয়েছে, সেগুলোর অনেক শ্রমিকও দীর্ঘদিন ধরে অর্ধেক বা পূর্ণ বেতন বঞ্চিত রয়েছেন।
পোশাক খাতের পরই নারী শ্রমিকদের সবচেয়ে বড় কাজের জায়গা হলো বাসাবাড়িতে পরিচারিকা হিসেবে। এছাড়া ছোট ছোট হোটেল কিংবা রেস্তোরাঁতেও অনেক নারী শ্রমিক কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিল্স) হিসাব বলছে, দেশে গৃহশ্রমিক ২৫ লাখের বেশি। চার লাখের বেশি গৃহশ্রমিক শিশু, যার ৮৩ শতাংশ মেয়ে। করোনা সংকটের মধ্যে অনেক সামর্থ্যবান পরিবারই টাকা বাঁচাতে পরিচারিকা বা গৃহকর্মী ছেড়ে দিচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অনেক হোটেল, রেস্তোরাঁও। সুতরাং এই খাতগুলো থেকেও যে অনেক নারী বেকার হয়েছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়। যদিও ঠিক কী পরিমাণ নারীর ভাগ্যে এই দুর্দশা নেমে এসেছে, তার নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
আরেকটি বিষয়ও মাথায় রাখা জরুরি। করোনা সঙ্কটের মধ্যেও এখনো চাকরি বা কর্মক্ষেত্রে বহাল রয়েছেন, এমন অনেক নারীকেও ভবিষ্যতে স্বেচ্ছায় কাজ ছাড়তে হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংকটকাল যদি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে যেসব পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করেন, তাদের একজনকে পারিবারিক স্বার্থে চাকরি ছাড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীদের চাকরি ছাড়ার আশঙ্কাই বেশি। আয়ের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অসমতা এই সিদ্ধান্তে প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে।
এদিকে করোনাভাইরাসের প্রভাবে গত প্রায় চার মাস ধরে কার্যত দেশের নতুন-পুরোনো সব উদ্যোক্তাই ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। তবে এক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন নারীরাই। দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মোট উদ্যোক্তা রয়েছেন ৭৮ লাখ, যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশই নারী। কিন্তু করোনার ফলে ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এই নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৪০-৫০ শতাংশের।
নারী উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ কৃষিকাজের সাথে জড়িত। কিন্তু করোনার মধ্যে কৃষি পণ্য বিপণনে সীমাবদ্ধতার জন্য তাদের পক্ষে টিকে থাকা কষ্টকর হয়ে গেছে। তাছাড়া এই খাতটিতে নারীরা আবহমানকাল থেকেই বৈষম্যের শিকার। কৃষিতে যদি ১৯টি কাজ থেকে থাকে, তার ১৫-১৬টিই নারী করে থাকেন। কিন্তু তার কোনো অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা হয় না। এদিকে কৃষিজমির মালিকানার মধ্যে ৯৪ শতাংশই পুরুষের হাতে, মাত্র ৬ ভাগ নারীর হাতে।
কৃষিকাজেরই একটি শাখা হলো পশুপালন। এই খাতে নারীদের সম্পৃক্ততা ও লাভ তুলনামূলক বেশি থাকলেও, চলমান সময়ে এখান থেকেও খুব বেশি লাভের মুখ দেখছেন না তারা। একে তো ৫০ শতাংশ দুধ বিক্রি কমে গেছেই, পাশাপাশি নেই দুধ সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে প্রচুর দুধ।
এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের একটি বড় খাত হলো বিউটি পার্লার, যেখানে লাখ লাখ নারী কর্মরত ছিল। কিন্তু এই খাতটিও করোনার মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অল্প কিছু বিউটি পার্লার খোলা থাকলেও, তাদেরও ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে প্রসাধন সামগ্রীর উপর কর বৃদ্ধির ফলে। আরেকটি জায়গায় নারীরা আছেন, সেটি হলো ফ্যাশন ডিজাইন ও বুটিক হাউজ। কিন্তু করোনার কারণে এই খাতের সাথে জড়িত নারীরাও পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের দুটি বড় বাজার ধরতে পারেননি, পারবেন না ঈদুর আযহার বাজার ধরতেও।
এতসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়েও কিছু নারী উদ্যোক্তা অবশ্য তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন, তবে তাদের বেশিরভাগই ই-কমার্সের সাথে যুক্ত। উইমেন চেম্বার এন্ড কর্মাস ইন্ডাস্ট্রি লি: এর সভাপতি সংসদ সদস্য সেলিমা আহমেদের মতে, এই সময়ে সব নারীকেই বিশেষ সাহায্য করতে পারে ই-কমার্স। কিন্তু এখানে প্রধান সমস্যাটি হলো নারীদের তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষতার অভাব। গুটিকতক যারী, যারা তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ, তারা তো ঠিকই করোনার মধ্যেও ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছেন। কিন্তু তথ্য-প্রযুক্তিতে অদক্ষ সিংহভাগ নারী বেকার বসে রয়েছেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনগুলোও যদি নারীদের এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পেত, তাহলে হয়তো আরো বেশি নারী উদ্যোক্তা ই-কমার্সের মাধ্যমে টিকে থাকতে পারতেন।
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় চিন্তার বিষয় হয়ে এসেছে এ বছরের বাজেট। প্রতি বছর আলাদা জেন্ডার বাজেট হলেও, এ বছর তা হয়নি, এবং তা নিয়ে খুব একটা কথাবার্তাও হচ্ছে না। এমনকি নারী উন্নয়ন সহযোগী একশ কোটি টাকার থোক বরাদ্দও রাখা হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হবার আশায় যে নারীরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন, তারা এখন কী করবেন এ নিয়েও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অথচ এই দুঃসময়ে নারীদের জন্য থোক একশ কোটি টাকার বরাদ্দটা থাকলে, নারী উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে সেটার সদ্ব্যবহার করা যেত। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদের মতে, চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে বাজেটে বরাদ্দ জরুরি। তা না হলে করোনার পরেও নারীর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।
জেন্ডার বাজেট বাদ দিলেও, সরকার অবশ্য করোনাকালে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যা ব্যাংকের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। এক্ষেত্রেও বেশ কিছু ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে। অনেক ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানেরই হয়তো ব্যাংক লেনদেনে নির্ভরতা রয়েছে, কিন্তু এমন অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যারা ব্যাংক লেনদেনে যুক্ত নয়। নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে যুক্ত না থাকার পরিমাণ হয়তো আরো বেশি। সেক্ষেত্রে প্রণোদনা তাদের কাছে কীভাবে পৌঁছোবে? নাকি তারা প্রণোদনা প্রাপ্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন? তাছাড়া, ৪ শতাংশ সুদে ঋণ কি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বেশি হয়ে যায় না? অনেক বিশেষজ্ঞেরই অভিমত, ঋণের ক্ষেত্রে এত বেশি সুদ দিয়ে নারী উদ্যোক্তা তথা এসএমইকে তুলে আনা যাবে না। ফলের সুদের হার কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
ইতোমধ্যেই গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির বিষয়টি, এবং বরাবরের মতোই, এক্ষেত্রে নারী ও শিশুরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। নারীদের এ ধরনের সহিংসতার শিকার বেশি হওয়ার কারণ তাদের অর্থনৈতিক পরনির্ভরশীলতা। নারীরা যদি স্বাবলম্বী হয় এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসে, তাহলে তাদের উপর নির্যাতনের পরিমাণও কমে যায়। কিন্তু করোনাকালে তারা পূর্বাপেক্ষা বেশি নির্যাতিত তো হচ্ছেনই, এবং এভাবে যদি স্বাবলম্বী নারীরাও কাজ হারিয়ে বেকার হতে থাকেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে নারী নির্যাতনের হারও নিঃসন্দেহে অনেক বেড়ে যাবে। তাই সরকার থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সর্বমহলকে এখন থেকেই সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ নিতে হবে নারীদের কর্মহীনতা ও বেকারত্ব রোধের ব্যাপারে। নইলে করোনা-পরবর্তী সময়েও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অনুযায়ী দেশে নারী-পুরুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে না।