দেখতে দেখতে শেষ হয়ে আসছে আরো একটি বছর। প্রতিটি বছরের শেষেই গেলো বছরের নানাবিধ হিসাবনিকাশ নিয়ে হাজির হয় নানা সংবাদমাধ্যম, যা আমাদেরকে পরিচিত সবকিছু নতুন রুপে দেখতে শেখায়, নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বস তেমনই এক কাজ করেছে। ফোর্বস এশিয়ার নভেম্বর ২০১৮ সংখ্যায় এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে জনসেবামূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত ৪০ জন ব্যক্তিকে নিয়ে চমৎকার একটি ফিচার করা হয়েছে, যা পড়লে অবাক না হয়ে পারা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল বলতে পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়া অঞ্চলকে বোঝানো হয়ে থাকে।
রোর বাংলার পাঠকদের জন্য কয়েকটি পর্বে মানবসেবায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যাওয়া সেই মানুষগুলো সম্পর্কেই আলোকপাত করা হবে।
অস্ট্রেলিয়া
পামেলা গ্যালি (কো-ফাউন্ডার – গ্যালি এস্টেট ওয়াইনারি)
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পামেলা গ্যালি ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্নের মেডিকেল বায়োলজিতে প্রফেসরিয়াল চেয়ারের জন্য ৩.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেছিলেন। তবে মেলবোর্নের বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সেটাই কিন্তু গ্যালির প্রথম দানকার্য ছিলো না। ২০১২ এবং ২০১৩ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহেও তিনি মেলানোমা নিয়ে গবেষণা, ওষুধ তৈরি এবং রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য অর্থ দান করেছিলেন।
প্রোপার্টি ডেভেলপার স্বামী লরেঞ্জোর সাথে মিলে পামেলা গ্যালি গড়ে তুলেছিলেন তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গ্যালি এস্টেট ওয়াইনারি।
অ্যান্থনি প্র্যাট
(গ্লোবাল চেয়ারম্যান – প্র্যাট/ভিসি ইন্ডাস্ট্রিজ)
অ্যান্থনি প্র্যাট গত বছরের আগস্ট মাসে প্রতিজ্ঞা করেন, জীবনের বাকি দিনগুলো মিলিয়ে তিনি অন্তত ৭০০ মিলিয়ন ডলার দান করে যাবেন, যার মাঝে অন্তর্ভুক্ত ছিলো চিকিৎসা ও শিল্পকলার মতো খাতও। ১৯৭৮ সালে তার বাবা রিচার্ড এবং মা জিয়ানের হাতে গড়ে উঠেছিলো তাদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান প্র্যাট ফাউন্ডেশন, যা এখন পর্যন্ত ১৭৫ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ দান করেছে। তার দাদার প্রতিষ্ঠিত বক্স তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘ভিসি’কে তিনি নিজ গুণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্যাকেজিং ও রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন।
আইজ্যাক ওয়াকিল (প্রোপার্টি ইনভেস্টর)
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্পকলা এবং ইহুদিদের উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা কাজে স্ত্রী সুসানকে সাথে নিয়ে আইজ্যাক ওয়াকিল ৫০ মিলিয়ন ডলার দান করেছেন। গার্মেন্ট ব্যবসা থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে সিডনির অনেকগুলো পুরাতন ভবন কিনে নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীতে সেগুলোর মাঝে যেগুলোর অবস্থা একটু বেশিই খারাপ, সেগুলো ২০১৪ সালে বিক্রি করে দেন তার ফাউন্ডেশনের কার্যকলাপ পরিচালনার জন্য। তার দানের মাঝে রয়েছে ২০১৭ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসের আর্ট গ্যালারিতে ১৪ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৬ সালে ইউনিভার্সিটি অফ সিডনিকে সুসান ওয়াকিল হেলথ বিল্ডিংয়ের জন্য দেয়া ২৫ মিলিয়ন ডলার, যা চালু হতে যাচ্ছে আগামী বছর থেকে।
চীন
চাই ডংকিং (ফাউন্ডার, চেয়ারম্যান, আলফা গ্রুপ), চাই জিয়াওডং (সিইও/ভাইস চেয়ারম্যান, আলফা গ্রুপ) এবং চাই লিডং (জিএম/সাবেক জিএম, আলফা গ্রুপ)
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে তিন ভাই মিলে ১৪ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন তাদের শহর শান্তৌয়ের একটি পুরনো শিল্পাঞ্চলকে সংস্কার করে নাগরিকদের জন্য পার্ক নির্মাণের উদ্দেশ্যে। প্রায় ৬০ হাজার বর্গ মিটার আকারের বৃহদাকার এ পার্কটি আগামী বছরের শুরুর দিকেই চালু হবার কথা।
চেন ফাশু
(চেয়ারম্যান, নিউ হুয়াডু ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপ/বাইয়াও হোল্ডিংস)
হার্বাল মেডিসিন ফার্ম বাইয়াও এর প্রধান চেন তার ফাশু ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এ বছরের এপ্রিল মাসে পিকিং ইউনিভার্সিটিতে ৭২ মিলিয়ন অর্থ দান করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির ইমেরিটাস ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনরত এ মানুষটি সেখানে স্বাস্থ্যখাতের নানা গবেষণা এবং মেধাবী অন্বেষণের দিকটি দেখভাল করছেন। শুধু তা-ই নয়, এই এপ্রিলেই তিনি নিজ শহরের রাস্তাঘাটের উন্নয়নকল্পে ১.৫ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন। এছাড়াও, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মিনজিয়াং ইউনিভার্সিটিতেও গিয়েছিল তার অনুদানের অর্থ, অঙ্কটা ২৯ মিলিয়ন ডলারের!
ড্যাং ইয়ানবাও
(ফাউন্ডার ও চেয়ারম্যান, বাওফেং এনার্জি গ্রুপ)
স্ত্রী বিয়ান হাইয়ানকে সাথে নিয়ে এ বছর ইয়ানবাও চ্যারিটি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এই দম্পতি নিংজিয়া প্রদেশের স্বল্পোন্নত এলাকাগুলো থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য ৪২ মিলিয়ন ডলার অর্থ দান করেছেন। ২০১১ সালে যাত্রা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ২৩৮ মিলিয়ন অর্থ দান করে শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে ১,৭০,০০০ এরও বেশি শিক্ষার্থীকে।
অউ জংরং
(ফাউন্ডার ও চেয়ারম্যান, ঝেনরো গ্রুপ)
২০১৭ সালের আগস্টে তাদের পারিবারিক ব্যবসা থেকে ৩ মিলিয়ন ডলার দান করেন অউ, উদ্দেশ্য ছিলো তার নিজ শহর পুতিয়ানে একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা। গত বছরই আরো বেশ কয়েকজনের সাথে তিনি নিজে ঝেনরো ফাউন্ডেশনে ২ মিলিয়ন ডলারের অধিক দান করেছেন। ২০১৩ সালে থেকে ফাউন্ডেশনটি হ্যালো, নেইবারের মতো নানাবিধ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছে, যেগুলোর মাধ্যমে নানাবিধ উৎসব আয়োজন, ছোটদের বইয়ের ক্লাবসহ নানা রকম সামাজিক কাজকর্ম করে থাকেন তারা।
এছাড়া হলি ল্যান্ড নামের প্রোগ্রামের মাধ্যমে গ্রামের অধিবাসীদের সবুজ শাকসবজি উৎপাদন ও স্থানীয় সংস্কৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করেন তারা। বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তরাও তাদের সহায়তার আওতাভুক্ত।
ঝ্যাং জিয়ানবেন
(ফাউন্ডার ও চেয়ারম্যান, উইনফাস্ট হোল্ডিং)
নিজের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ২৯ মিলিয়ন এবং নিজের পকেট থেকে ১১৭ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ২০১৭ সালে ঝ্যাংয়ের উদ্যোগে যাত্রা শুরু করে উইনফাস্ট চ্যারিটি ফাউন্ডেশন। নানজিংয়ের আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা বিভিন্ন বৃত্তি প্রদানের কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যাদের মূল লক্ষ্য পশ্চিম চীন ও অন্যান্য স্বল্পোন্নত এলাকা থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীদের সহায়তায় করা। এছাড়া স্থানীয় সাতটি হাসপাতালে অর্থাভাবে থাকা ব্যক্তিদের চিকিৎসা সেবাদানের বিষয়টিও দেখছে উইনফাস্ট চ্যারিটি।
ঝ্যাং লেই
(ফাউন্ডার ও সিইও, হিলহাউজ ক্যাপিটাল গ্রুপ)
রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন ঝ্যাং। তাই গত বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা কাজের উন্নয়ন ও একে বিশ্বমানের করে তোলার লক্ষ্যে ৪৪ মিলিয়ন ডলার দান করেন তিনি। একই বছর ১৫ মিলিয়ন ডলার তিনি দান করেন ওয়েস্টলেক ইউনিভার্সিটিতে।
ইয়েল থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করা ঝ্যাং ২০১০ সালে ইয়েলের স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টে ৮.৮ মিলিয়ন ডলার দান করেন। স্কুলটির ইতিহাসে দানের দিক থেকে এটিই এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।
ইয়েউং ক্বোক কিউং
(ফাউন্ডার ও চেয়ারম্যান, কান্ট্রি গার্ডেন) ও ইয়াং হুইয়ান (ভাইস চেয়ারম্যান, কান্ট্রি গার্ডেন)
এ বছরের অক্টোবর মাসে এই রিয়েল এস্টেট টাইকুন এবং তার মেয়ে মিলে তাদের গুওকিয়াং পাবলিক ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সিংহুয়া ইউনিভার্সিটিতে আগামী এক দশক ধরে ৩১৭ মিলিয়ন ডলার দানের অঙ্গীকার করেছেন। এর আগে কখনোই কোনো চীনা বিশ্ববিদ্যালয় এত বিশাল পরিমাণ অর্থ দান হিসেবে পায়নি। এর মূল লক্ষ্য বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতাসহ মেধাবী শিক্ষার্থী অন্বেষণ। গত বছর তারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ মিলিয়ন ডলার দান করেছিলেন রসায়ন বিভাগের একটি নতুন ভবন তৈরি করে দেয়ার জন্য।
২০১৪ সালে তাদের সহায়তায় যাত্রা শুরু করে গুয়াংডং কান্ট্রি গার্ডেন পলিটেকনিক কলেজ। শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণ বিনা খরচে এখানে পড়াশোনা করে থাকে। প্রতি বছর এখানেও তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ দান করে যাচ্ছেন।