প্রাচীনকাল থেকে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মের প্রভাব বেড়েছে-কমেছে, পরিবর্তন হয়েছে সামাজিক গঠনের। মধ্যযুগে সাম্রাজ্যবাদের যুগ শেষে ঊনবিংশ শতকেই শুরু হয়েছে জাতিরাষ্ট্রের যুগ, গত শতাব্দীতে অধিকাংশ দেশেই বিস্তার লাভ করেছে গণতন্ত্র। রাষ্ট্রব্যবস্থা আর মানুষের মূল্যবোধের এই বিবর্তনের মধ্যেও মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা বজায় থেকেছে, রাষ্ট্রের নীতি আবর্তিত হয়েছে অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে।
বিশ্বায়নের এ যুগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এসেছে গতিশীলতা, পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে প্রবাহিত হচ্ছে মূলধন আর শ্রমশক্তি। আশির দশকে নব্য উদারবাদের উত্থানের সাথে সাথে মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে বৈশ্বিক জনমত তৈরির চেষ্টা শুরু হয়, ডব্লিউটিও আর আইএমএফের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে বাজার উন্মুক্ত করার জন্য। এরপর চার দশকে ক্রমাগত এ ইস্যুতে একাডেমিক পরিসরে আলোচনা হয়েছে, ঋণের বিনিময়ে বাজার উন্মুক্তকরণের শর্তারোপের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল, কোনো দেশই পুরোপুরি বাজার উন্মুক্ত করে দেওয়ার নীতিতে যায়নি।
মুক্তবাণিজ্যের ধারক, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানির মতো দেশগুলো তুলনামূলকভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতির দিকে গেলেও চীন, ভারতের মতো উঠতি অর্থনৈতিক পরাশক্তিগুলোও বিভিন্নভাবে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে ব্যবহার করছে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদের (ইকোনোমিক প্রোটেকশনিজম) নীতি। একই পথ অবলম্বন করেছে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোও ।
অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ কী?
বিশ্বায়নের এ যুগে বাণিজ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মূলত নির্ভর করে পণ্য আমদানি বা রপ্তানির উপর। অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদের মাধ্যমে সাধারণত নীতি দ্বারা এই আমদানি বা রপ্তানির প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা বোঝায়।
অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদে বহুল ব্যবহৃত পথ হচ্ছে আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের উপর কর আরোপ করা, যেটি ‘ট্যারিফ’ নামে পরিচিত। কদাচিৎ এ কর আরোপ করা হয় রপ্তানি পণ্যের উপরও। আবার, রপ্তানি পণ্যে সরাসরি ভর্তুকি দিয়েও এ পথে হাঁটে অনেক রাষ্ট্র, কখনো সরাসরি ভর্তুকি দেওয়া হয় কৃষক বা উৎপাদকদের, আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে। অনেকসময় আমদানি-রপ্তানি পণ্যের উপর প্রয়োগ করা হয় কোটাব্যবস্থা, আবার খাদ্য নিরাপত্তা, পরিবেশ নিরাপত্তার ইস্যু তুলেও বিভিন্ন পণ্যের উপর আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা।
এর বাইরে রাষ্ট্রগুলো মাঝে মাঝে এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও চেষ্টা করে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ আরোপ করতে, নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয় বৈশ্বিক প্যাটেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমেও। কখনো বা বন্ধ করা হয় দেশের বাজারে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগকে।
কেন অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ?
রাষ্ট্রীয় নীতিতে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান রেখেছে, কাজ করেছে সরকারের অর্থনৈতিক দর্শন প্রকাশে। রাষ্ট্রের রক্ষণশীলদের কাছে সংরক্ষণবাদ আবির্ভূত হয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে, ফলে কট্টর ডানপন্থীরা সমর্থন করে সংরক্ষণবাদকে। আবার আদর্শিক স্থান থেকে কট্টর বামপন্থীরাও সমর্থন করে এ নীতিকে। পাঠকের মনে নিশ্চয় প্রশ্ন আসছে, দুই মেরুর মতাদর্শের মানুষেরা কেন এই নীতিতে একমত?
প্রথমত, সংরক্ষণবাদের ফলে নতুন শিল্পকারখানা তৈরির সুযোগ হয়, আবার নিরাপত্তা পায় সদ্য জন্মপ্রাপ্ত শিল্পগুলোও। আমেরিকার প্রথম ট্রেজারার, আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন, সংরক্ষণবাদের পক্ষে প্রথম এ যুক্তি তুলে ধরেন ‘ইনফ্যান্ট ইন্ডাস্ট্রি আর্গুমেন্ট’ নামে।
দ্বিতীয়ত, পণ্যের উপর ট্যারিফ আরোপের ফলে আমদানি প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয়। এর ফলে দেশীয় শিল্পখাত বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়, বৈচিত্র্য আসে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে, আসে স্বয়ংসম্পূর্ণতা।
তৃতীয়ত, ট্যারিফ আরোপের ফলে জাতীয় রাজস্ব আদায়ের হার বাড়ে। ফলে, বৃদ্ধি পায় রাজস্ব আয়।
চতুর্থত, কোনো দেশই যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে না, তেমনি পারে না অনেকগুলো খাতে তুলনামূলক সুবিধা বা নিরঙ্কুশ সুবিধা উপভোগ করতে। বরং, ভৌগোলিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে সাধারণত অল্প কিছু খাতে রাষ্ট্রগুলো বিশেষীকরণের সুযোগ পায়। অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ এই বিশেষীকৃত খাতগুলোকে রক্ষা করে, সাহায্য করে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এ নীতি কতটা কার্যকর?
প্রচলিত অর্থে, আমরা সাধারণত নিম্ন মাথাপিছু আয়ের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকেই বুঝে থাকি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে। এই দেশগুলো একটা দীর্ঘ সময় ছিল উপনিবেশ শাসনের অধীনে, ফলে বিকশিত হয়নি অর্থনীতি। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতা পেলেও এশিয়া আর আফ্রিকার দেশগুলো স্বাধীনতা পেয়েছে গত শতাব্দীতে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আশির দশকের শুরুতে, আবার একই সাথে উত্থান ঘটেছে নব্য উদারবাদেরও।
এরপর গবেষণাক্ষেত্র এবং নীতি নির্ধারণ, দুই পরিসরেই মুক্তবাণিজ্য ব্যাপকাভাবে আলোচিত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন আর আইএমএফ বিভিন্নভাবে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর ঋণের বিনিময়ে অর্থনীতি অবমুক্ত করার নীতি চাপিয়ে দিয়েছে বা দিতে চেয়েছে। একাডেমিক স্কলাররা মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন, মুক্তবাণিজ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াবে, বড় করবে অর্থনীতির আকার, বৃদ্ধি করবে সম্পদের পরিমাণ। মূল্য অল্প থাকার গ্রাহকের গড় ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে, ফলে বাড়বে গড় জীবনমান। সাথে সাথে তারা সতর্ক করেছেন নীতি হিসেবে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ গ্রহণের ব্যাপারে। পণ্যের চাহিদার পতন, কম আউটপুট আর বেকারত্বকে তারা দেখাতে চেয়েছেন সংরক্ষণবাদের বৈশিষ্ট্য হিসেবে।
কিন্তু, বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলোর উদাহরণ কী বলছে? কীভাবে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির পথে এগিয়েছে তারা?
বর্তমানে সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই অর্থনীতিতে কট্টর সংরক্ষণবাদী নীতি নিয়ে এগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল আমদানিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সবচে বেশি ট্যারিফ আরোপ করা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন এই খাতের ট্যারিফ উদারীকরণ করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের স্টিলশিল্প সারাবিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সাম্প্রতিক সময়েও তারা নিজেদের অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে ঠেকাতে চীনা পণ্যের উপর একের পর এক ট্যারিফ আরোপ করেছে।
মুক্ত অর্থনীতির বাহক ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য একটা দীর্ঘ সময় অনুসরণ করেছে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদের নীতি। শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে শিল্প-কারখানার পণ্যের আমদানির উপর আরোপ করা ছিলো উচ্চ ট্যারিফ, যা বজায় ছিল গত শতাব্দীর অধিকাংশ সময় জুড়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ করার পর অর্থনৈতিক উদারীকরণ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তারা আবার বেরিয়ে গেছে ইউনিয়ন থেকে, নিজেদের অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রগতি ইউনিয়নের না থাকায়।
অর্থাৎ, বর্তমান সময়ে যারা অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, তারাও আসলে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদ নীতিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে, অর্থনৈতিক সংকটে আশ্রয়ও নিচ্ছে এ নীতির।
এর বাইরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর যে মুক্তবাণিজ্যের পরীক্ষা হয়েছে, তার ফলাফল কী?
এ ফলাফল বিশ্লেষণের জন্য আমরা দুটি সময়পর্যায় নিতে পারি। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত, আর এরপর থেকে এ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত। প্রথম অংশে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো কট্টর সংরক্ষণবাদী নীতিতে ছিলো, যেগুলোর ক্ষেত্রে উদারীকরণ হয়েছে দ্বিতীয় অংশে।
প্রথম অংশে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিলো ৩.১ শতাংশ, পরের অংশে যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৬ শতাংশ। একই ফলাফল দেখা গেছে উপ-সাহারীয় আর উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও, প্রথম অংশে মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ২-২.৫ শতাংশ হলেও, দ্বিতীয় অংশে হয়েছে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে হয়েছে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি, ০.২ শতাংশ; উপ-সাহারীয় দেশগুলোতে যা আরো ভয়াবহ। সম্পদের অব্যবস্থাপনার দরুন সেখানে মাথাপিছু আয়ে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ০.৭ শতাংশ।
এই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জও মোকাবেলা করতে হয়।
অধিকাংশ দেশেই সম্পদ পুঞ্জিভূত হয় রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একটা অংশের হাতে, দীর্ঘমেয়াদে যারা আবির্ভূত হয় সরকারের জন্য প্রেশার গ্রুপ হিসেবে। আবার, অল্প মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জিভূত হওয়া একদিকে যেমন সম্পদ পাচারের ঝুঁকি বাড়ায়, অন্যদিকে বাড়ায় সামাজিক বৈষম্য। ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তখন রাষ্ট্রকে দিতে হয় বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি, যা অর্থনৈতিকভাবে দীর্ঘমেয়াদে চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়।
মুক্তবাণিজ্য উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসেনি। ত্রাতা হয়েছে অর্থনৈতিক সংরক্ষণবাদই ।