স্কুলে পড়ার সময় খেলাধুলার প্রতি খুব ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল এবং ক্রিকেটে। সে সময় বেশিরভাগ ফুটবল ম্যাচে ফ্রি কিক করার সুযোগ মিস করতাম না। ফ্রি-কিক থেকে ব্রাজিলের রবার্তো কার্লোস তার ইতিহাস বিখ্যাত সেই বাম পায়ের বাঁকানো গোলটি সে সময়েই করেছিলেন। আমি প্রায় সময়ই তার মতো কিক নেবার চেষ্টা করতাম। স্কুলজীবনে সে রকম বাঁকানো কোনো গোল করতে পারিনি, তবে এ চেষ্টার দরুন ফ্রি কিক থেকে লক্ষ্যভেদে অামার দক্ষতার বেশ উন্নতি হয়।
খেলাধুলায় অামি পরবর্তীতে সফলতা না পেলেও আমার স্টক ট্রেডিংয়ে বাঁকানো পায়ে শট নেবার অনুশীলনটি বেশ কাজে লেগেছে । ফুটবল ক্রিকেটের মতো শারীরিক খেলা কিংবা দাবার মতো বুদ্ধির খেলা, সকল খেলাতেই কিছু দক্ষতা অর্জন করতে হয় এবং কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। স্টক ট্রেডিংয়েও দক্ষতা অর্জন এবং ট্রেডিংয়ের খুটিনাটি নিয়ম কানুন জানা খুবই জরুরী। অাজকের লেখায় মূলত এই বিষয়গুলোকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা করা হবে।
অনুশীলন ও দক্ষতার ব্যবহার
যেকোনো খেলোয়াড় প্রচুর অনুশীলন করেন নিজের দক্ষতাকে শাণিত করার জন্য, যা একটা সময় তার দক্ষতাকে বৃদ্ধি করে। কিন্তু অনুশীলনে দক্ষতা অর্জন কোনো সাফল্যের মুখ দেখায় না যতক্ষণ পর্যন্ত খেলার মাঠে অর্জিত দক্ষতা পরিপূর্ণরূপে কাজে লাগানো না যায়।
খেলার মতোই স্টক মার্কেটে সফলতার জন্য অনুশীলন প্রয়োজন। অনুশীলনের জন্য প্রতিদিন আপনাকে অনেক ডেমো ট্রেডিং (চার্ট গেইম ওয়েবসাইটটি দেখতে পারেন) করতে হবে। ফান্ডামেন্টাল এবং টেকনিক্যাল টুলগুলো সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে এবং খেলোয়াড়দের মতোই অনুশীলনে অর্জিত ট্রেডিং দক্ষতাকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হবে। খেলাধুলায় যেমন বিপরীত দল সব সময়ই অাপনার পরাজয় কামনা করে, তেমনি ট্রেডিং করার সময়ও কেউ আপনাকে এমনিতেই কোনো মুনাফা দিতে চাইবে না। মুনাফা আপনাকে অর্জন করতে হবে। সফলভাবে আপনার দক্ষতার পরিপূর্ণ ব্যবহার আপনাকে সাফল্যের মুখ দেখাবে।
দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনে আপনি বিভিন্ন ধরনের ফান্ডামেন্টাল এবং টেকনিক্যাল কোর্সগুলো করে নিতে পারেন। ডিএসই নিয়মিত বিভিন্ন রকমের কোর্স আয়োজন করে থাকে ইনভেস্টর এবং ট্রেডারদের জন্য। এছাড়াও বিআইসিএম, আমার স্টক, স্টক বাংলাদেশের মতো প্রথম সারির কিছু প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রকম টেকনিক্যাল এবং ফান্ডামেন্টাল কোর্স করিয়ে থাকে।
স্বাচ্ছন্দ্য
প্রতিটি খেলাতেই প্রতিটি খেলোয়াড় তার পছন্দের কাজটি করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে থাকেন। জোর করে খেলানো হলে ভালো খেলোয়াড়ও খারাপ পারফরমেন্স দেখান। যেমন- ক্রিকেট খেলায় কেউ ওপেনিং ব্যাটসম্যান, কেউ মিডল অর্ডার; ফুটবলে কেউ স্ট্রাইকার, কেউ বা সেন্টার ডিফেন্স অবস্থানে খেলতে পছন্দ করেন। খেলোয়াড়দের জন্য এই স্বাচ্ছন্দ্যবোধটা যেমন জরুরি, স্টক মার্কেট ট্রেডিং করার সময়ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ খুবই জরুরী।
স্টক ট্রেডিংয়ের সময় আপনার নিজের স্বাচ্ছন্দ্যবোধের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। আপনার উচিত এমন কোনো সেক্টরে ইনভেস্ট করা বা ট্রেডিং করা, যেটা সম্পর্কে আপনি ভালোভাবে অবহিত। পারিবারিক, অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো কারণে যদি মার্কেটের প্রতি মনোযোগ দিতে না পারেন, তাহলে সে সময় ট্রেডিং করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
আত্মবিশ্বাস
একজন সফল খেলোয়াড় নিজের ব্যাপারে বরাবরই আত্মবিশ্বাসী। পৃথিবীর সকল সফল খেলোয়াড়দের দিকে তাকালে এই আত্মবিশ্বাসটি দেখা যায়। ফুটবলে একটি নিখুঁত পাস, ক্রিকেটে একটি চমৎকার কভার ড্রাইভের পেছনে এ আত্মবিশ্বাসের বড় ভূমিকা অাছে।
ট্রেডিংয়ে আপনার দক্ষতার ব্যাপারে এ ধরনের আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। আপনার নিজের দক্ষতার উপর যত বেশি আত্মবিশ্বাস থাকবে এবং সে অনুযায়ী যত অনুশীলন করবেন, তত বেশি আপনার দক্ষতা মজবুত হবে। এই অনুশীলনের ভুলত্রুটিগুলো যতই অাপনি শুধরে নেবেন, ততই আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আত্মবিশ্বাস কখনোই একদিনে কিংবা দু-চারটি ট্রেডের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অনেক সময় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইনভেস্টোপেডিয়া তাদের এক জরিপে দেখিয়েছে, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কারণে সাধারণত ক্ষুদ্র ইনভেস্টররা অতিরিক্ত ট্রেড করে থাকেন এবং ফলস্বরূপ তাদের প্রফিট মার্জিন ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
পুনরাবৃত্তি ও সংশোধন
স্টক ট্রেডিং এবং খেলার ময়দানে একই জিনিস বারবার করে যেতে হয়। সাফল্যের জন্য এই একই কাজকেই বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে করতে হয়। উভয়ক্ষেত্রে আপনাকে কিছু কৌশল দাঁড়া করাতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কৌশলে সংশোধন করে উন্নতি সাধন করতে হবে। আপনি কখনোই আশা করতে পারেন না একটি কৌশল বা স্ট্র্যাটেজি আপনাকে সব সময় সমান সফলতা দেবে। প্রতিপক্ষ পাল্টে গেলে কৌশলও বদলাতে হয়।
মানসিক দৃঢ়তা
“তুমি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী” খেলাধুলার ক্ষেত্রে সাধারণত কোচদের মুখে এ জাতীয় কথা আমরা প্রচুর শুনে থাকি। স্টক মার্কেটের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অনেকটাই এরকম। হাজার কোটি টাকার মার্কেটে আমরা আমাদের স্বল্প পুঁজি নিয়ে আসলে অন্য কারো প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার যোগ্যতাই রাখি না। এখানে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী।
ক্রিকেটে আপনি অন্যের দোষে আউট হয়ে যেতে পারেন, একটি ভুল পাসের কারণে আপনি একটি চমৎকার গোলের সুযোগ হারাতে পারেন। তেমনিভাবে ট্রেডিংয়েও এই ধরনের ভুল হতেই পারে। এক্ষেত্রে অন্যকে দোষারোপ করে আপনি কিন্তু আপনার প্রফিট মার্জিন বাড়াতে পারবেন না। মনে রাখবেন, এই মার্কেট থেকে আপনি যত টাকা মুনাফা করছেন, সেটা যেমন সম্পূর্ণরূপে আপনার কৃতিত্ব, তেমনি অর্থ হারানোর দায়ভারটাও আপনারই।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ
খেলার মাঠে স্লেজিং একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। পৃথিবীর বেশিরভাগ খেলাতেই এই অপকৌশলটি আমরা দেখে থাকি। একজন খেলোয়াড়কে আবেগতাড়িত করে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্যই আসলে স্লেজিং করা হয়ে থাকে।
স্টক মার্কেটেও আপনি এ রকম স্লেজিংয়ের শিকার হয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা বুঝতে পারি না যে আমরা স্লেজিংয়ের শিকার হচ্ছি। কোনো ভিত্তিহীন ধারণার উপরে কেউ আপনাকে কোনো একটি পরামর্শ দিচ্ছে এবং আপনি সেটা গ্রহণ করছেন। মানে আপনার অাবেগকে উসকে দিয়ে কোনো কাজ করানো হচ্ছে, অাপনি স্লেজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। ফলস্বরূপ আপনি আবেগতাড়িত হয়ে মার্কেট বিষয়ক আপনার অর্জিত জ্ঞানকে পাশ কাটিয়ে তাদেরকে বিশ্বাস করছেন। স্লেজিংয়ের শিকার একজন ব্যাটসম্যান যেভাবে ছয় মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান, আপনিও সেভাবেই অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
পরিশেষ
আমাদের দেশের শেয়ার মার্কেটে যারা ইনভেস্ট বা ট্রেড করেন, তাদের অনেকেই একটি কথা বলতে খুব পছন্দ করেন, “আমি ‘ঐ’ আইটেমটি নিয়ে খেলেছি”। আমার এই লেখার ধারণাটিও অনেকটা সেই “খেলেছি” শব্দটি থেকে এসেছে।
একজন খেলোয়াড়কে যেমন খেলতে জানতে হয়, খেলার জন্য ব্যবহৃত সকল ধরনের উপকরণ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হয়, খেলার আইন কানুন জানতে হয়; শেয়ার মার্কেটও তেমনি। ভেবে দেখুন, একটি খেলার মাঠে খুব সীমিত সংখ্যক খেলোয়াড় থাকেন, সীমিত সংখ্যক মাঠকর্মী থাকেন, সাংবাদিক থাকেন, বিভিন্ন অফিশিয়াল লোক থাকেন। সবচেয়ে বেশি থাকেন কারা? দর্শক। মজার ব্যাপার হলো, খেলায় দর্শক ছাড়া বাকি সবাই খেলা থেকে কিছু না কিছু অর্থ অায় করেন। একমাত্র দর্শকই অর্থ দিয়ে আসেন।
শেয়ার মার্কেটের ক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি শুধুমাত্র দর্শক হতে চাই? অথবা উপরোক্ত সীমিত সংখ্যকদের মত কোনো একটি ভূমিকা গ্রহণ করতে চাই।