মুদি দোকান, কাঁচাবাজার, স্টেশনারি দোকানে আমাদের সকলের নিত্যনৈমিত্তিক যাওয়া হয়েই থাকে। বোধ করি, এই ঘটনাটি সবারই কম বেশি হয়েছে যে একটি সুনির্দিষ্ট জিনিস কেনার উদ্দেশ্যে দোকানে গিয়েও একাধিক জিনিস কিনে বাড়ি ফিরেছেন এমনকি বাড়তি কেনা পণ্যটি হয়তো সেই অর্থে ততটা আবশ্যক ছিল না। বাজার ব্যবস্থার আরেকটু স্মার্ট ঘরানায় যাওয়া যাক। অর্থাৎ হাল আমলের সুপার শপ। রিটেইল চেইন শপগুলোতে পণ্য সাজানোর বিষয়টা কখনও খেয়াল করে দেখেছেন কি পাঠক? একই শ্রেণীর পণ্য, দামের বিন্যাসে সাজানোর একটি কুখ্যাত পন্থা পুরো পৃথিবী জুড়ে স্বীকৃত, যাকে বলা হয় ডিকয় ইফেক্ট। অসংখ্য কগনিটিভ বায়াসের অন্যতম এই ডিকয় ইফেক্ট ক্রেতাদেরকে অবশ্যম্ভাবীভাবে বেশি খরচ করতে উৎসাহী করে তোলে।
ধরা যাক, আপনি একটি কফি শপে গেলেন। আপনার সামনে তিনটি ভিন্ন সার্ভিং অপশন। স্মল, মিডিয়াম ও লার্জ। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মিডিয়াম ও লার্জ সার্ভিং এর পার্থক্য মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়। দামের সামান্য বৃদ্ধি হলেও আপনার লার্জ সার্ভিংটিই নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এটিই ডিকয় ইফেক্ট। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজিস্ট লিন্ডা চ্যাং এর মতে,
একটি সুনির্দিষ্ট ধারায় পণ্য বা সেবাসমূহকে বিন্যস্ত করলে, আপনি প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভোক্তাদেরকে উচ্চ মূল্যের পণ্যটি কিনতে উৎসাহী করতে পারেন।
১৯৮২ সালে ডিকয় ইফেক্ট সর্বপ্রথম আলোচনার টেবিলে উঠে আসে। প্রথমবারের মতো যখন ডিকয় ইফেক্ট নিয়ে গবেষণা শুরু হয় তখন গবেষকরা এটিকে শুধু পণ্য বিপণনের একটি পন্থা হিসেবেই অভিহিত করেন। তবে কালের পরিক্রমায় এটি এখন একটি পরীক্ষিত সত্য হিসেবে স্বাস্থ্যখাত, রাজনীতি, নিয়োগ, বাণিজ্যসহ আরও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি আমাদেরকে এটিই প্রমাণ করে দেয় যে তথ্যসমূহের উপস্থাপনের বিশেষ ভঙ্গিমা আমাদের অন্তর্নিহিত সচেতন সিদ্ধান্তকে কীভাবে একনিমিষে বরবাদ করে দেয়- এমনকি বিকল্প সিদ্ধান্তটির কোনো অর্থবহ ভূমিকা না থাকলেও। লেখার এই পর্যায়ে পাঠক দুটি উদাহরণ দেখে নেওয়া যাক।
একজন যাত্রী বিমান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে টিকেট কাটবেন। তার কাছে রয়েছে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন পছন্দ।
- ফ্লাইট এ ৪০০ ডলার, ট্রানজিটের ব্যপ্তি ৬০ মিনিট।
- ফ্লাইট বি ৩৩০ ডলার, ট্রানজিটের ব্যপ্তি ১৫০ মিনিট।
- ফ্লাইট সি ৪৩৫ ডলার, ট্রানজিটের ব্যপ্তি ৬০ মিনিট।
গবেষকদলের প্রাপ্ত ফলাফলানুযায়ী, অধিকাংশ মানুষ ‘ফ্লাইট এ’ পছন্দ করেন যেহেতু এই ক্ষেত্রে তূলনামূলকভাবে ফ্লাইট সি এর চেয়ে খরচ কম এবং স্টপওভার টাইম উভয় ক্ষেত্রেই একই। এমনকি তারা সর্বনিম্ন খরচের বিনিময়ে কিছুক্ষণ বেশি সময় অপেক্ষা করতে ইচ্ছুক নন। অর্থাৎ তারা ফ্লাইট বি এর মাধ্যমে ভ্রমণে অনাগ্রহী।
এবারে তথ্যের ব্যতিক্রমধর্মী উপস্থাপন।
- ফ্লাইট এ ৪০০ ডলার, ট্রানজিটের ব্যপ্তি ৬০ মিনিট।
- ফ্লাইট বি ৩৩০ ডলার, ট্রানজিটের ব্যপ্তি ১৫০ মিনিট।
- ফ্লাইট সি ৩৩০ ডলার, ট্রানজিটের ব্যপ্তি ১৯৫ মিনিট।
এক্ষেত্রে যাত্রীদের প্রথম পছন্দ ‘ফ্লাইট বি’ হয়ে থাকে। যৌক্তিকভাবে চিন্তা করলে ফ্লাইট বি দামে ও স্টপওভার টাইমের বিচারে আগে যা ছিল, এবারও তা-ই আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে যাত্রীদের ‘ফ্লাইট বি’ বেছে নেওয়ার ব্যাখ্যা হলো, স্বল্প মূল্যে তারা বেশ অনেকটা সময় অপেক্ষা করতেও রাজি। উভয় চিত্রেই ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে তৃতীয় ও সর্বশেষ অপশনটি যাকে বলা হয় ডিকয়। এই ডিকয় অপশনটির উপর ভিত্তি করেই যাত্রীরা অপর দুটির মাঝে যে কোনো একটিকে বেছে নেবেন।
বিশ্বব্যাপী এক প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট। ড্যান অ্যারিলি তার প্রেডিক্টেবলি ইর্যাশনাল বইতে দেখিয়েছেন এই প্রথম সারির পত্রিকাটির বিপননের পদ্ধতি। পাঠকের সুবিধার্থে এখানে বলে রাখা ভালো যে পত্রিকাটির সাবস্ক্রিপশনের তিনটি পদ্ধতি রয়েছে।
- ডিজিটাল বা অনলাইন সংস্করণ ৫৯ ডলার।
- মুদ্রিত সংস্করণ ১২৫ ডলার।
- অনলাইন ও প্রিন্ট সংস্করণ যুগপৎ ১২৫ ডলার।
সুস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, তৃতীয় অপশনটি এখানে ডিকয় হিসেবে কাজ করছে। ড্যান তার গবেষণালব্ধ ফলাফলানুযায়ী দেখিয়েছেন, পাঠকদের মাঝে তৃতীয় অপশনটি বেছে নেওয়ার প্রবণতাই অধিক, যদিও এর অর্ধেকেরও কম মূল্যে তারা শুধু ডিজিটাল সংস্করণটি পড়তে পারতেন। আবার এই একই মূল্য তালিকা থেকে গৃহীত সিদ্ধান্ত পাল্টে যায় যদি তৃতীয় অর্থাৎ ডিকয় অপশনটিকে উঠিয়ে নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে পাঠকদের প্রথম অপশনটি বেছে নেওয়ার প্রবণতা ৫২% বৃদ্ধি পায়।
ইউনিভার্সিটি অভ ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে, হীরার ব্যবসায়ীদের লাভের পরিমাণ ২১.৪% পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব যদি সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে ডিকয় ইফেক্ট আরোপ করা যায়। ডিকয় ইফেক্ট যে শুধু ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রেই প্রমাণিত সত্য না কিন্তু নয়। ড্যান অ্যারিলির মতে, একজন ব্যক্তি কোন অবস্থায় বিরাজ করছেন তার উপরও তার পছন্দ বা সিদ্ধান্ত অনেকাংশেই নির্ভর করে।
ধরা যাক, অনলাইন ডেটিং সাইটে আপনি ইউজার হিসেবে প্রবেশ করলেন। আপনি সঙ্গী বা সঙ্গিনী হিসেবে কাকে বেছে নেবেন তা পুরোপুরি আপনার একক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে না। আপনি কোন ক্রমে সাইটে থাকা মানুষদেরকে দেখে যাচ্ছেন তার উপরও নির্ভর করবে আপনি আপনার পরবর্তী ডেটে কাকে পাচ্ছেন। বিষয়টিকে খোলাসা করলে দাঁড়ায় এই যে, সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুধু ওই ব্যক্তিটির সৌন্দর্য, ফিগার একমাত্র নিয়ামক নন।
আপনার আশেপাশের অন্যান্য মানুষদের সাথে আপনি নিজের অজান্তেই তাকে তুলনা করে ফেলেন কিংবা আপনার অতীত অভিজ্ঞতাও আপনাকে তাৎক্ষণিক মুহূর্তের সিদ্ধান্ত নিতে অনেকাংশে প্রভাবিত করে থাকে। আলোচনাটা কী একেবারেই একপেশে হয়ে যাচ্ছে? অর্থাৎ কেবলই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, লাভ, লোকসান এসব নিয়ে মাতামাতি মনে হচ্ছে? তাহলে চলুন স্বাস্থ্যখাতে ডিকয় ইফেক্টের অনবদ্য ভূমিকা জেনে নিই।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে, বিহেভিয়ারেল সায়েন্স অ্যান্ড হেলথে অধ্যয়নরত ক্রিশ্চিয়ান ভন ওয়াগনার একটি পরীক্ষা করেন। কোলন ক্যান্সার স্ক্রিনিং একটি অস্বস্তিকর কিন্তু অতীব প্রয়োজনীয় টেস্ট। অংশগ্রহণকারীদের প্রথমে স্রেফ দুটি অপশন দেওয়া হয়। তারা চাইলে স্ক্রিনিং করাতে পারেন অথবা না-ও পারেন। আশানুরূপভাবে অধিকাংশ ব্যক্তিই স্ক্রিনিং এড়িয়ে যান। এবার ডিকয় হিসেবে তৃতীয় একটি অপশন দেওয়া হলো, অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাজনক হাসপাতালে কিছুটা সময় বাড়তি অপেক্ষা করেও চাইলে তারা স্ক্রিনিং করাতে পারেন। এবার দাবার চাল উল্টে গেল। অংশগ্রহণকারীদের মাঝে স্ক্রিনিং করানোর প্রবণতা বেড়ে গেল। এই ফলাফলকে আরও ভ্যালিডেট করার জন্য নতুনভাবে নকশা করা হলো পরীক্ষাটিকে। নারীদের জন্য দুটি নতুন অপশন দেওয়া হলো, তাদের টেস্ট নারীরাই করবেন (প্রেফারেন্স) বনাম পুরুষরা (ডিকয়) করবেন। এক্ষেত্রেও ডিকয়ের দরুন স্ক্রিনিং এর হার বেড়ে যায়।
একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে শেষ করার পালা এবার। পুরুষদের যৌন হরমোন টেস্টোস্টেরন ডিকয় ইফেক্টকে বাড়িয়ে দেয়। ৬৩ জন তরুণকে নিয়ে পরিচালিত এক পরীক্ষা থেকে এই তথ্য দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রমাণিত হয়। এটি একটি ডাবল ব্লাইন্ড, প্লাসিবো কন্ট্রোল্ড স্টাডি ছিল, অর্থাৎ পরীক্ষক এবং পরীক্ষাধীন ব্যক্তি কেউই জানবেন না কে টেস্টোস্টেরন জেল পাচ্ছেন আর কে প্লাসিবো জেল পাচ্ছেন।
জেল ব্যবহারের ১৮০ মিনিট পর তাদেরকে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ পরীক্ষায় অংশ নিতে বলা হয় যেখান থেকে প্রাপ্ত ফলাফল এই বলে যে, যারা টেস্টোস্টেরন জেল পেয়েছিলেন তারা কনসিসটেন্ট ডিসিশন (ব্যক্তির সচেতন) ও টার্গেট ডিসিশন (ডিকয়) নেওয়ার ক্ষেত্রে যথাক্রমে পিছিয়ে ও এগিয়ে আছেন। ঠিক এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় যারা প্লাসিবো (হাইড্রোঅ্যালকোহলিক) জেল পেয়েছিলেন অর্থাৎ এই দলের সদস্যরা সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পূর্বোক্ত দলের চেয়ে বেশি সমর্থ এবং স্বাভাবিকভাবেই টার্গেট ডিসিশন তারা কম নেন অর্থাৎ ডিকয় ইফেক্ট তাদের ক্ষেত্রে কম কার্যকর।
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘অর্থনীতি’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/