লেনদেন, চাহিদা, যোগান, বিনিময়, ভোগ ইত্যাদি অর্থনৈতিক পরিভাষার প্রয়োগ-প্রচলন পৃথিবীর প্রতিটি সমাজেই খুব স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান। অর্থনীতির এই পরিভাষা, হিসাব-নিকাশের প্রয়োগ পৃথিবীর প্রথম মানুষের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও তার উদ্ভাবন মাত্র ২৫০ বছর আগে। সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে অ্যাডাম স্মিথের ১৭৭৬ সালের ‘অ্যান ইনকোয়ারি ইন্টু দ্য নেচার অ্যান্ড কজেজ অভ দ্য ওয়েলথ অভ নেশনস’ নামক গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির আধুনিক যাত্রা শুরু হলেও এর আগে ইউরোপে আরো বেশ কিছু অর্থনৈতিক কালের আবির্ভাব ঘটেছিল, যেগুলো আধুনিক অর্থনীতি তৈরির পূর্বাভাস দিয়ে গিয়েছিল।
মধ্যযুগ। সামন্তবাদের পতন, জাতীয়তাবাদের উত্থান। দার্শনিক, ধার্মিক নেতারা রাষ্ট্র সিংহাসনে আসীন। স্বাধীনচেতা মনোভাবে পুষ্ট জাতি-গোষ্ঠীগুলো পরস্পর পরস্পরকে যোগ্য শত্রু হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করল। এদিকে ইউরোপীয় নবজাগরণের অগ্রদূত নিকোলা ম্যাকিয়াভ্যালির শাসক হয়ে ওঠার উৎসাহ তৎকালীন ইউরোপীয়দের মনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তনের আশার জন্ম দেয়।
অন্যদিকে ১৬ শতকের শুরুতে ‘বিনিময় অর্থনীতি’র (যে অর্থনীতিতে মানুষ একটা নির্দিষ্ট অর্থব্যবস্থার উপর ভিত্তি করে পণ্য কেনাবেচা করতে পারে) প্রচলন শুরু হলো, অর্থকে মানুষ এতটাই সমীহ করতে শুরু করল যে, তারা ভাবত “অর্থ অধিক যার, রণক্ষেত্রের বিজয়ও তার”।
অর্থলোভী, স্বাধীনচেতা ইউরোপীয়রা তখন অর্থের সন্ধানে ব্যবসা-বাণিজ্যমুখী হয়ে উঠল। ফলে তাদেরকে ব্যবসায়ী বা মার্কেন্টাইলিস্ট হিসেবে অভিহিত করা হলো। পাশাপাশি তাদের এই বাণিজ্যিক যুগ মার্কেন্টাইলিজম হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। মার্কেন্টাইলিজমকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, যেমন- জার্মানরা ক্যামেরালিজম এবং ফরাসিরা কোলবার্টিজম, অন্যদিকে স্বর্ণ এবং রৌপ্যমুদ্রা মার্কেন্টাইলিস্টদের আগ্রহের মূল বিষয়বস্তু হওয়ায় তত্ত্বটিকে বুলিওনিজম (স্বর্ণ ও রূপার প্রতি আগ্রহ) নামেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
মাত্র ৩০০ বছর আগেই শক্তিধর একটি তত্ত্ব হয়ে ইউরোপে বিস্তার করেছিল এই মার্কেন্টাইলিজম। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ইত্যাদি দেশগুলোর পাশাপশি ভারতীয় উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইংরেজদের বাণিজ্যিক অগ্রযাত্রার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান এই মার্কেন্টাইলিজমের।
জাতীয়তাবাদী, স্বার্থান্বেষী এ যুগের রাজনীতিবিদেরা নিজ রাষ্ট্রকেই সম্পদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। পাশাপাশি স্বর্ণ-রৌপ্যই সম্পদের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ রূপ বলে তাদের বদ্ধমূল ধারণা থাকায় তারা নিজ দেশের অন্যান্য সম্পদ অধিক পরিমাণে রপ্তানি করে স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা পুঞ্জীভূত করত, মূলত ব্যবসা বাণিজ্যের প্রতি এতটাই ঝুঁকে পড়েছিল যে, কৃষিকে তারা একদমই তুচ্ছ মনে করেছিল।
রাষ্ট্রনীতি ও জনসংখ্যা সংক্রান্ত মতবাদ
যদি আপনি মার্কেন্টাইলিজমকে বর্তমান সমাজতন্ত্রের সাথে গুলিয়ে ফেলেন, তাহলে মোটেও ভুল করবেন না। প্রকৃতপক্ষে, একগুচ্ছ জাতীয়তাবাদী শাসকের কল্যাণে গড়ে উঠেছিল যুগটি। কারণ, নিজ রাষ্ট্র-জাতিকে সর্বোচ্চ সম্পদশালী করার নেশায় মার্কেন্টাইলিস্টরা রাজার হস্তক্ষেপে বিশ্বাসের সাথে সাথে আমদানির উপর অধিক মাত্রায় কর ও রপ্তানিকে সহজলভ্য করত। এভাবে তাদের পক্ষপাতদুষ্ট বাণিজ্য ভারসাম্যকেই মূল বা প্রকৃত লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
শক্তি-সামর্থ্যে যথেষ্ট পরিপোক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি তাদর দৃষ্টিতে যথাযথ মূল্যায়ন লাভ করেছিল। একদিকে রণক্ষেত্র ও অন্যদিকে উৎপাদনে শ্রমের চাহিদা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে তাদের নিকট গুরুত্ববহ করে তুলতে সাহায্য করেছিল।
মার্কেন্টাইলিজম যেহেতু ১৫ শতকের জাতীয়তাবাদী নেতাদের স্বার্থান্বেষী মনোভাবের প্রতিফলন, সেহেতু রাষ্ট্র ভূমিকায় থাকার পাশাপাশি সেসমস্ত নীতিনির্ধারকেরা অর্থনীতিবিদ বনে গিয়েছিলেন ও তাদের রাজনৈতিক নীতিসমূহ অর্থনীতিতে ব্যাপক হারে প্রভাব ফেলেছিল। অন্যতম ছিলেন থমাস মান ও তার অন্যতম ১১টি ফর্মুলা-
(১) কৃষি হলো জমির অপব্যবহার। তিনি কৃষিকাজকে প্রত্যাখান করেছিলেন।
(২) বিদেশি পণ্য ক্রয়ে অনুৎসাহ, কিছু ক্ষেত্রে কঠোর করারোপ। তাতে দেশীয় পণ্যের অবমূল্যায়ন হবে বলে ভাবতেন তিনি।
(৩) রপ্তানির অগ্রাধিকার হিসেবে যথাক্রমে প্রতিবেশী দেশ ও পাশ্ববর্তী দেশ তারপর দূরবর্তী দেশগুলো প্রতি গুরুত্ব।
(৪) ইন্স্যুরেন্স ও জাহাজ ব্যবহারের আয় কুক্ষিগত করার লোভে রপ্তানির ক্ষেত্রে নিজস্ব জাহাজ ব্যবহারে তাগিদ।
(৫) সমুদ্র পার্শ্ববর্তী মানুষদেরকে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে উদ্বুদ্ধ ও নিজেদের তীরের মাছ ধরতে নিরুৎসাহিত করতেন।
(৬) তাদের ধারণা ছিল, টাকা ব্যবসা তৈরি করে এবং ব্যবসাই টাকা তৈরি করে। তাই কৃষিসহ সকল কাজকে প্রত্যাখান করে তার ব্যবসাকেই সফল সম্পদশালী হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন।
(৭) তিনি ভিনদেশীদের সঙ্গে একটি বিনিময় চুক্তি করতে বলেছিলেন, বিদেশীদের কাঁচা/অশোধিত পণ্য ক্রয় করে বিনিময়ে পণ্য তৈরি করে তারা রপ্তানির সময় বিদেশীদের আমদানি খরচ মওকুফসহ বিনামূল্যে রপ্তানি করবে।
(৮) প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি করে অধিক স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা অর্জনের আশায় নিজ দেশের নাগরিকদের নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারে স্বল্পতার ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই পরিচালক।
(৯) রাজ্যের করব্যবস্থা, জাহাজ ব্যবস্থা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঠিক রাখতে একটি নির্দিষ্ট খাতের তত্ত্বাবধায়নের প্রয়োজনীয়তাও উল্লেখ করেছিলেন।
(১০) দেশের বাইরে ব্যবসায় মনোযোগী হওয়ার উপর গুরুত্বও দিয়েছিলেন তৎকালীন যুগের এই লেখক।
(১১) তিনি জনগণকে এটাও বলেছিলেন যে “আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকব”।
তাদের মধ্যকার আরেকজন, এনতেনিও শেরা কল-কারখানার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি কারখানাকে কৃষি কাজের থেকে অনেক বেশি লাভজনক বলে ভাবতেন। কলকারখানার একটি নির্দিষ্ট বাজার আছে, যা কৃষির নেই; এ মর্মে তিনি এ-ও বলেছিলেন যে, কল-কারখানার থেকে প্রাপ্ত লাভ বৃদ্ধি পায় বর্ধমান হারে, যেখানে কৃষির লাভ বৃদ্ধি পায় ক্ষীয়মান হারে।
ফিলিপ ভন হরনিক নামে অস্ট্রেলিয়ান একজন লেখকও এই মার্কেন্টাইলিজম তত্ত্বের প্রবর্তকের ভূমিকায় নাম লিখিয়েছিলেন। তার মতবাদ অনুযায়ী,
(১) দেশের সম্পদের পূর্ণ ব্যবহারের ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে।
(২) দেশের অভ্যন্তরের স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা বিদেশীদের হস্তগত না হওয়ার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
(৩) নিজেদের সম্পদে চাহিদার পরিপূর্ণতার পাশাপাশি বিদেশী সম্পদ ব্যবহারে অনুৎসাহ থাকতে হবে।
(৪) অধিক প্রয়োজনীয় আমদানি স্বর্ণ-মুদ্রা দিয়ে না করে অন্য কোনো সম্পদের বিনিময়ে করাই শ্রেয়।
(৫) নিজেদের পণ্য অধিক দামি হলেও দেশী পণ্যই ব্যবহার করতে হবে।
(৬) কাঁচামাল আমদানি করে সেগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করে রপ্তানি করে স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা অর্জন নতুবা দেশের বাজারে ব্যবসা উপযোগী করতে হবে।
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে সবসময়ই সম্পদ বিদ্যমান। যেমন করে এই সম্পদের ব্যবহারেই অর্থনীতির উন্নয়ন, তেমন করেই এ সম্পদের অব্যবহারে অর্থনীতির অধঃপতন। মার্কেন্টাইলিজমে কৃষিকে অবমূল্যায়ন করার সাথে সাথে প্রচুর আবাদি জমিসহ নানা কৃষিজ পণ্য তখন অব্যবহারে থাকায় বিপুল একটা অর্থনৈতিক ঘাটতি তৈরি হয়েছিল।
এদিকে ক্রমে ক্রমে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিস্তার লাভ করায় মার্কেন্টাইলিস্টদের গচ্ছিত স্বর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা অন্যান্য সম্পদের মতন একটি সম্পদে পরিণত হয় মাত্র। তেমনিভাবে স্বর্ণ-রৌপ্যকে দেওয়া অধিক মূল্যায়নও হারিয়ে যায়।
অপরদিকে বাজারে অন্যান্য অর্থনীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটে। জনগণ রিয়েল এস্টেট, কল-কারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি তৈরিতে ঝুঁকে পড়ে এবং মূল্যবান মনে করতে শুরু করে। তাছাড়াও একগুঁয়ে মার্কেন্টাইলিস্টদের বিভিন্ন বাজে নিয়মনীতি, যেমন- একক প্রতিযোগিতাহীন বাজার ব্যবস্থা, উন্নত বিদেশী পণ্য ব্যবহারে কড়াকড়ি আরোপ ইত্যাদি কারণে তাদের সম্পদের মান খারাপ হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে তারা। ফলে, ১৮ শতকের মাঝামাঝি এসে মার্কেন্টাইলিজমের বিলুপ্তি ঘটে। যদিও মার্কেন্টাইলিস্টরা বিভিন্ন একগুঁয়ে কাজকর্মে আগ্রহী ছিল, তবুও তাদের শিল্প-বাণিজ্য পরবর্তী সময়ে ইউরোপে শিল্প বিপ্লবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল।