মানুষ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো আমরা চিন্তা করতে সক্ষম। প্রত্যেকের নিজস্ব চিন্তাধারা আছে, বিভিন্ন বিষয়ে আছে নিজস্ব মতামত। এ চিন্তা করার ক্ষমতাই আমাদের অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে তুলেছে। আর এ চিন্তাধারা সঠিক না ভুল তা যাচাই করার কষ্টিপাথর হলো বিতর্ক। আদ্যিকাল থেকে দার্শনিকরা নিজেদের সিদ্ধান্তে পৌছানোর জন্য বিতর্কের আশ্রয় নিয়েছেন। এই তর্কযুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে তারা ব্যবহার করেছেন যুক্তিকে।
তারা নিজেদের মতামতের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। অন্যজন সে যুক্তিকে খন্ডন করেছেন নতুন যুক্তি দিয়ে। এই যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তারা এগিয়ে গেছেন সত্যের কাছাকাছি। পৌঁছাতে পেরেছেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে। শুধু দার্শনিকরাই নন, আমরাও আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত যুক্তিতর্কের আশ্রয় নেই। সেটা হতে পারে বন্ধুদের আড্ডায় রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে। কিংবা সাধারণ কোনো বিষয়ে, যেমন আপনি হয়তো আপনার বন্ধুকে বোঝাচ্ছেন কেন তার নিয়মিত রোর বাংলা পড়া উচিৎ!
তবে বিতর্ক যে সবসময় সুস্থভাবে হয় তা নয়। এর কদর্য রূপ আমরা দেখতে পাই প্রায়ই। ফেসবুকের মন্তব্যের ঘরে তো অহরহ দেখা যায়। নিজের মতামত প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ যুক্তির বদলে গালাগালির মহড়া বসিয়ে দিচ্ছে, খোঁচা দিয়ে কথা বলে নিজের ‘স্মার্টনেস’ ফুটিয়ে তুলতে চাইছে, তাচ্ছিল্য করে এক তুড়িতে উড়িয়ে দিচ্ছে অন্যজনের মতামতকে। এসব দেখলে সন্দেহ জাগে, আসলেই কি আমরা মানুষেরা চিন্তার দিক দিয়ে অনন্য হয়ে আছি?
অথচ একটু চিন্তা করলেই আমরা শক্ত ভিতের উপর যুক্তি দাঁড় করাতে পারি। এজন্য সঠিক পদ্ধতিতে যুক্তি দিতে শেখা দরকার। শক্ত যুক্তি আমাদের সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। এটি আমাদের মতামতকে বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করতে সহায়তা করবে। আপনি যা-ই করেন না কেন, যুক্তিতর্কের দক্ষতা আপনাকে অনন্য করে তুলবে। আপনার কথা যুক্তিযুক্ত হলে মানুষ তা শুনতে আগ্রহী হবে। আজকের লেখায় আমরা এই যুক্তি দাঁড় করানোর কয়েকটি উপায় নিয়ে আলোচনা করব।
অবরোহ অনুমান
সঠিক যুক্তি দেয়ার জন্য যে কয়টি পদ্ধতি আছে, এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতি হলো ডিডাক্টিভ রিজনিং বা অবরোহ অনুমান। এটিই একমাত্র পদ্ধতি যা আপনাকে সম্পূর্ণ নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে। বাস্তবে খুব কম ক্ষেত্রেই কোনো সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া যায়। অধিকাংশ প্রশ্নের জবাবই আমরা সুনিশ্চিত হয়ে দিতে পারি না। চলুন দেখি অবরোহ অনুমান কীভাবে করতে হয়। এক্ষেত্রে প্রথমত কিছু সত্য প্রতিজ্ঞা (Premise) থাকবে। সে প্রতিজ্ঞাগুলো আপনাকে নিয়ে যাবে উপসংহারে। একটা সহজ উদাহরণ দেয়া যাক।
১) বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর।
২) এডভোকেট আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
সিদ্ধান্ত: এডভোকেট আব্দুল হামিদের বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর।
এটি খুবই সহজ একটি উদাহরণ। তবে এটি অবরোহ পদ্ধতি সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা দেয়। এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। সবক’টি প্রতিজ্ঞা সত্য হতে হবে এবং প্রতিজ্ঞাগুলো আপনার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করতে হবে। অনেক সময় সবগুলো প্রতিজ্ঞা সত্য হলেও এই সমর্থনের অভাবে যুক্তি সঠিক না-ও হতে পারে। চলুন এমন একটি উদাহরণ দেখে নেই।
১) বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর।
২) এডভোকেট আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি।
সিদ্ধান্ত: এডভোকেট আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের বিশতম রাষ্ট্রপতি।
এখানে আমাদের দু’টি প্রতিজ্ঞাই সঠিক। ঘটনাচক্রে সিদ্ধান্তটিও সঠিক। কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞাগুলো থেকে কোনোভাবে বোঝা সম্ভব নয় যে এডভোকেট আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের কততম রাষ্ট্রপতি। তাই এখানে প্রতিজ্ঞাগুলো সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছে না। তাই সিদ্ধান্তটি সঠিক হলেও এটি অযৌক্তিক পদ্ধতি।
অবরোহ অনুমান সম্পর্কে আমরা মোটামুটি জানলাম। তবে এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হলো এর মধ্য দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আপনার কাছে ঐ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত তথ্য থাকতে হবে। কিন্তু সেটি খুব কম ক্ষেত্রেই থাকে। এছাড়া এটি তেমন নতুন কোনো জ্ঞানের সন্ধানও দিচ্ছে না আপনাকে। নতুন জ্ঞান লাভের জন্য অন্য পদ্ধতিগুলো সম্পর্কে জানতে হবে।
আরোহ অনুমান
আপনি কি হুমায়ুন আহমেদের লেখা শুনলেই কোনো বই পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠেন? অথবা রাজকুমার হিরাণীর আসন্ন সিনেমা নিয়ে উচ্ছ্বসিত? আপনি কীভাবে জানেন যে হুমায়ুন আহমেদের এ বইটি ভালো হবে? কিংবা রাজকুমার হিরানীর সিনেমাটি? এটি আপনি বোঝেন পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে। হয়তো রাজকুমার হিরানীর আগের কোনো সিনেমা দেখে হতাশ হননি। তাই ভাবছেন যে, সামনের সিনেমাটিও আপনাকে হতাশ করবে না। আপনি কিন্তু সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারছেন না এক্ষেত্রে। হতেই পারে যে, সিনেমাটি আপনার একটুও ভালো লাগবে না।
আরোহ অনুমানের ক্ষেত্রে এটিই করা হয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করা হয় ভবিষ্যতে কী হতে পারে। এটি আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়তই করে থাকি। তবে এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, আরোহ অনুমান বা ইনডাক্টিভ রিজনিং আপনার সিদ্ধান্তের নিশ্চয়তা দেয় না। এটি সম্ভাব্যতা প্রকাশ করে। তবে এর মাধ্যমে আপনি শুধুমাত্র ভবিষ্যতের সম্ভাব্যতা নয়, আরো অনেক কিছু অনুমান করতে পারেন। যেমন-
১) প্রাচীন এথেন্সের অধিকাংশ মানুষের দাড়ি ছিল।
২) সক্রেটিস প্রাচীন এথেন্সের অধিবাসী ছিলেন।
সিদ্ধান্ত: খুব সম্ভবত সক্রেটিসেরও দাড়ি ছিল।
সক্রেটিসের দাড়ি ছিল কিনা এ নিয়ে একটি বিতর্ক আসলেই আছে। হতেই পারে যে সক্রেটিসের দাড়ি ছিল না। আর এখানেই আরোহ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা। এটি নিশ্চয়তা প্রকাশ করে না।
অ্যাবডাক্টিভ অনুমান
আরোহ ও অবরোহ অনুমান ছাড়াও যুক্তি দাঁড় করানোর আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে অ্যাবডাক্টিভ অনুমান। এটি কী জানার জন্য চলুন একটু বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের কাছ থেকে ঘুরে আসি। সাইন অফ ফোর উপন্যাসে শার্লক বলেন, “তুমি যদি একে একে সবচেয়ে অসম্ভব ব্যাখ্যাগুলোকে বাদ দিয়ে দাও, এরপর যেটি অবশিষ্ট থাকে তাই সত্য”। শার্লক আসলে এখানে অ্যাবডাক্টিভ অনুমানের বেশ চমৎকার একটি সংজ্ঞা দিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্তে আসার জন্য একে একে অসম্ভব ব্যাখ্যাগুলোকে বাদ দেয়া হয়। এরপর সবচেয়ে বেশী সম্ভাব্য ব্যাখ্যাটিকে সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নেয়া হয়। চলুন একটি উদাহরণ দেখে নেয়া যাক।
১) গতকাল রাতে আপনি ও আপনার বন্ধু একই হোটেলে খাবার খেয়েছেন।
২) পরদিন আপনারা দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুখের লক্ষণও একই।
৩) রুমের অন্য কেউ অসুস্থ হয় নি।
সিদ্ধান্ত: ঐ খাবার থেকেই সমস্যার উৎপত্তি হয়েছে।
এখানে আপনার অসুস্থ হওয়ার নানা কারণ থাকতে পারে। আরোহ বা অবরোহ পদ্ধতিতে দেখলে এ বিষয়গুলো থেকে আপনার সিদ্ধান্তে আসা যায় না। কিন্তু আপনাদের দুজনের অসুস্থতার একই লক্ষণ থেকে বোঝা যায়, অসুস্থতার কারণ ঐ খাবারে লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী। এটি ঐ পরিবেশে ভাইরাস সংক্রমণজনিত কোনো কারণেও হয় নি। কারণ আপনারা দুজন ছাড়া অন্য কেউ অসুস্থ হয়নি।
আরোহ পদ্ধতির মতো এ পদ্ধতিও আপনার সিদ্ধান্তের কোনো নিশ্চয়তা প্রদান করে না। তবে কোনো বিভ্রান্তিকর সমস্যার সমাধানে এটি খুবই কার্যকরী পদ্ধতি। ডাক্তার এবং গোয়েন্দারা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এটি প্রায়ই ব্যবহার করে থাকেন। এ পদ্ধতিতে আপনার কাছে যত বেশী তথ্য থাকবে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সম্ভাবনা তত বেশি বেড়ে যাবে। আর এ কারণেই ডাক্তার এবং গোয়েন্দারা চেষ্টা করেন যত বেশী সম্ভব তথ্য যোগাড় করতে।
আমরা যুক্তি দাঁড় করানোর কৌশলগুলো সম্পর্কে জানলাম। তবে এছাড়াও কিছু ফ্যালাসি আছে যুক্তি দাঁড় করানোর সময় যেগুলো খেয়াল রাখা উচিৎ। নাহলে যুক্তি সম্পূর্ণ অমূলক হয়ে যায়। সেসব ফ্যালাসি নিয়ে পরে কখনো কথা হবে। এবার চলুন দেখা যাক বিতর্কে জড়ানোর সময় কোন কোন বিষয় মাথায় রাখা উচিৎ।
বিতর্ক করবেন যেভাবে
নিজের যুক্তি নিজের কাছে,
যত্নে স্নেহে বাড়ে বাঁচে ।
পুত্র স্নেহে অন্ধ কোনো রাজার মতন।
কিন্তু আরো রাজা আছে,
সন্তান আছে তাদেরও কাছে।
এসব কথা ভাববে তুমি ,
সময় কখন সময় কখন?
সব মানুষের যুক্তি থাকে নিজের মতন ॥
সব মানুষের যুক্তি থাকে নিজের মতন ॥
– নচিকেতা
কোনো তর্কে যাওয়ার আগে আমাদের এ বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। আমাদের যেমন নিজস্ব মতামত ও যুক্তি আছে, তেমনি অপরপক্ষেরও আছে নিজস্ব মতামত। তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা আবশ্যক। আর মনে রাখা উচিৎ, আমরা যুক্তি বেয়ে সিদ্ধান্তে আসি। আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে এর পক্ষে যুক্তি খুঁজি না।
যুক্তিতর্ক কোনো হার-জিতের খেলা নয়। এটি একটি প্রক্রিয়া যা দুই পক্ষকেই সত্যের কাছাকাছি নিয়ে যায়। তাই অন্য কেউ যদি আমাদের থেকে ভালো যুক্তি দেয় তবে তার মোকাবেলা করতে হবে যুক্তি দিয়েই। আর আমরা যদি অপরপক্ষের কোনো যুক্তির প্রত্যুত্তর খুঁজে না পাই, তাহলে তার প্রতি রুষ্ট না হয়ে ধন্যবাদ দেয়া উচিৎ আমাদের সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করার জন্য। রোর বাংলার পাঠকদের কাছে সুস্থ যুক্তি-তর্ক চর্চার প্রত্যাশা রেখে আজ এখানেই শেষ করছি।