মাত্র ছ’মাস পূর্বেও আমাদের এই পৃথিবী ছিল ব্যস্ত ও প্রাণচঞ্চল। প্রতিদিনের সকাল শুরু হতো ব্যস্ততা দিয়ে। এমন জীবনে অভ্যস্ত আমরা তখন পর্যন্ত ভাবতেও পারিনি সামনের দিনগুলোতে কী হতে যাচ্ছে! কোভিড-১৯ এর আক্রমণে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ এ দুর্যোগে পুরো পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি মানুষ গৃহবন্দী জীবনযাপন করছে। সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অফিস-আদালত, শিল্প, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ প্রায় সকল ধরনের খাতসমূহ।
করোনাভাইরাসের প্রভাবে পুরো দুনিয়া জুড়ে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে তা থেকে রেহাই পায়নি শিক্ষাব্যবস্থাও। উন্নত দেশগুলোতে অনলাইন মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কেবলমাত্র শ্রেণীকক্ষভিত্তিক পাঠদান ব্যবস্থায় অধিকতর নির্ভরশীল হওয়ায় এই স্থবিরতা জেঁকে বসেছে প্রকটরূপে। যার ফলে সেশন জটের মতো ভয়াবহ ফলাফলের আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘ এই লকডাউন চলাকালীন সময়ে ও লকডাউন পরবর্তীকালে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে তা নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
লকডাউন চলাকালীন সময়ে সম্ভাব্য পদক্ষেপসমূহ
পাঠ্যক্রম সংক্ষিপ্তকরণ
করোনা ভাইরাসের কারণে প্রায় বেশ কয়েক মাস ধরে শিক্ষাদান কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা এখনো হয়নি, পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সকল একাডেমিক কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে। এ দীর্ঘ সময়ের ক্ষতি কাটিয়ে উঠে শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে তাদের একাডেমিক ইয়ার শেষ করার জন্যে পাঠ্যসূচি সংক্ষিপ্তকরণ প্রয়োজন। পাঠ্যসূচির একান্ত আলোচ্য বিষয়াদির বাইরের বিষয়গুলো আপাতভাবে বাদ দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে গেলে এই সিস্টেম লস কাটিয়ে ওঠার সুযোগ থাকবে।
অনলাইনে কোর্স ম্যাটেরিয়াল সরবরাহ
অপ্রতুল ইন্টারনেট সংযোগ বা যথাযথ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের অভাবের কারণে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস শুরু করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং৷ কিন্তু এ দীর্ঘ সময়ে যদি একেবারেই একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয় তবে শিক্ষার্থীদের এ ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য হবে। এক্ষেত্রে, অনলাইনে (ফেসবুক গ্রুপ/গুগল ক্লাসরুম) প্রতি সপ্তাহে শিক্ষকেরা কিছু কোর্স ম্যাটেরিয়াল আপলোড করতে পারেন, যাতে শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম পড়াশোনার সাথে সম্পৃক্ত থাকে। পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছু স্লাইড, কিছু তথ্য, সংক্ষিপ্ত ভিডিও ইত্যাদি নিয়মিত বিরতিতে প্রদান করা হলে শিক্ষার্থীরা তাদের সময় সুযোগমতো সেগুলো দেখে রাখতে পারবে। এতে করে তাদেরকে একাডেমিক কার্যক্রমের থেকে সম্পুর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন না করে অন্তত কিছুটা সংযুক্তি ধরে রাখা সম্ভব।
ওপেন বুক এক্সাম
অনলাইন ক্লাসের অন্যতম একটি বাধা হচ্ছে পরীক্ষা নেয়া। অনলাইনে ক্লাস নেয়া গেলেও পরীক্ষা কীভাবে নেয়া হতে পারে এ সংক্রান্ত জটিলতা কাটছে না। এক্ষেত্রে ‘ওপেন বুক এক্সাম’ ভালো একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে। ওপেন বুক এক্সামের ক্ষেত্রে সাধারণত এমন একটি সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়, যে প্রশ্নগুলো অধ্যয়নকৃত বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও বইয়ে সরাসরিভাবে এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ধরনের পরীক্ষাপদ্ধতি উৎসাহিত করা হলে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া যেমন সহজ হবে, তার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশও বেশ ভালোভাবেই হয়ে উঠবে।
বিশেষ শিক্ষার্থীদের শিক্ষণ
দীর্ঘ লকডাউনে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সম্ভবত বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের (দৃষ্টি, শ্রবণ ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী)। যেহেতু এ ধরনের শিক্ষার্থীরা বিশেষ পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করে অভ্যস্ত এবং তাদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষক লাগে, সেহেতু চলমান এ স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠার অংশ হিসেবে আমরা যদি অনলাইন ক্লাসের দিকে এগিয়ে যাই, সেক্ষেত্রেও তাদের সমস্যাগুলো থেকেই যায়। এক্ষেত্রে বিশেষ শিক্ষার্থীদের চিহ্নিতকরণ সাপেক্ষে তাদের প্রয়োজনীয় যথাযথ শিক্ষা উপকরণ পৌঁছে দেয়া ছাড়া আপাতভাবে আর কোনো দ্বিতীয় উপায় নেই। পাশাপাশি, বিশেষ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ন্যূনতম আকারে হলেও চালিয়ে নেয়ার জন্য তাদের বাবা-মায়েদের ‘হোম-টিচিং‘ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।
করোনা পরবর্তীকালে সম্ভাব্য গৃহীত পদক্ষেপসমূহ
ডিজিটাল ক্লাসরুম চালু রাখা
দীর্ঘ লকডাউনের ফলে সৃষ্ট ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়তো অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত ‘মেকাপ’ ক্লাসগুলো প্রতিষ্ঠানের ক্লাসরুমে হওয়ার পরিবর্তে অনলাইনে হলে ভালো হয়। যেহেতু অতিরিক্ত ক্লাসগুলোকে সাধারণত সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে দেয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে তা শিক্ষার্থীদের জন্যে সমস্যার সৃষ্টি করে। সাধারণত আমাদের সাপ্তাহিক কোনো কর্মপরিকল্পনা থাকলে আমরা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো সেজন্য বরাদ্দ রেখে থাকি। সুতরাং, বন্ধের দিনগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ না করে অন্য দিনগুলোতে রাতের বেলায় অনলাইনে অতিরিক্ত ক্লাস নেয়া যেতে পারে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের আলাদা চাপ অনুভব হবে না, পাশাপাশি ডিজিটাল অনলাইন ক্লাসের সাথে তারা দীর্ঘ লকডাউনের সময় যেটুকু পরিচিত হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতাটুকুও বজায় থাকবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ট্রাইসেমিস্টার চালুকরণ
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণত বছরে দুটি করে সেমিস্টার হয়ে থাকে। সেই হিসেবে চলতি বছরের প্রথম সেমিস্টারটি অর্ধসম্পন্ন থাকার পর একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং পরের সেমিস্টারটি এ বছরে আদৌ হবে কি না সেই আশংকারও সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে ২০২১ ও ২০২২ সালে চার মাস ব্যাপী তিনটি সেমিস্টার নেয়া সম্ভব হলে সেক্ষেত্রে আগামী এক বছরের মধ্যে এই ক্ষতিটুকু কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
এক ডেস্ক একজন শিক্ষার্থী কর্মসূচি
করোনা পরবর্তীকালেও দীর্ঘ সময়ের জন্য আমাদেরকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে শ্রেণীকক্ষগুলোতে যাতে পর্যাপ্ত দূরত্ব মেনে চলা যায় সে নিমিত্তে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্যে আলাদা ডেস্ক বা আলাদা চেয়ার নিশ্চিত করা যেতে পারে। এতে করে শিক্ষার্থীরা একে অপরের সরাসরি সংস্পর্শের বাইরে থাকবে।
সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে জোরপ্রদান
দীর্ঘ লকডাউন পরবর্তী সময়ে খুব স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীদের ওপর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক পড়াশোনার চাপ তৈরি হবে। তাই একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমগুলোতে জোর প্রদানের মাধ্যমে একাধিক উপযোগিতা লাভ করা সম্ভব। আমরা যদি এর গঠনগত কিছুটা পরিবর্তনে গুরুত্বারোপ করি, তবে তা আমাদের অতিরিক্ত কিছু সুবিধা প্রদান করতে পারে। সহশিক্ষামূলক কার্যক্রম, যেমন- বক্তব্য প্রতিযোগিতা, বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি বিষয় যদি আমরা একাডেমিক বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিকভাবে চর্চা করার ওপর জোর দেই, তবে এর ফলে একাডেমিক শিক্ষার বেশ বড় একটি অংশও ‘উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা’ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। অর্থাৎ সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমগুলোকে বিনোদন হিসেবেই উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় পরিবর্তন করে নিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বাস্থ্যসূচি প্রণয়ন
করোনাভাইরাস চলমান বা পরবর্তী সময়কালে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যথাযথ স্বাস্থ্যসূচি প্রণয়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে ঢোকার পূর্বে যথাযথভাবে জীবানুমুক্ত হয়ে প্রবেশ করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদির ওপর আলাদাভাবে বিধি-নিষেধ প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে জোর প্রদান করতে হবে। নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য উৎসাহিত করতে প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থবিধির উপর আলাদাভাবে নাম্বার প্রদান করতে পারে।
হোম টিচিং এর প্রশিক্ষণ
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ খানিকটা কমে আসার পর রাষ্ট্রের কাঠামোগুলো কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে। ধীরে ধীরে খুলতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও। তবে অতীতের বিভিন্ন মহামারীর ক্ষেত্রে সেকেন্ড ওয়েভের মতো ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছে বিধায় আমাদের পুনরায় দীর্ঘ লকডাউনে যাওয়ার মতো যথেষ্ট প্রস্তুতি রাখতে হবে। এরই অংশ হিসেবে শিশুদের বাবা-মায়েদের ‘হোম টিচিং’ এর প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সাধারণত শিশুরা স্কুল-কলেজে বা এর বাইরেও আলাদাভাবে অন্য শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করে বিধায় তাদের পড়াশোনা নিয়ে বাবা-মায়েরা অতটা নজর রাখার চেষ্টা করেন না। কিন্তু লকডাউনের মতো সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং অন্য শিক্ষক দিয়ে পড়ানোর সুযোগ থাকে না। সেজন্য শিশুদের যথাযথভাবে পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার জন্য ও তাদের বাসায় পড়ানোর জন্যে তাদের বাবা-মায়েদের আগে থেকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে।
বাজেট বৃদ্ধি
করোনা মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের সেবাখাতগুলোর কতটা নাজুক অবস্থা। শিক্ষাখাতকে ডিজিটালাইজেশন করার জন্যে সর্বপ্রথম প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বৃদ্ধি করা। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত অনুসরণ করা হলে এই স্থবিরতা কাটিয়ে ওঠা কিছুটা সম্ভবপর হতে পারে। এছাড়াও শিক্ষাক্ষেত্রে আলাদাভাবে ‘আপদকালীন বাজেট’ অনুমোদন দেয়া যেতে পারে, যা থেকে পরবর্তীতে অনাহুত পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে পুরো পৃথিবীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চলমান এ সংকটের আশু কোনো সমাধানও আপাতদৃষ্টিতে অনুুুমান করা যাচ্ছে না। আকস্মিক এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। আশা করছি আর সব ক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রও এই মহামারির প্রকোপ কাটিয়ে পুনরায় নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাবে।