Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বের জনপ্রিয় কয়েকজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার

প্রকৃতি এবং বন্যপ্রাণীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার প্রতি সাধারণ মানুষের খুব কৌতূহল থাকে। আর সেই কৌতূহলের কারণে অনেকেরই ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের প্রতি ভালবাসা জন্মায়। সেই ভালবাসা থেকেই অনেকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চান ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিকে। হাতে ক্যামেরা ও লেন্স নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা অজানার সন্ধানে, পাড়ি দেন নানা বিপদসঙ্কুল পথ।

কখনো জঙ্গলের হিংস্র পশুর সামনে পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়া, কখনোবা খরস্রোতা নদীতে বা পাহাড়ি পিচ্ছিল পথে বিপদ ঘটতে ঘটতে রক্ষা পাওয়া ওয়াইল্ডলাইফ ফটাগ্রাফারদের জীবনের নিত্যদিনের ঘটনা। তারপরও সেসব মানুষকে প্রতিনিয়ত আকর্ষণ করে যায় প্রকৃতির সেই বুনো গন্ধ, প্রাণীকূলের উদ্দামতা। প্রকৃতির রুক্ষতার অধরা সৌন্দর্য কিংবা নীলাভ সবুজের অপার সৌন্দর্যকে তুলে আনা বা খুঁজে ফেরা কোনো বিপন্ন পশুর সন্ধানে বা কোনো পশুর জীবনকে কাছ থেকে দেখার এক দুনির্বার আকর্ষণে রাতের পর রাত জেগে ক্যামেরার লেন্সে চোখ রেখে যাওয়া। এই বুঝি এক অসাধারণ ছবি ধরা পড়তে যাচ্ছে তার ক্যামেরায়।

আসলে যারা ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি ভালবাসেন, এই বিপদের কথা তাদের কারোরই অজানা নয়। প্রকৃতি এবং জীববৈচিত্রের প্রতি তাদের তীব্র অনুরাগই তাদেরকে এই পেশা বেছে নিতে সাহায্য করে। আজ এমন কয়েকজন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার সম্পর্কে জানবো, যাদের ফটোগ্রাফির বিষয় ওয়াইল্ডলাইফ হলেও তাদের ছবির বিষয়বস্তুর দিকে থেকে বেশ বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায়।

কারেন লুনি, অস্ট্রেলিয়া

অস্ট্রেলিয়ান ফটোগ্রাফার কারেন লুনি একজন কনটেম্পোরারি ফটোগ্রাফার হিসেবে বেশ সুপরিচিত। তার কর্মক্ষেত্র মূলত ব্রিসবেন। কিন্তু এর বাইরেও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, যেমন- উত্তর স্ট্র্যাডব্রুক আইল্যান্ড, কুইন্সল্যান্ডের মতো বিভিন্ন সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে ছবি তোলার জন্য চষে বেড়িয়েছেন। এসব অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতিগত জীববৈচিত্র্য, পরিযায়ী পশু-পাখিদের দেশান্তরের কাহিনী তার ফটোগ্রাফির মূল বিষয়বস্তু। বিশ্বজুড়ে জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্যময় প্রাণীকূলে এর প্রভাব অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে উঠে এসেছে তার ক্যামেরায়।

কারেন লুনির এক অসাধারণ ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি; Image Source: photoawards.com

স্টেফানো আনথারিতিনার, ইতালি    

স্টেফানো আনথারিতিনারকে সর্বকালের সেরা ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের একজন হিসেবে ভাবা হয়। মাত্র ১৭ বছর বয়স থেকে তিনি এটা করে আসছেন। প্রাণীবিজ্ঞানে করেছেন পিএইচডি। বর্তমানে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একজন গুরুত্বপূর্ণ ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রকৃতির সাথে বন্যপ্রাণী এবং বনে বাস করা মানুষের মধ্যকার যে নিবিড় সম্পর্ক তা-ই ফটোগ্রাফির বিষয়বস্তু হয়ে তার ক্যামেরার লেন্সে ধরা দিয়েছে। লেখক হিসেবেও তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেছেন।

স্টেফানো আনথারিতিনার; Image Source: tourmyindia.com

তার ফটোগ্রাফির নানা বিষয়ই তার লেখার মূল উপাদান। প্রকৃতিতে যে প্রতিনিয়ত ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে এবং জীববৈচিত্রে তার নানা প্রভাব সম্পর্কে তিনি সবসময় উচ্চকন্ঠ। তার এই গভীর উৎকন্ঠার বিষয়টি যেমন উঠে এসেছে তার লেখায়, তেমনই তার ছবিগুলোতেও তা দৃশ্যমান। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে ‘The Night of the Bears’, ‘Diary of a Wildlife Photographer in the Finnish Taiga’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২০০৮, ২০১১ এবং ২০১৬ সালে ইতালিয়ান ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে সবচেয়ে বেশি পুরস্কার লাভ করেছেন স্টেফানো।

ভাল্লুকদের জীবনযাত্রার এক অনবদ্য ছবি উঠে এসেছে স্টেফানোর ক্যামেরায়; Image Source: Pinterest

অঞ্জন লাল, ভারত

অঞ্জন লাল একজন ভারতীয় বন্যপ্রাণী বিষয়ক আলোকচিত্রী। প্রকৃতির প্রতি তার ভালবাসা ফুটে উঠেছে বিভিন্ন সময়ে তোলা ছবিতে। তার ছবির বিষয়বস্তু প্রাকৃতিক বনাঞ্চল এবং সেখানে বসবাসরত বন্যপ্রাণী। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি করতে ভারত ছাড়াও কেনিয়া, তানজেনিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছেন। তার ক্যামেরায় উঠে এসেছে সেসব স্থানের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী, ফুল, পাখি আর প্রাণীদের বিভিন্ন মুহূর্তের অসাধারণ সব ছবি। 

ভারতীয় বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী অঞ্জন লাল ফটোগ্রাফির এক বিখাত সিরিজ ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’; Image Source: NaturesLens

সুজি ইসতারহেজ, যুক্তরাষ্ট্র

ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে সুজি ইসতারহেজ বেশ জনপ্রিয় এক নাম। তিনি মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় তার ফটোগ্রাফির উল্লেখযোগ্য কাজগুলো করেছেন। এ নিয়ে তার বিভিন্ন প্রকাশনাও রয়েছে। টাইম, স্মিথসোনিয়ান এবং বিবিসির ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে তিনি কাজ করেছেন।

সুজি ইসতারহেজ; Image Source: makeuseof.com

তার ফটোগ্রাফির বিষয়বস্তু হচ্ছে সারা বিশ্বের বন্যপ্রাণীরা। শুধু আফ্রিকাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গভীর সব জঙ্গলের বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে বন্যপ্রাণীদের নানা মুহূর্তের ছবি তুলে এনেছেন তিনি। হাতি থেকে বিরল প্রজাতির রেড ট্রি ফ্রগ কিংবা উড়ন্ত শিকারী ঈগলের ছবি- সবই উঠে এসেছে তার ক্যামেরায়।

সুজি ইসতারহেজের একটি অনবদ্য কাজ; Image Source: Fine Art America

অ্যালান ম্যাক ফাদায়েন, স্কটল্যান্ড

স্কটল্যান্ডের অধিবাসী অ্যালান ম্যাক ফাদায়েন তার ৬ বছরের ফটোগ্রাফি ক্যারিয়ারে মোট ছবির সংখ্যা ৭ লাখ ২০ হাজার ছবি তুলেছেন। কিন্তু তিনি মনে করেন, পারফেক্ট শটটি তুলেছেন তিনি সম্প্রতি। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিই তার প্যাশন। তার কথায়, তিনি দীর্ঘ ছয় বছর চেষ্টা করে গেছেন এমন একটি ছবি তোলার জন্য যা তার ফটোগ্রাফি জীবনকে সার্থক করে তুলবে। চেষ্টার পর চেষ্টা করে গেছেন। অপেক্ষা করেছেন হাজার হাজার ঘন্টা। 

স্কটল্যান্ডের আলোকচিত্রী অ্যালান ম্যাক ফাদায়েন; Image Source: powerful.tv

অবশেষে তার লেন্সে ধরা পড়লো সেই বিরল মুহূর্ত, জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরছে মাছরাঙা। সেই ‘ডুব’ দেয়ার ছবিটাই তুলতে চেয়েছিলেন অ্যালান। অবশেষে দীর্ঘদিনের চেষ্টা আর ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে সফলকাম হলেন। মাছরাঙার জীবন নিয়ে ছবি তোলার বিষয়টির সাথে জড়িয়ে রয়েছে তার ছোটবেলার এক স্মৃতি। একদিন দাদুর সাথে গ্রামের মেঠো পথ ধরে হাঁটছিলেন কিশোর অ্যালান।

অ্যালানের লেন্সে ধরা পড়া সেই অসাধারণ মুহূর্তের ছবি ‘জলে ডুব দিয়ে মাছ ধরছে মাছরাঙা’; Image Source: Pinterest

হঠাৎই তার চোখে ধরা পড়লো জলের মধ্যে মাছরাঙা পাখিকে ডুব দিতে এবং কয়েক মুহূর্ত পরই সেই মাছরাঙা জলের মধ্য থেকে মুখে মাছ নিয়ে উঠে আসছে। সেই ছবিটাই অ্যালানের মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। তারপর থেকেই চেষ্টা। দিনে পাঁচবার করে জলে ঝাঁপ দেয় মাছরাঙা। আর প্রতিদিনই সেরকম পাঁচটা করে শট তোলার চেষ্টায় থাকতেন অ্যালান।

তেইজি সাগা, জাপান

তেইজি সাগার গল্পটাও বেশ মজার। হাঁসের ছবি তুলে পৃথিবী বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের এই আলোকচিত্রী। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে বহির্বিশ্বে তার পরিচিতি পাওয়ার গল্পটিও বেশ আকর্ষণীয়। তিনটি রুম নিয়ে জাপানের এক ব্যস্ততম জায়গায় চমৎকার চলছিল তেইজির ফটোগ্রাফি ব্যবসা। মানুষের ছবি তুলে তার আর ভালো লাগছিল না। হঠাৎই মনে হলো, জীবনের আনন্দ খুঁজে পেতে হবে অন্যভাবে।

আর তখনই ৪০ বছর বয়সে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফির কথা ভাবতে শুরু করেন তেইজি সাগা। একদিন টেলিভিশনে দেখলেন একঝাঁক উড়ন্ত হাঁসের ছবি, আর এই ছবি দেখার সাথে সাথে সাগা তার ফটোগ্রাফির বিষয়ও নির্বাচন করে নিলেন। আর অন্য কোনো ছবি নয়, শুধু  হাঁসের ছবিই এখন থেকে ক্যামেরাবন্দী করতে হবে।

সেদিনই ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লেন হাঁসেদের খোঁজে। সেই শুরু। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দুর্দান্ত শীতের দাপট সহ্য করে ক্যামেরার ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে একমনে দেখে যেতেন হাঁসেদের গতিবিধি।

হাঁসের ছবি তুলে বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের আলোকচিত্রী তেইজি সাগা; Image Source: japantimes.co.jp

১৯৭১ সালে তেইজি সাগা যোগ দিলেন এক আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। এরপর তার ছবির একটি সুন্দর বইও প্রকাশিত হয়, নাম ‘Swans’। বইটি পরে বেশ জনপ্রিয়ও হয়। তবে বিশ্বে তখনও তার নামটি এতটা পরিচিতি পায়নি। হয়তো তিনি একজন নিতান্ত সাধারণ শৌখিন ফেটোগ্রাফারই থেকে যেতেন। সারা বিশ্বের নজর তার দিকে পড়তো না। হঠাৎ এক ছোট ঘটনাই তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

সাগার সাফল্যের চাবিকাঠি হলো সুইডেনে তৈরি তার হ্যাসেল ব্লাড ক্যামেরাটি। এই দুষ্প্রাপ্য আর দামী ক্যামেরাটি সাগার দীর্ঘ ৩০ বছরের সঙ্গী। কেবলমাত্র জাপানের পেশাদার আলোকচিত্রীরাই এই ক্যামেরা ব্যবহার করতেন। হঠাৎ ক্যামেরাটি খারাপ হয়ে যায়। একে সারাবার চেষ্টা করে কোনো কাজ না হওয়ায় তিনি সুইডেনে হ্যাসেল ব্লাড ক্যামেরার হেড অফিসে সেটি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ক্যামেরার সাথে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠির সাথে জুড়ে দিলেন ঐ ক্যামেরাতেই তোলা হাঁসের কয়েকটা ছবি। তিনি চিঠিতে লিখলেন, ক্যামেরাটি যেন সঠিকভাবে সারানো হয়, যাতে তিনি আবার হাঁসের ছবি তোলা শুরু করতে পারেন।

তেইজি সাগার তোলা হাঁসদের ছবি; Image Source: pixels.com

হ্যাসেল ব্লাডের প্রেসিডেন্ট সাগার তোলা ছবি দেখে এত খুশি হলেন যে, তিনি কেবল ক্যামেরাটি সারিয়েই দিলেন না, সাগাকে পাঠালেন আরেকটি নতুন ক্যামেরা। সুইডেনে এসে হাঁসেদের ছবি তোলার জন্যও তাকে আমন্ত্রণ জানালেন। সাগা যেন হাতে চাঁদ পেলেন।

হাঁসেরা শীতে জাপানে তাদের বাসা তৈরি করে আর গরমে সাইবেরিয়াতে বাচ্চাদের পালন করে। ১৯৮১ সালে উত্তর সুইডেনের জলাভূমিতে হাঁসেদের খোঁজে ঘুরে বেড়ালেন সাগা। তিন মাস নিজের কাজের মধ্যে ডুবে রইলেন তিনি। এতদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের যোগ্য মূল্য তিনি পেলেন যখন তার ছবিগুলো ‘হ্যাসেল ব্লাড পি. আর. ম্যাগাজিন’- এ প্রকাশিত হলো।

১৯৮৮ সালে আমেরিকার ‘লাইফ ম্যাগাজিন’ এর ৭ পাতা জুড়ে বের হলো সাগার হাঁসের ছবি। ১৯৯০ সালে জার্মানির এক বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা সাগার কাজের ওপর সুন্দর একটি বই প্রকাশ করলো। এই সময়েই লাইফ ম্যাগাজিন থেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাতজন ন্যাচার ফটোগ্রাফারের মধ্যে বিবেচিত হলো সাগার নাম। সাগা হলেন সেই মানুষ, যার ছবি নিয়ে লাইফ ম্যাগাজিনের বিচারকদের মধ্যে কোনো বিতর্ক ওঠেনি।

ফিচার ইমেজ- Pinterest.com

Related Articles