যদি কখনো ঘুম থেকে উঠে মনে হয় সকালটা একটু ম্যাড়ম্যাড়ে, পাখিরাও যেন ঠিক মিষ্টি সুরে গাইছে না, সুয্যি মামাও বুঝি বিরক্ত হয়ে আজ একটু নিচে দাঁড়িয়ে আছে- তাহলে ধরে নিতে হবে ডোয়াইন জনসন আজ সকালে ব্যায়াম করেননি!
কথাটা আপাতদৃষ্টিতে অত্যুক্তি মনে হলেও ‘প্রো রেসলার টার্নড সুপারস্টার’ খেতাবপ্রাপ্ত, বক্সিং রিং কাঁপানো ‘দ্য রকের’ টর্চার চেম্বার দেখলে অবলীলায় তা বিশ্বাস করে ফেলতে ইচ্ছে করবে যে কারো। প্রায় ৪৫ হাজার পাউন্ডের সরঞ্জামাদি সম্বলিত ঘরোয়া জিমটিকে তিনি নিজেই নাম দিয়েছেন ‘আয়রন প্যারাডাইজ’ বা ‘লৌহস্বর্গ’। সূর্য ওঠার আগেই ডোয়াইন জনসনকে খুঁজে পাওয়া যায় এই টর্চার চেম্বাররুপী জিমে।
অবশ্য এক সকালের শরীরচর্চা বিসর্জন দিয়ে ‘স্কয়ার মাইল’কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জীবনের গল্পের ঝুলি খুলে বসেছিলেন ৪৬ বছর বয়সী এই তারকা। সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত তারকার খেতাব পাওয়ার পর তার অনুভূতি কী জানতে চাইলে বলেন, “মাত্র ৭ ডলার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কর্মজীবন শুরু করে আমি যদি আজ এই পর্যন্ত আসতে পারি, তবে বাজি ধরে বলতে পারি যে কেউ আন্তরিকতার সাথে চেষ্টা করলে অবশ্যই সফল হতে পারবে”। আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর এই তারকার কথা শোনা যাক তার মুখ থেকেই।
স্কয়ার মাইল: আপনাকে যখন ‘হারকিউলিস’ চরিত্রে উপস্থাপন করা হলো, পর্দার পেছনের গল্প যারা দেখেছেন তারা জানেন, কতটা পরিশ্রম আপনি করেছেন। কোনো শর্টকাট না খুঁজে সোজা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চলে গিয়ে খুঁটিনাটি প্রতিটি জিনিস আয়ত্ত্ব করেছেন। অনেকেই তখন আপনার এই আইডিয়াকে সেকেলে বলে নাক সিটকেছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগে একটি চরিত্রের জন্য কাউকে এত কসরত করতে সাধারণত দেখা যায় না। আপনি কেন এই বন্ধুর পথ বেছে নিলেন?
ডোয়াইন জনসন: যখন শুনলাম ‘হারকিউলিস’ চরিত্রের জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়েছে, তখন থেকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করব যাতে দর্শক বলতে বাধ্য হয়, এমন হারকিউলিস আগে কখনো দেখিনি। আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার, স্টিভ রিভস বা আমার মতো যারা বডিবিল্ডিং বা অ্যাথলেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে এসেছে, তাদের পর্দায় দেখতে ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু অভিনয়ের ব্যাপার কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। এই প্রশ্ন যেন কেউ তুলতে না পারে, সেজন্য নিজেকে পুরোদমে প্রস্তুত করেছিলাম।
স্কয়ার মাইল: বিশ্বের সর্বাধিক পারিশ্রমিক প্রাপ্ত অভিনেতা- এই অবস্থানটিকে কি আপনার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বা বহুল আরাধ্য মাইলফলক বলে মনে করেন?
ডোয়াইন জনসন: এই অবস্থানে আসতে পেরে নিঃসন্দেহে আমি খুবই উল্লসিত এবং আত্মতুষ্ট। তবে এমন কিছু একটা হতেই হবে সেই লক্ষ্যে কিন্তু কখনো আগাইনি। আমার আজকের অবস্থানের পেছনে রয়েছে নিজের প্রতি বিশাল মাপের আত্মবিশ্বাস আর জীবনে সফল হওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। রাস্তা থেকে উঠে এসে নিজেকে তৈরি করতে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি। হলিউডে একটা কাজ পেতে এমন সব অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে, যা শুনলে অবাক হয়ে যাবেন। সেগুলো তখন আমলে নেইনি। একবার প্রতিষ্ঠিত হতে পারলে চিত্র পাল্টে যাবে জানতাম। যারা এখনো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন, তারা একবার আমার দিকে তাকান। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আত্মবিশ্বাস একজন মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, তার জলজ্ব্যান্ত উদাহরণ আমি।
স্কয়ার মাইল: আজকাল তো প্রায় সব ধরনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করছেন। কেভিন হার্টের সাথে ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স’ নামক অ্যাকশন কমেডিতে দেখা গেছে আপনাকে। মোয়ানাতে অ্যানিমেটেড চরিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন। এরপর অভিনয় করলেন ‘বেওয়াচ’ মুভিতে। আপনি কি স্বেচ্ছায় শুধু অ্যাকশনভিত্তিক ফিল্ম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন?
ডোয়াইন জনসন: আমি সবসময়ই বিশ্বাস করি সব ধরনের চলচ্চিত্রে আমার অংশগ্রহণ করা উচিত, সেটা কমেডি হোক আর পারিবারিক মুভিই হোক। অভিনেতা হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাতে চাইলে কেবল অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় আটকে থাকলে চলবে না। কমেডি সিনেমায় অভিনয় করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছি, কেননা হাসতে এবং হাসাতে আমি ভীষণ ভালোবাসি। যেকোনো ব্যক্তির মধ্যে ইতিবাচক উদ্দীপনা থাকাটা খুব জরুরি। আমার এই উদ্দীপনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নানা ফরম্যাটের সিনেমায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
স্কয়ার মাইল: শিশুদের সাহায্যার্থে প্রায়ই আপনাকে হাত বাড়িয়ে দিতে দেখা যায়। বাচ্চাদের জন্য এই ভালোবাসা থেকেই কি ‘মোয়ানা’ চলচ্চিত্রে কাজ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন?
ডোয়াইন জনসন: এর আগেও আমি পারিবারিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি, তবে এই সিনেমাটি খুব স্পেশাল ছিল। ডিজনির লোকজনের সাথে প্রথমবারের মতো কাজ করার অভিজ্ঞতা অসাধারণ ছিল। শিশুরা সপরিবারে উপভোগ করতে পারবে- এমন একটি চলচ্চিত্রের অংশ হতে পেরে আমি খুবই খুশি। চলচ্চিত্রটিতে যে ‘আলোহা স্পিরিটের’ কথা বলা হয়েছে, পলিনেশীয় সংস্কৃতির এই বিশ্বাসটি আমার মধ্যেও কাজ করে। হাওয়াই বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেড়াতে গেলেই কোত্থেকে যেন এক তীব্র চাঞ্চল্য আমার ভেতরে অনুরণন তোলে। সিনেমাটিতে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম এখানকার দাদী চরিত্রটির মাঝে লুকিয়ে আছে আমার দাদী। বিষয়টি এতটাই আমার মন ছুঁয়ে যায় যে ‘মোয়ানা’ সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে আমি যতটা কেঁদেছি, এমনটা আমার পুরো ক্যারিয়ারে আর কখনো হয়নি। খুব বিশেষ এক অনুভূতি জড়িয়ে আছে ‘মোয়ানা’কে ঘিরে।
স্কয়ার মাইল: কেমন ছিল আপনার হাইস্কুলের দিনগুলো?
ডোয়াইন জনসন: খুব একটা মধুর স্মৃতি নেই সে সময়কার। আমি তখন নিজের পরিচয় নিয়ে, অস্তিত্ব নিয়ে রীতিমতো লড়াই করছি। আমি কে, কী হতে চাই- এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম পাগলের মতো। কাজেই স্কুলে বেশ বেপরোয়াভাবে চলতাম, ১৫-১৬ বছর বয়সে অসংখ্যবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে আমাকে। সবকিছু কেমন এলোমেলো আর খাপছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। সে সময় খেলাধুলাই আমাকে নতুন করে পথ দেখায়। জীবনে ফোকাস করার মতো কিছু একটা খুঁজে পেলাম অবশেষে, বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলাম।
ঐ বয়সী প্রতিটি বাচ্চাই আসলে এমন কিছু অনুপ্রেরণা হাতড়ে বেড়ায়, সেই অর্থে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলেই মানি। হাইস্কুলের শেষ বর্ষে মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম, জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হলো আমার দল। বডিবিল্ডিংকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই, আমার আত্মমর্যাদাবোধ ফিরিয়ে আনতে, জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে বডিবিল্ডিংয়ের কাছে কৃতজ্ঞ আমি। আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার আর সিলভেস্টার স্ট্যালনের মতো মডেলিং করার চেষ্টা করলাম। তাদেরকে দেখেই সিনেমা জগতে আসার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম।
স্কয়ার মাইল: ডব্লিউডব্লিউই-তে যখন স্বর্ণালি সময় কাটাচ্ছিলেন, তখনো কি মাথায় হলিউড জয়ের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল?
ডোয়াইন জনসন: অভিনেতা হওয়া আমার স্বপ্ন ছিল। ‘রকি’ সিনেমাটি আমার জীবন বদলে দিয়েছে, সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র আমার রোল মডেল বনে গেছে। রেসলিংকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। এটি আমার রক্তে মিশে আছে (ডোয়াইনের বাবা ছিলেন রেসলার)। রেসলিংয়ে নাম করতে পারলে সহজেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়, সেভাবেই হয়তো একদিন হলিউডের দুয়ার আমার জন্য খুলে যাবে- এমনটাই ছিল চিন্তা-ভাবনা। ২০১৪ সালে ‘হারকিউলিস’ সিনেমার প্রস্তাব পাওয়ার অনেক আগে থেকেই নিজেকে হারকিউলিসের মতো করে তৈরি করছিলাম, কিন্তু কেউ আমাকে সিরিয়াসলি নেয়নি।
‘দ্য মামি রিটার্নস’ (২০০১) আর ‘দ্য স্করপিয়ন কিং’ (২০০৩) সিনেমাগুলোতে খুব কষ্টে নিজের জায়গা করে নিয়ে আস্তে আস্তে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। বোঝার চেষ্টা করছিলাম বাণিজ্যটা আসলে কী করে হয় আর এই বাণিজ্যে টিকতে হলে কী করতে হবে। সেখান থেকেই ‘বি কুল’ আর ‘গেট স্মার্ট’ সিনেমায় কাজ করা, কমেডি স্বভাবসুলভভাবেই আমার ভেতরে কাজ করে বলে ভালো কিছুই হবে জানতাম।
স্কয়ার মাইল: লাখো লাখো উৎসুক জনতার সামনে রেসলিংয়ের মঞ্চে আবির্ভূত হওয়ার দিনগুলো কি আর কখনো মিস করবেন? নাকি অভিনয় করে দিন কাটিয়ে দেয়াই বেশ সহজ-সাধারণ মনে হচ্ছে?
ডোয়াইন জনসন: অসংখ্য দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে রেসলিংয়ে অংশ নেয়া এক অনন্য সাধারণ অনুভূতি, ভাষায় তা ব্যক্ত করা যাবে না। রিংয়ে দাঁড়ালেই এমন অবিশ্বাস্য শক্তি আপনার উপর ভর করবে যা কল্পনাই করতে পারবেন না। শারীরিকভাবে খুব বেশি পরিশ্রম হলেও বিষয়টি খুব রোমাঞ্চকর। অভিনয় সেখান থেকে একেবারেই আলাদা। আবেগ-অনুভূতির মিশেলে এমন সব চরিত্রে আপনাকে হাজির হতে হবে, বাস্তব জীবনে যার সাথে আপনার কোনো সম্পর্কই নেই। রুপালি পর্দায় কখনো আমি প্রেমে পড়ি, কখনো হাসি, কখনো কাঁদি। আর বক্সিংয়ের রিংয়ে প্রতিপক্ষকে মেরে ভর্তা বানানোই হয় একমাত্র কাজ।
স্কয়ার মাইল: দুটি বাচ্চা আছে আপনার, জেসমিন আর সাইমন। বাবা হিসেবে নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ডোয়াইন জনসন: আসলে নিজেকে বুঝতে, জীবন থেকে তারা কী চায় তা বুঝতে অনেকটা সময় লেগে যায় ছেলেদের। ধীরে ধীরে আপনি উপলব্ধি করেন, ‘ওহ, এটাই তাহলে আমি। এই কাজটিতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি’- আর তারপর শুরু হয় একের পর এক স্বপ্নের ডালি খুলে পরীক্ষা করা কোথায় লুকিয়ে আছে সেই কাঙ্ক্ষিত সাফল্য। সেখান থেকেই আসতে থাকে আত্মবিশ্বাস। বয়স যত বাড়তে থাকে, অনুভূতিগুলো তত পরিণত হতে থাকে। বাবা হিসেবেও ঠিক একইরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।
স্কয়ার মাইল: বাচ্চাদের জন্য কী উপদেশ দিতে চান?
ডোয়াইন জনসন: প্রথম কথাই হচ্ছে, নিজের উপর থেকে কখনো বিশ্বাস হারানো যাবে না। নিজেকে বোঝাতে হবে মন যা চাচ্ছে, তা করার যোগ্যতা আমার আছে। চারপাশ থেকে প্রচুর বাধা আসবে, সেসবের পরোয়া না করার জন্য নিজেকে যথেষ্ট শক্ত হতে হবে। স্বপ্ন অর্জনের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে হবে, মাথার ভেতরে যে কণ্ঠটি কথা বলে তাকে কখনো উপেক্ষা করা যাবে না।
ফিচার ইমেজ-health.com