হালিমের নাম শুনলে জিভে জল চলে আসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। বিশেষ করে পবিত্র মাহে রমজানে অনেকের ইফতার যেন হালিম ছাড়া পূর্ণতাই পায় না। জিভে জল আনা মজাদার হালিম খেতে খেতে আমাদের সকলের মনেই কখনও না কখনও প্রশ্ন জেগেছে- কোথায় উৎপত্তি হয়েছিল সুস্বাদু হালিমের? কারাই বা উদ্ভাবন করেছিল এই অসাধারণ খাবারটি? সেসব প্রশ্নের উত্তর এবং হালিমের ইতিবৃত্ত নিয়ে সাজানো হয়েছে এই ফিচারটি।
হালিমের উৎপত্তির কথা
কাবাব, বিরিয়ানী এবং অন্যান্য মোগলাই খাবারের মতো হালিমেরও উৎপত্তি হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে। রন্ধন ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া রডেনের মতে মধ্যপ্রাচ্যের হারিশা নামক এক ধরণের ডাল ও মাংসের মিশ্রণ জাতীয় খাবার থেকে উৎপত্তি হয়েছে উপমহাদেশের হালিম খাবারটি। হারিশা ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়ামেন ও আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছে উপাদেয় একটি পদ। তবে লেভান্ত অঞ্চলে অর্থাৎ বর্তমান সিরিয়া ও লেবাননে বহুযুগ আগে থেকে খ্রিস্টানরা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হারিশা বিশেষভাবে রান্না করতেন অনেকটা বাংলাদেশে লাইলাতুল বরাতে হালুয়া রুটি তৈরির মতো।
শুধু তাই নয় লেবাননে জন্ম নেওয়া লন্ডনপ্রবাসী প্রখ্যাত রন্ধন বিশেষজ্ঞ আনিসা হেলউ তার Lebanese Cuisine (1994) গ্রন্থে লিখেছেন, লেভান্তে গরিবদের একসাথে খাওয়ানোর জন্য বড় ডেকচিতে হারিশা রান্না করা হত, যার তুলনা করা যেতে পারে এখনকার দিনে আমাদের দেশের কাঙ্গালি ভোজের খিচুড়ির সাথে। অন্যদিকে স্পেনের ইহুদিরা তাদের সাপ্তাহিক পবিত্র দিন সাবাথ বা শনিবারে হারিশ রান্না করতেন। তবে হারিশার সবচেয়ে পুরনো লিখিত রেসিপি পাওয়া যায় খ্রিস্টীয় দশম শতকের দিকে বাগদাদে কিতাব আল তাবিখ (The book of recipes) নামের রান্নার বইতে। এই বইটিতে সংকলন করা হয়েছিল তৎকালীন রাজা বাদশাহদের খাবার টেবিলের উপাদেয় বেশ কিছু খাবারের রন্ধনপ্রণালী। বইটির লেখক আবু মুহাম্মদ আল মুজ্জাফর ইবন সায়ার। এমনকি ইবন বতুতার ভ্রমণ কাহিনীতেও তিনি উল্লেখ্য করেছেন পারস্যে ডাল, ঘি এবং গোশত দিয়ে রান্না করা হারিশার কথা।
সে যা-ই হোক, মধ্যপ্রাচ্যের সেই হারিশাই কালক্রমে ভারতীয়করণ হয়ে আজকের হালিমে রূপ নিয়েছে। তবে হারিশার ভারতীয় নাম হালিম কেন হলো? এই সওয়ালের বহু জওয়াব বাজারে প্রচলিত থাকলেও সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হলো, স্লো কুক ডিস হালিম রান্না করতে দরকার প্রচুর সময় ও ধৈর্যের। আরবিতে হালিম শব্দের অর্থ হলো ধৈর্যশীল। হয়ত সেখান থেকেই নামকরণ করা হয়েছে হারিশার ভারতীয় সংস্করণ হালিমের। তবে নিশ্চিতভাবে একথা বলার কিন্তু উপায় নেই।
যেভাবে হালিম এলো ভারতে
অনেক ঐতিহাসিক বলেন, ভারতে হারিশার আগমন মুঘলদের মাধ্যমে। দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের আমলে ভারতে হারিশার আগমন হলেও হারিশা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় হুমায়ূনের পুত্র সম্রাট জালাউদ্দিন আকবরের আমলে। সম্রাট হুমায়ূনের সাথে পারস্যের সাফাভি সাম্রাজ্যের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, তাই বলা যায় পারস্য হয়ে হারিশা ভারতে এসেছিল। আকবরের শাসন আমলে লিখিত আইন-এ-আকবরী গ্রন্থে পাওয়া যায় হারিশার কথা। তবে ভারতবর্ষে আরব বণিক ও ইসলাম প্রচারকদের আগমন সেই রাসুলুল্লাহ হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর সময় থেকেই। তাই আরবদের হাত ধরে যে ভারতে হারিশা এসেছিল সেকথাও অস্বীকার করবার জো নেই। তবে যাদের হাত ধরেই আসুক, ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র অর্থাৎ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হালিম সমান জনপ্রিয়।
হায়দ্রাবাদী হালিম
হায়দ্রাবাদী হালিমের বর্ণনা না দিলে হালিমের এই উপাখ্যান হয়ত অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। বিরিয়ানীর মতো হায়দ্রাবাদী হালিমও সুবিখ্যাত। ভারতবর্ষে হালিম জনপ্রিয়করণের পেছনে হায়দ্রাবাদী হালিমের অবদান অনস্বীকার্য। ইতিহাসবিদগণে মতে হায়দ্রাবাদের নিজামদের আরব সৈন্যরাই নাকি হারিশা এনেছিল হায়দ্রাবাদে। তারপর বাকিটা ইতিহাস। তবে আধুনিককালে অর্থাৎ বিংশ শতকে হালিম জনপ্রিয়করণে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন যে মানুষটি তার নাম সুলতান সাইফ নাওয়াজ জং বাহাদুর। ইয়েমেনী জমিদার সুলতান সাইফ ছিলেন হায়দ্রাবাদের নিজামদের দরবারের খানদানি আমির ওমরাহ্দের একজন। তাঁর বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত মেহমানদের খাদ্য তালিকায় নিয়মিত স্থান পেত তার মাতৃভূমি ইয়েমেনের হারিশা। তবে ইয়েমেনের হারিশা ততদিনে ভারতীয় মশলার ছোঁয়া পেয়ে পরিণত হয়ে গেছে আজকের হালিমে।
নিজামদের যুগ অবসান হওয়ার পর ১৯৫০ এর দশকে হায়দ্রাবাদের ইরানি খাবার হোটেলগুলোতে সর্বপ্রথম হালিম বিক্রি শুরু হয়। তখন এক বাটি হালিমের দাম ছিল মাত্র ৩ পয়সা। মজার ব্যাপার হল, হালিমের ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান পেটেন্ট অফিস হায়দ্রাবাদী হালিমকে প্রথম ননভেজ খাবার হিসাবে পেটেন্ট দিয়েছে। অর্থাৎ ভারতে কেউ হায়দ্রাবাদী হালিম নামে কোনো হালিম বিক্রি করতে চাইলে তাকে নির্দিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড মেনে হালিম বানাতে হবে। নচেৎ ঐ নামে হালিমের ব্যবসা করা চলবে না।
যেভাবে তৈরি করা হয় হালিম
হালিমের মূল উপাদান বিভিন্ন রকমের ডাল, গম, বার্লি, সুগন্ধি চাল এবং গোশত। প্রথমে বিভিন্ন ডাল ৬-৮ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। তারপর সেই ডাল, চাল ও গম ভালোভাবে সেদ্ধ করে নিতে হয়। এদিকে পরিমাণমত পেয়াজ বাটা, রসুন বাটা, আদা বাটা, এলাচ, মরিচ গুড়ো, হলুদ গুড়ো, দারুচিনি ও গরম মশলা সমেত আলাদা পাত্রে গোশত ভালোভাবে কষিয়ে নিতে হয়। তারপর ভালোভাবে মিহি করে নেওয়া সেদ্ধ ডাল, চাল ও গম কষানো মাংসের সাথে মিশিয়ে এর সাথে পরিমাণমত পানি ও লবণ যোগ করে প্রায় ঘন্টাখানেক নাড়তে হয়। তারপর তৈরি হয় সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হালিম।
পরিবেশনের সময় সাথে যোগ করা হয় পেয়াজের বেরেস্তা, সবুজ ধনেপাতা, আদা, কাঁচা মরিচ ও লেবু। তবে স্থানভেদে এবং রাঁধুনিভেদে হালিমের রেসিপি ভিন্ন রকম হতে পারে। রেসিপি যাই হোক, হালিমের মূল উপাদান যে বিভিন্ন রকমের ডাল ও গোশত সেটা সব জায়গায় প্রায় একই রকম থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের হারিশার সাথে ভারতবর্ষের হালিমের মূল পার্থক্যটাই হল মশলার ব্যবহারে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য খাবারগুলোর মতোই হারিশাতে মশলা ব্যবহার করা হয় তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু ভারতবর্ষে মশলার সমারোহ এবং জনপ্রিয়তার কারণে হালিমও হয় বেশ মশলাদার।
হালিমের দেশীয় রূপ টাঙ্গাইল ও জামালপুরের ম্যান্দা
ভারত ও পাকিস্তানে হালিম নান রুটি দিয়ে খাওয়া হয়। আধুনিককালে আমাদের দেশেও নান রুটির প্রচলন দেখা যাচ্ছে। তবে ভেতো বাঙালি ভাতের সাথে খাওয়ার উপযোগী হালিমের একটা দেশীয় ভার্সন উদ্ভাবন করেছে যেটা টাঙ্গাইল ও জামালপুর জেলায় ম্যান্দা বা পিঠালি নামে জনপ্রিয়। রন্ধনপ্রণালী অনেকটা হালিমের মতো হলেও ম্যান্দায় ডালের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় চালের গুঁড়া। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কলার পাতা বিছিয়ে সকলে একত্রে ম্যান্দা ভাত খাওয়ার সংস্কৃতি এই অঞ্চলে বেশ পুরনো।
হালিমের বৃত্তান্ত এই ফিচারে খুব সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। যদিও সুস্বাদু হালিমের উপাখ্যান কয়েক হাজার পাতা লিখলেও যেন মন ভরবে না। তবে লেভান্তাইন হারিশা কীভাবে আমাদের ভারতবর্ষে হালিম নামে বিবর্তিত হল, সে ইতিহাস যে বেশ আকর্ষণীয় সেটা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়। হালিমের স্বাদের মতো সেই ইতিহাসও এক কথায় চমৎকার!