সিঙ্গাপুরকে চেনার মতো ভালো ভালো ব্যাপারের কোনো অভাব নেই। আকাশছোঁয়া দালান, আন্তর্জাতিক মানের সম্মেলন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য- এমন আরো অনেক কারণেই আপনি সিঙ্গাপুর ঘুরে আসতে পারেন। তবে আরেকটি কারণে এই দেশটি ঘুরে আসতে পারেন। সেটি হলো সালাদ! সালাদ যে সিঙ্গাপুরের অন্যতম বড় একটি ঐতিহ্য আর আকর্ষণের জায়গা সেটা অনেকেই জানেন না। দেশটিতে প্রতি চাইনিজ নববর্ষে তৈরি হওয়া এই বিশেষ সালাদটি খুঁজে পাওয়া যাবে প্রতিটি রেস্তোরাঁয়। নিজস্ব উপাদান, মশলার মিশেলে তৈরি এই সালাদ এক কথায় অনন্য!
সালাদটির নাম ‘ইউ শেং’। প্রধান উপাদান মাছ হওয়ায় ‘ইউ’ বা মাছ এবং ‘শেং’ বা কাঁচা/জীবন- এই দুটো শব্দের মিশেলে তৈরি হয়েছে নামটি। সাধারণ কিছু নয়, একরকম সিঙ্গাপুরের জন্য কিংবদন্তী এই সালাদ। চীনের এক স্বামী-স্ত্রীর গল্প জড়িয়ে আছে এই সালাদের সাথে। তাই এর শিকড় চীনে, এমনটাও বলা হয়। একবার খুব বড় এক ঝড়ের সময় আটকা পড়ে চীনা এই দম্পতি। হাতের কাছে আর কিছু না থাকায় মাছ আর ভিনেগার দিয়েই নিজেদের পেট ভরিয়েছিলেন তারা। অনেকের মতে, চীনে গুয়াংঝু প্রদেশের জেলেরা চীনা নববর্ষের সপ্তম দিনে ‘হিউম্যান ডে’ বা মানুষের জন্ম নেওয়ার উৎসব উপলক্ষ্যে এই সালাদ খাওয়া শুরু করে।
অবশ্য চীন থেকে ১৯৩০ সালে এই সালাদ যখন মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে আসে, তখন এর এত জাঁকজমক ছিল না। রাস্তার ধারে ছোট ছোট দোকানে তখন হয় জিয়াংম্যান স্টাইলে এই সালাদ তৈরি করা হতো। কাঁচা মাছ, কুঁচি করা আদা, লেটুস পাতা এবং বিশেষভাবে প্রস্তুত করা পেঁয়াজ বা টেওচিউ স্টাইল যেখানে ক্রেতা লেটুস পাতা ব্যবহার করে পুরো সালাদটিকে মুড়িয়ে নিতে হয়। যদিও এটি সবসময় রেস্তোরাঁয় থাকতো, তবে মানুষ এই সালাদটি সবচাইতে বেশি গ্রহণ করতো মানুষের জন্ম নেওয়ার দিনে। সালাদটিকে সৌভাগ্যে মোড়া খাবার মনে করা হতো সেসময়!
সালাদ তখন পর্যন্ত এমনই ছিল। ১৯৪০ এর দিকে লোক চিং ফ্যাট সেরেম্বান প্রথম মালয়েশিয়ায় ইউ শেং-এর উন্নত ও মূল ধারাটি আবার ফিরিয়ে আনেন। এখন পর্যন্ত যা যা ভিন্নতা সালাদটিতে এসেছিল সেগুলো যতটা সম্ভব এই সময় এসে দূর করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে, ১৯৬৪ সালে সালাদটির নতুন এবং জমকালো এক ধাঁচ নিয়ে আসেন সিঙ্গাপুরের শেফরা। সেসময় এই শেফরা সিঙ্গাপুরে এত বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন যে, তাদেরকে ‘চারজন স্বর্গীয় রাঁধুনি’ নাম দেওয়া হয়। এই চারজন ছিলেন লাউইয়োক পুই, থাম উই কাই, হুই কুক ওয়াই এবং সিন লিওং। এদের মধ্যে লাউ এবং থাম মৃত্যুবরণ করেছেন। তবে ইচ্ছা করলেই এখনো ৯১ বছর বয়সী সিন এবং ৭৯ বছর বয়সী হুইকে খুঁজে পাবেন আপনি রিভার ভ্যালির পার্শ্ববর্তী রেড স্টার রেস্টুরেন্টে।
অবশ্য শুরু থেকেই ইউ শেং নিয়ে কাজ শুরু করেননি এই চারজন। প্রথমে সিঙ্গাপুরের ক্যাথে রেস্তোরাঁয় শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করেন তারা। সেখান থেকে বেরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কাজ শুরু করেন। তবে তাদের ইচ্ছা ছিল কোনো একটি ব্যাপারকে জনপ্রিয় করে তোলা। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫ দিন ধরে চাইনিজ নববর্ষ পালিত হয়। আগে এসময় খাবার টেবিলে বিশেষ বিশেষ খাবার রাখতেন সবাই। সেই খাবারের তালিকায় ইউ শেংকে অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা করেন তারা। সাধারণত রাস্তার পাশের দোকানে ক্রেতা তার নিজের ইচ্ছানুসারে স্বাদ ও মশলা মেশাতে পারতেন সালাদে।
এই চার রাঁধুনি চিন্তা করেন ব্যাপারটিকে আরেকটু বাড়িয়ে পরিবার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার। পরিবারের সবাই মিলে যেন এই সালাদ মিশিয়ে নিতে পারে, এমনটা ভাবছিলেন তারা। সালাদ আগে যেমনভাবে তৈরি করা হতো সেটাই রাখার চেষ্টা করেন শেফরা। আগে যেখানে মিষ্টি এবং টক- দুই রকমের সস ব্যবহার করা হতো, সেখানে নতুন করে একটি সস তৈরি করা হয়। আর এই সসকেই নিজেদের সালাদের প্রাণ বলে মনে করেন তারা।
আর শেষ পর্যন্ত সালাদে থাকতো কমলা, মরিচের গুঁড়ো, স্যালমন মাছ, ভেজিটেবল অয়েল, পাম সস, ক্র্যকার্স এবং গুঁড়ো বাদাম। যাদের বেশিরভাগই খাবার হিসেবে সৌভাগ্যজনক বলে মনে করা হয়। এই প্রত্যেকটি উপাদান এসময় আলাদা আলাদা করে রাখা থাকতো। যাতে যে পরিবার সেটি নিচ্ছে তারা নিজেরাই পছন্দমতো সালাদটি মিশিয়ে নিতে পারে।
চিন্তাটি মাথায় আসতে খুব একটা সময় লাগেনি। তবে বাস্তবেই নিজেরা যেমনটা চাচ্ছিলেন তেমন কিছু তৈরি করতে বেশ সময় লেগে যায় এই চার শেফের। নতুন এই ইউ শেং ১৯৬৪ সালে লাই ওয়াহ রেস্তোরাঁয় রাখা হয়। বিশেষ করে উৎসবের ধারণাটি ইউ শেংকে সবার কাছে আরো বেশি পরিচিত করে তোলে। প্রতিটি উপাদানের সাথে সৌভাগ্যের সম্পৃক্ততা থাকায় সালাদ তৈরির ক্ষেত্রে আশীর্বাদস্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন পংক্তি বলা শুরু করেন উপস্থিত ভোজনরসিকরা। খুব দ্রুতই সিঙ্গাপুরের বাসিন্দারা নতুন এই খাবারটিকে ভালোবেসে ফেলে। আর বন্ধু ও পরিবারের মানুষদেরকে নিয়ে ছোট ছোট উৎসবের আয়োজন করতে শুরু করে ইউ শেং-এর সাথে।
সময়ের সাথে সাথে সালাদটির পরিচিতি আর ভিন্নতা বাড়তে থাকে। ১৯৭০ সাল থেকে আকৃতি বেড়ে যাওয়ায় সালাদের পাত্রে এরপর থেকে চপস্টিক ব্যবহার করা শুরু করে সবাই। সালাদের চুড়া যতো বড় হবে, ততই সৌভাগ্য বৃদ্ধি পাবে- এমনটাই বিশ্বাস করা হতো। এসময় ‘লো হেই’ বলে সময়তা উদযাপন করার পদ্ধতি শুরু হয়। আর সেই যে রীতি শুরু হয়েছিল, সেটি এখনো চলে আসছে।
এখনো পরিবারের সবাইকে চারপাশে নিয়ে একজন সালাদ মাখতে শুরু করেন। প্রতিটি উপাদান মিশ্রিত করার সাথে সাথে চিৎকার করে নির্দিষ্ট কথাগুলো উচ্চারণ করেন তারা। মজার ব্যাপার হলো, সেই চার রাঁধুনি এখন বয়স্ক হয়ে গিয়েছেন। তাদের কাছেও ব্যাপারটি আশ্চর্যকর যে, তাদের তৈরি করা কোনো একটি ব্যাপার এখন সিঙ্গাপুরের প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি হয়ে গিয়েছে!
অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্য যে, ১৯৬৪ সালে তৈরি করা সেই ইউশেং সালাদের দাম একই রয়েছে। তবে বাইরে এর দাম অনেক বেড়ে গিয়েছে। গত বছর ৯৯৯ ডলার দামে বিক্রি হয়েছে একটি ইউ শিং। তবে সেই চারজন রাঁধুনির রেস্তোরাঁয় সালাদের দাম এখনো মাত্র ৮০ ডলার। হংকং এবং পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশেও এখন এই সালাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তবে অন্য কিছু নয়, বরং ইউ শেং-এর একে অপরের সাথে পরিচয় তৈরি করার এবং আন্তরিকতা বৃদ্ধি করার একটি বড় মাধ্যম। এটি অপরিচিত ও কম পরিচিত মানুষের মধ্যেও সম্প্রীতি তৈরি করতে সাহায্য করে। একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। সালাদটি মানুষকে চোখ, নাক এবং স্বাদ- সবভাবেই তৃপ্তি দেয়। এমন একটি খাবারকে জনপ্রিয় করার পেছনে অবদান রাখতে পেরেছেন, সেই পরিতৃপ্তি নিয়েই সন্তুষ্ট শেফ হুই!