সঞ্জয় দত্তের নিজের রেসিপি ‘চিকেন সঞ্জু বাবা’ ও নূর মোহাম্মদি হোটেল

১৯৮১ সালে প্রথম চলচ্চিত্র রকির মাধ্যমে বলিউডে নাম লেখান সঞ্জয় দত্ত। এখন বলিউডে তার অবস্থান এমন যে নতুন করে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। পর্দার চরিত্রগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে সঞ্জয় দত্ত বাস্তব জীবনে একজন উঁচু মানের ভোজনরসিক এবং একজন সিদ্ধ রাঁধুনিও বটে। এতটাই পাকা রাঁধুনি যে মুম্বাইয়ের এক বিখ্যাত খাবার হোটেলে তার নামের একটি খাবারই আছে- চিকেন সঞ্জু বাবা

দক্ষিণ মুম্বাইয়ের ভেন্ডি বাজার এলাকাটি খাবারের জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে রমজানের সময় মুসল্লিদের ভিড় লেগে যায় সেখানে। সেই ভেন্ডি বাজার আরেকটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত- নূর মোহাম্মদি হোটেলের নাল্লি নেহারি।

Photo Credit: Misba Shaikh; Image Source: twitter.com

নেহারি কী জিনিস বা খেতে কেমন, সেটিও বাঙালিকে বলতে হবে না। গরু, খাসি বা ভেড়ার পায়ের মাংসের সাথে বিভিন্ন মশলা একসাথে মিশিয়ে একটিমাত্র পাত্র ব্যবহার করে অল্প আঁচে দম দিয়ে রান্না করাকে নিহারি বলে। এই মোঘলাই খাবারটি অনেক বছর আগে থেকেই এই অঞ্চলে জনপ্রিয়। মুম্বাইয়ের নূর মোহাম্মদি হোটেল সেই নেহারি তৈরিতে মুনশিয়ানা অর্জন করেছে। নূর মোহাম্মদি হোটেলের মালিক খালিদ হাকিম জানান, কী করে তৈরি হলো এই নূর মোহাম্মদি হোটেল ও কীভাবে এতে ‘চিকেন সঞ্জু বাবা’ নামের এক খাবার যোগ হলো।

হাকিমের দাদা রোজগারের জন্য উত্তরাখণ্ডের একটি দরগাতে হালুয়া-পরোটা বিক্রি করতেন। এতই মুখরোচক ছিল সেই হালুয়া-পরটা যে সেই টাকা দিয়েই তার সারা বছর চলে যেত। আশাতীত লাভের মুখ দেখে তিনি মুম্বাইয়ে খাবারের একটি ছোট ঠেলা বসালেন। তখন এই ভেন্ডি বাজার এলাকায় খাবারের দোকান বলতে গেলে ছিলই না; যেগুলো ছিল, তাতে সকালের নাস্তার ব্যবস্থা ছিল না, শুধু রাতের খাবার বিক্রি হতো।

নুর মোহাম্মদি হোটেলের বর্তমান মালিক খালিদ হাকিম; Image Source: indianexpress.com

“তখন আমার দাদা সকালের নাস্তা হিসাবে নাল্লি নেহারি বিক্রি করা শুরু করলেন এবং এটি মুম্বাইয়ে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেল”, হাকিম বলেন। ধীরে ধীরে সেই ছোট ঠেলাটি একটি ‘ধাবা’তে পরিণত হলো আর নেহারি সকালের নাস্তার জায়গায় রাতের খাবার হিসেবেও পরিবেশিত হতে লাগলো।

কিন্তু হাকিমের দাদার কল্পনা এর চেয়ে বেশি দূর গড়ালো না, তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যেতে চাইলেন।

“যদি আমার বাবা মুম্বাইয়ে থেকে ব্যবসাকে আরও বড় করতে না চাইতেন তাহলে আজকে হয়তো আমি উত্তর প্রদেশে রিকশা চালাতাম”, বলেন হাকিম।

১৯৬৬ সালে, খালিদ হাকিমের জন্মের বছরই তার বাবা আব্দুল করিম একটি দোতলা হোটেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন, সেটিই আজকের বিখ্যাত নূর মোহাম্মদি হোটেল।

‘চিকেন সঞ্জু বাবা’ পরিবেশন করার অনেক আগে থেকেই মুম্বাইয়ে বিশেষ পরিচিতি করে নিয়েছিল নূর মোহাম্মদি হোটেল। এর নিয়মিত গ্রাহকদের মধ্যে ছিলেন অভিনেতা দিলীপ কুমার, চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হোসেন এবং সঞ্জয় দত্তের বাবা পরিচালক সুনীল দত্ত। অন্য হাজারো গ্রাহকের মতো তারাও আসতেন এখানে বিখ্যাত কিছু খাবার খেতে, যেমন- সাদা বিরিয়ানি, চিকেন হাকিমি, ডাল ঘি, জাফরানী তাংরি কাবাব, শামি কাবাব, তিরঙ্গা কাবাব সহ আরও অনেক কিছু। নূর মোহাম্মদি হোটেল এমন আরও অনেক মোঘলাই রেসিপির জন্য খ্যাতি অর্জন করে। তারা তাদের সব খাবার পিতলের পাত্রে কয়লার চুলায় রান্না করে বিধায় এর স্বাদ অন্যান্য রেস্তোরাঁ থেকে ভিন্ন হয়।

রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই চোখে পড়বে সঞ্জয় দত্তের সই করা রেসিপিটি; Image Source: natgeotraveller.in

সঞ্জয় দত্তের ভাই আফতাব হোসেন নূর মোহাম্মদি হোটেলের একজন নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। সময় তখন ১৯৮৬ সাল, খালিদ হাকিমের বয়স ২০ বছর। তিনি চাইলেন তার এই রেস্টুরেন্টের নতুন ফ্যামিলি সেকশনটি যেন সঞ্জয় দত্ত উদ্বোধন করেন।

সত্যিই ১৯৮৬ সালে একদিন হঠাৎ করেই নূর মোহাম্মদি হোটেলে চলে আসেন সঞ্জয় দত্ত। এরপরে তিনিও এই ঐতিহ্যবাহী হোটেলের একজন বাঁধা খদ্দের হয়ে গেলেন। ২০১০ সালে হাকিম তার নতুন রেসিপি সাদা চিকেন বিরিয়ানি তৈরি করেন এবং একে উপহার হিসেবে সঞ্জয় দত্তের বাসায় পাঠান।

সঞ্জয় বিরিয়ানিটি বেশ পছন্দ করলেন এবং তখনি খালিদ হাকিমের বাবুর্চিকে নিজে রান্না করে দেখালেন এই চিকেন সঞ্জু বাবা। তখন অবশ্য এর নাম চিকেন সঞ্জু বাবা ছিল না। ২০১০ সালেই সঞ্জয় দত্ত লিখিতভাবে এই চিকেন রেসিপিটির স্বত্ত্বাধিকার দিয়ে দেন নূর মোহাম্মদি হোটেলকে। এরপর থেকে নূর মোহাম্মদি হোটেল নিয়মিত তাদের মেন্যুতে রাখতে শুরু করে এটি, নাম দেয় ‘চিকেন সঞ্জু বাবা’।

চিকেন সঞ্জু বাবা যোগ হওয়ার ১০ বছরের মধ্যে নূর মোহাম্মদি হোটেলের ব্যবসা যেন তুঙ্গে উঠে গেল। খালিদ হাকিম সঞ্জয় দত্তের এই মহানুভবতা চিরদিন মনে রাখলেন। তিনি বলেন,

“সঞ্জয় দত্ত খুবই সাদাসিধে, ভালো একজন মানুষ। তিনি চাইলে তার এই রেসিপি যেকোনো পাঁচতারা রেস্টুরেন্টে দিয়ে অনেক টাকা আয় করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিলেন আমাদের এই ছোট হোটেলটিকে”।

যেদিন সঞ্জয় দত্তকে সন্ত্রাসী সন্দেহে জেলে বন্দী করা হয়েছিল, সেদিন নূর মোহাম্মদি হোটেল শোকে চিকেন সঞ্জু বাবা পরিবেশন করেনি। তবে ২০১৬ সালের যেদিন সঞ্জয় দত্ত জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন, সেদিন দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হাকিম সবাইকে ‘বিনামূল্যে’ চিকেন সঞ্জু বাবা বিক্রি করেন।

হাকিম বলেন, “অনেকে ভাবে এটি প্রচার পাওয়ার একটি চেষ্টা ছিল। কিন্তু সকলেরই ভালোবাসা প্রকাশের একটি ধরন থাকে। এটি ছিল আমার ধরন।”

চিকেন সঞ্জু বাবা এখনো নূর মোহাম্মদি হোটেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবারের মধ্যে একটি। যারা খেতে ও ঘুরতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য মুম্বাই ট্যুরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে পারে চিকেন সঞ্জু বাবা

যেভাবে তৈরি করবেন চিকেন সঞ্জু বাবা

চিকেন সঞ্জু বাবা খাওয়ার জন্য আপনাকে মুম্বাইয়ের নূর মোহাম্মদি হোটেলেই যেতে হবে এমন নয়। যদিও খালিদ হাকিম কখনো চিকেন সঞ্জু বাবা বানানোর পুরো কায়দা খোলাসা করেননি, তার রেস্টুরেন্টের একটি বোর্ডে স্পষ্টভাবে এর উপকরণসমূহ লেখা আছে। এর সাহায্যেই অনেকে তৈরি করেছেন তাদের নিজস্ব ‘চিকেন সঞ্জু বাবা’। চলুন দেখে নেই এর রন্ধনপ্রণালী।

যা যা উপকরণ লাগবে

বড় টুকরা করা মুরগির মাংস, তেল ও ঘি পরিমাণ মতো, টক দই এক কাপ, কাজুবাদামের পেস্ট এক কাপ, কাশ্মীরি লাল মরিচ, জাফরান, আস্ত ধনিয়া, আস্ত জিরা, দুটি বড় পেঁয়াজ কুচি, এলাচ, তেজপাতা, সবুজ পেঁয়াজ (ইচ্ছামতো), কুচি করে কাটা আদা ও লবণ পরিমাণমতো।

রান্নার প্রক্রিয়া

মনে রাখবেন, এই রেসিপির মূল আকর্ষণ হলো, এতে সব ‘আস্ত মশলা’ ব্যবহার করা হয়েছে, দোকান থেকে কেনা পাউডার মশলা না। আস্ত মশলাগুলোই এই খাবারকে এত মজাদার করে। পাউডার মশলায় আপনি রান্না করতে পারেন, কিন্তু এতে চিকেন সঞ্জু বাবার আসল ফ্লেভারটি আর থাকবে না।

দেখতে কিছুটা এমন হবে চিকেন সঞ্জু বাবা;  Image Source: eattreat.in

প্রথমেই একটি প্যান গরম করে এতে আপনার পছন্দের পরিমাণমতো ঘি ও তেল ঢালুন। তবে অন্যান্য মুরগির চেয়ে এই রেসিপিতে তেল আর ঘিয়ের পরিমাণ বেশি থাকবে। তেল ও ঘিয়ের মিশ্রণ গরম হলে এতে ঢেলে দিন কয়েকটি আস্ত জিরা। অল্প নাড়াচাড়া করে এতে দিন শুকনো এলাচি, ৫-৬টি কাশ্মীরি মরিচ, ৩-৪টি তেজপাতা এবং ভালোভাবে নাড়ুন। এই রেসিপিতে খুবই সামান্য মশলা ব্যবহার করা হয়। তাই প্রতিটি আস্ত মশলা আপনি আপনার রুচি অনুযায়ী বাড়াতে-কমাতে পারেন।

সব একটু ভাজা ভাজা হয়ে আসলে পেঁয়াজ কুচিগুলো ছেড়ে দিন। এ সময় পরিমাণমতো লবণ দিন, যাতে পেঁয়াজগুলো তাড়াতাড়ি ভাজা হয়ে যায়। পেঁয়াজ হালকা সোনালি রঙ হয়ে গেলে এতে দিন স্প্রিং অনিয়ন বা সবুজ পেঁয়াজ ও কুচি করে রাখা আদা। এই মিশ্রণকে ৩০-৪০ সেকেন্ড চুলার মধ্যম তাপমাত্রায় নাড়ুন।

তেল ছাড়তে শুরু করলে এতে কেটে রাখা মুরগির টুকরোগুলো দিয়ে দিন। মুরগি ছুরি দিয়ে কেটে কেটে নিতে পারেন, এতে মশলা সোজা এর ভেতরে যাবে।

মশলার সাথে মুরগির টুকরোগুলো মেশানোর পর এতে দিন ধনিয়া ও জাফরান গুঁড়া। আবারো কিছুক্ষণ মুরগিটি মশলার সাথে মেশান। এরপর ঢালুন আগে থেকে ফেটানো ১ কাপ টক দই ও ১ কাপ কাজুবাদাম পেস্ট। কাজুবাদাম পেস্টের জন্য কয়েকটি কাজুবাদামকে পানির সাথে মিশিয়ে ব্লেন্ড করে নিলেই হবে।

এবারে মুরগিরর সাথে কিছু টমেটোর টুকরা দিয়ে দিন, লবণ চেখে নিন। যদি কম মনে হয়, তাহলে আরেকটু লবণ দিতে পারেন। দই ও কাজুবাদাম পেস্টের কারণে এখন চিকেনটির ঝোল সাদা দেখাবে।

এতে কোনো পানি মেশাবেন না। দই আর পেস্টের সাথে চিকেনকে ভালোভাবে মিশিয়ে একেবারে অল্প আঁচে ৩০ মিনিটের জন্য প্যানটি ঢেকে রান্না করুন। মুরগি থেকে নিজে নিজেই পানি বেরোবে।

৩০ মিনিট পর দেখবেন সাদা ঝোলটি একটি সুন্দর জাফরানী রঙ ধারণ করেছে। কাশ্মীরি মরিচগুলোর কারণে এমনটি হয়। মনে রাখবেন, এটি কখনো প্রেসার কুকারে তাড়াতাড়ি রান্না করবেন না, অল্প আঁচে ধীরে ধীরে রান্না করা হলেই মশলাগুলো ঠিকমতো কষবে।

সবশেষে কয়েকটি আদা কুচি, স্প্রিং অনিয়ন এবং সামান্য লেবুর রস ছিটিয়ে নিন। লেবুর রস দেয়ার সাথে সাথে অবশ্যই চুলা বন্ধ করে নিবেন। চাইলে কিছু সবুজ ধনিয়া পাতা দিয়ে পরিবেশন করুন।

ব্যাস! তৈরি হয়ে গেল বিখ্যাত রেসিপি চিকেন সঞ্জু বাবা। উপভোগ করুন!

* চাইলে এই ভিডিও থেকে দেখে নিতে পারেন ‘চিকেন সঞ্জু বাবা’ বানানোর প্রক্রিয়া 

This article is in Bangla language. It discusses about a recipe called Chicken Sanju Baba. Necessary sources have been hyperlinked inside the article.

Feature Image: indianexpress.com

Related Articles

Exit mobile version