অন্যান্য সময়ের তুলনায় গ্রীষ্মকালে রোগবালাই এবং ত্বকের নানান সমস্যার পরিমাণ তুলনামূলক বেশি দেখা দেয়। তবে এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মতো উপায়ও কিন্তু খুবই সহজ! প্রতিদিনের খাবারের রুটিনে নিম্নে উল্লেখিত খাবারগুলো আপনাকে গরমের দিনেও দেবে সুন্দর ত্বক এবং আপনিও থাকবেন স্বাস্থ্যোজ্জ্বল।
তরমুজ
টকটকে লাল রঙের রসালো এই ফলটিতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, পটাশিয়াম এবং লাইকোপিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়াও রয়েছে এল-সিট্রুলিন নামক অ্যামাইনো এসিড যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কেটে, জুস করে বা আইসক্রিম বানিয়ে খেতে পারেন গরমের দিনের এই ফলটি।
চিংড়ি মাছ
চিংড়ি মাছে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-১২, প্রোটিন, লো-ফ্যাট, ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড যা হার্টের সুরক্ষায় কাজ করে এবং রক্তে কোলেস্টেরলের সমস্যা দূর করে, এনজাইম যা কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমায়। তাই গ্রীষ্মকালে খাবারের রুটিনে রাখতে পারেন চিংড়ি মাছ দিয়ে বানানো যেকোনো আইটেম।
ভুট্টা
ভুট্টা হলো এমন একটি খাবার যা যত বেশি সময় ধরে রান্না করা হবে, তত বেশি এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর পরিমাণ বেড়ে যাবে। দ্য জার্নাল অব এগ্রিকালচার এন্ড ফুড কেমেস্ট্রির এক পরীক্ষা মতে, রান্না করায় ভুট্টা থেকে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বের হয় হার্টের যেকোনো ধরনের সমস্যা ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। এছাড়াও রয়েছে ল্যুটিন নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা বৃদ্ধ বয়সে অন্ধত্বের ঝুঁকিও কমায়। তাই গরমের দিনে ভুট্টা খেতে ভুলবেন না যেন!
সেলারি
সেলারি হজমশক্তি বাড়ায় এবং এতে যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে তা ভাইরাস থেকে চোখকে বাঁচায় ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া এতে রয়েছে ভিটামিন-কে, সি এবং ফোলেট। সেলারিতে রয়েছে ৯৫% পানি এবং আঁশ। এই আঁশ ওজন এবং কোষ্টকাঠিন্য কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া মানসিক-শারীরিক চাপ, কোলেস্টরেল, কমায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। সালাদ অথবা স্যুপে সেলারি দিয়ে খেতে পারেন।
মাশরুম
গরমের দিনে হেপাটাইটিস বি, জন্ডিস, অ্যালার্জি ও আমাশয়ের সমস্যা বেশি দেখা দেয়। আর মাশরুম এই রোগগুলোর প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এছাড়া মাশরুম ভিটামিন-ডি এর একমাত্র ভেজিটেবল সোর্স। ক্যান্সার সহ নানান ধরনের রোগ প্রতিরোধেও সাহায্য করে মাশরুম। গ্রীষ্মের সময়টাতে তাই যেভাবে খুশি সেভাবে খেয়ে নিতে পারেন মাশরুম।
কফি
বরফমাখানো এক গ্লাস কোল্ড কফি! দুর্বিষহ গরমে এর নাম শুনলেই যেন শান্তি লাগে। কফিরও নানান গুণাগুণ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কফিতে আছে পলিফেনাল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা রক্তে সঠিকভাবে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। দ্য হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ্ এর এক পরীক্ষা মতে, একজন ব্যক্তি দিনে মাত্র এক কাপ কফি পান করলে তার টাইপ-২ ডায়াবেটিক্সের ঝুঁকি ১৩% পর্যন্ত কমে যায়। এছাড়াও কফি আলঝেইমার্স রোগ, কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়, মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করে ও লিভারকে সুস্থ রাখে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল এর গবেষণা মতে কফি ত্বকের ক্যান্সারেরও সম্ভাবনা কমায়।
সরিষা
সরিষাতে রয়েছে সিলেনিয়াম, এক প্রকার মিনারেল এবং এতে এমন এক ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা কার্ডিওভাসকুলার জনিত রোগের ঝুঁকি কমায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং নির্দিষ্ট কিছু ক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে। এছাড়াও সরিষা থেকে আপনি পাবেন ম্যাগনেসিয়াম যা রক্তচাপ কমাবে এবং জ্বালাপোড়ার সমস্যা দূর করবে। গরমের দিনের বিভিন্ন টক জাতীয় ফলের সাথে সরিষা মেখে খেতে পারেন।
চেরি
কেক, পেস্ট্রির উপর সাজানো চিরচেনা সেই টকটকে লাল রঙের ফল হলো চেরি। লোভনীয় ও অতুলনীয় স্বাদের এই ছোট্ট ফলটি রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। শুধু তাই নয় বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধক হিসেবে এবং ত্বকের যত্নেও কাজ করে এই ফলটি। চেরি ফলে আছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি ও পটাশিয়াম যা ত্বককে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল রাখে। ভিটামিন সি ত্বকে কোলাজেনের মাত্রা বজায় রাখে আর পটাশিয়াম ত্বককে হাইড্রেট রেখে উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং রুক্ষতা দূর করে। এছাড়াও রয়েছে পেকটিন নামক ফাইবার যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা জ্বালাপোড়ার সমস্যা কমায় হার্টকে সুস্থ রাখে।
চীনা বাদাম
বিকেল বেলায় এক ঠোঙা গরম গরম বাদাম! ব্যস, বিকেলের মেন্যুতে এর বেশি কিছু চাই কি? একমুঠো বাদাম ওজনে ৩০ গ্রাম হয়। আর এই খানিকটা বাদামেই রয়েছে বিশেষ সব পুষ্টিগুণ! ক্যালসিয়াম, ফোলেট, ম্যাগনেশিয়াম, নিয়াসিন, থায়ামিন, ফসফরাস, পটাশিয়াম ও ভিটামিন বি-৬। চীনা বাদাম হৃদরোগের ঝুঁকি, ওজন ও কোলেস্টেরল কমায় এবং স্মৃতিশক্তি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তাই গ্রীষ্মকালে চীনা বাদাম অবশ্যই খান।
ধুন্দল
রঙিন ফুলের এই সবজিটিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ম্যাংগানিজ আর এক ধরনের মিনারেল যা সূর্যের তাপ ও অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষয়ক্ষতি থেকে আপনার ত্বককে রক্ষা করে, ত্বকে কোলাজেন উৎপাদনে সহায়তা করে এবং ত্বককে টানটান রাখে। এছাড়াও প্রচণ্ড গরমে ত্বকে যে র্যাশের সমস্যা হয় তা থেকেও রক্ষা করে এই সবজি। এক কাপ কাঁচা ধুন্দল থেকে আপনি পাবেন ২০ মাইক্রোগ্রাম ক্যালরি, ২৮ মাইক্রোগ্রাম ফোলেট, ১২ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি এবং ২৫০ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম। ধুন্দলে যে পরিমাণ ফাইবার ও পানি থাকে তা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। মোট কথা, গরমের দিনে ত্বকের ‘সুপার ফুড’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় ধুন্দলকে!
পেঁপে
অন্য যেকোনো ফলের চাইতে পেঁপেতে ক্যারোটিন তুলনামূলক অনেক বেশি থাকে। এতে ক্যালরির পরিমাণ বেশ খানিকটা কম থাকায় ওজন বেড়ে যাওয়ার সমস্যা হয় না। এছাড়াও ভিটামিন এ, সি ও পটাশিয়াম থাকায় রক্তচাপ, কোলেস্টেরল ও হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং এর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখে এবং ত্বকের মৃতকোষ দূর করে। গরমের দিনে আমাশয় ও হজমের সমস্যা দেখা দেয় যার সমস্যা এই ফল খেলে দূর করা সম্ভব।
আলুবোখারা
গাঢ় রঙের গোল টসটসে ফলটি পুষ্টিগুণে ভরপুর। রান্নাতে বা কাঁচাও খাওয়া হয় এটি। এতে আছে ভিটামিন এ যা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ আঁশ যা খাওয়ার রুচি বাড়ায়। এছাড়াও আছে ভিটামিন সি যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ভিটামিন কে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। হাড়ের সুষ্ঠু গঠন ও হজম শক্তি বাড়াতে সহায়তা করে আলুবোখারা।
ক্যাপসিকাম
ক্যাপসিকামে আছে বিটা-ক্যারোটিন যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। আরও আছে ভিটামিন সি যা ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে এবং হাড়, দাঁত, ত্বক ও চুলকে রাখে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল। একটি মাঝারি সাইজের সবুজ ক্যাপসিকাম থেকে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শরীরে ভিটামিন সি এর ১০০% চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আর লাল রঙের ক্যাপসিকামে, সবুজ রঙের ক্যাপসিকামের চাইতে ৫০% বেশি ভিটামিন সি থাকে। এছাড়াও ক্যাপসিকাম ত্বকে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখে ও ব্রনের সমস্যা দূর করে।
টমেটো
টমেটোতে আছে লাইকোপিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সারের প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে এবং ত্বকের রুক্ষতা, শুষ্কতা দূর করে, সূর্যের ক্ষয়ক্ষতি ও পরিবেশের দূষণ থেকে ত্বককে রক্ষা করে। এছাড়াও টমেটো বাতের ব্যথা দূর করে এবং কিডনিতে পাথর জমার সম্ভাবনা রোধ করে।
মিষ্টি আলু
গরমের দিনে রুক্ষ ত্বক নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন? তাহলে আপনার ত্বকের জন্য চাই পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন এ-এর পুষ্টি। আর এই চাহিদা পূরণে আপনি খেতে পারেন মিষ্টি আলু। এছাড়াও ভিটামিন এ রেটিওনাল নামেও পরিচিত যা ত্বকের বিভিন্ন প্রসাধনীতে ব্যবহার করা হয়। মিষ্টি আলু, পাস্তুরিত মাখন এবং পালং শাক একসাথে রান্না করে খেলে সেখান থেকে বেশ ভালো পরিমাণে ভিটামিন এ পাওয়া যায়।
এছাড়াও মাছ, গ্রিন টি, মিষ্টি কুমড়ার বীজ, আদা, ডিম, পিনাট বাটার, পানি, জাম। এই খাবারগুলো রাখতে পারেন গ্রীষ্মকালে আপনার প্রতিদিনের মেন্যুতে।
Feature Image: www.williamsfruitandproduce.com.au