জাপানের খাদ্য সংস্কৃতি সম্পর্কে বলতে গেলে খাবারের তালিকায় শীর্ষে যে নামগুলো থাকবে, তার মধ্যে একটি ‘টেম্পুরা’। টেম্পুরার সাথে জাপানের বিস্তর ইতিহাস থাকলেও আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এর উৎপত্তিস্থল জাপানে নয়, বরং পর্তুগালে। টেম্পুরার অসাধারণ স্বাদ এবং অনন্য বৈচিত্র্যের কারণে বিশ্বজুড়ে এর বেশ নামডাক রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, খেতে কেমন এই টেম্পুরা? এর উৎপত্তিস্থল ও বিস্তার লাভ করার অঞ্চলের ভিন্নতার পেছনের কারণগুলোই বা কী?
ইতিহাস
১৫৪৩ সালে চীনের একটি জাহাজে তিনজন পর্তুগিজ নাবিক ম্যাকাওয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তারা হলেন- অ্যান্তোনিও ডা মোটা, অ্যান্তোনিও পেক্সোটো এবং ফ্রান্সিসকো জেইমোটো। তবে মাঝপথে প্রতিকূল আবহাওয়ার সম্মুখীন হলে জীবন বাঁচাতে কোনোভাবে একটি দ্বীপে গিয়ে তারা আশ্রয় নেন। সেটা ছিল জাপানের তানেগাশিমা দ্বীপ। এই তিনজনই হলেন ইউরোপ থেকে জাপানে প্রবেশকারী প্রথম তিন ব্যক্তি।
সেই দ্বীপের অধিবাসীরা তাদেরকে দক্ষিণী অসভ্য ও বর্বর কোনো জাতির সদস্য মনে করে। তাদের মধ্যে জাপানবাসীর বৈশিষ্ট্য না দেখে তারা বুঝতে পারে যে, সেই নাবিকরা ভিনদেশী এবং এর ফলে তাদের প্রতি বিরূপ আচরণও করে তানেগাশিমার লোকজন। জাপানের গৃহযুদ্ধ দিন দিন বাড়তে থাকে এবং একসময় তাদের বিভিন্ন অস্ত্র, বিশেষ করে বন্দুক আমদানি করার প্রয়োজন হয়, যার জন্য তারা পর্তুগালের শরণাপন্ন হয়। এভাবে বন্দুকের ব্যবসা করতে গিয়ে জাপানবাসী সাবান, উল, তামাক, এমনকি খাবারের রেসিপিও আমদানি করে বসে।
পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের ১৬৩৯ সালে জাপান থেকে বিতাড়িত করা হয়। কারণ তৎকালীন শাসক শোগুন এমিতসো মনে করেছিলেন, খ্রিস্টান ধর্ম জাপানের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা তানেগাশিমা দ্বীপ থেকে চলে যায়, তবে তাদের প্রভাব এখনও স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায় জাপানের খাদ্য সংস্কৃতিতে। বরবটি দিয়ে তৈরি পেক্সিনহোস ডা হোর্টা নামক বিখ্যাত ডিশটি পর্তুগিজদেরই অবদান, যা বর্তমানে জাপানে ‘টেম্পুরা’ নামে পরিচিত।
মজার বিষয় হলো, পর্তুগাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন খাবারকে প্রভাবিত করেছে ও সেগুলো তৈরির প্রণালিতে বিশেষ অবদান রেখেছে। বিশেষ করে ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সের খাবারের ক্ষেত্রে পর্তুগালের কর্তৃত্ব বেশ লক্ষণীয়। ভারতের গোয়ায় পর্তুগিজরা প্রায় ১৯৬১ সাল পর্যন্ত অবস্থান করে। তখন তারা সেখানে শূকরের মাংস, রসুন ও ওয়াইন দিয়ে ক্যারনা দে ভিনহা ডা’লহোস তৈরি করে, যা গোয়ার অধিবাসীদের কাছে ভিনডালো নামে পরিচিতি লাভ করে। উল্লেখ্য, এই ডিশটি বর্তমানে ভারতের সবচেয়ে পরিচিত ডিশগুলোর অন্তর্ভুক্ত।
মালয়েশিয়ার ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ডিশ পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের অবদানেই সেই দেশে পরিচিতি লাভ করে। আর সেই এলাকার বিখ্যাত ডিশ স্পাইসি স্টিউ ডেবালও পর্তুগিজদেরই অবদান। ব্রাজিলের জাতীয় খাদ্য ‘ফেজোয়ডা’ এর উৎস পর্তুগালের উত্তরের অঞ্চল ‘মিনহো’। শূকরের মাংসের তৈরি এই ডিশটি আজকাল সেসব স্থানই পাবেন, যেখানে পর্তুগিজরা একসময় ব্যবসা করতো, যেমন- ভারতের গোয়া, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, ম্যাকাও এবং কেপ ভার্দে। এছাড়া ম্যাকাও ও দক্ষিণ চীনের ডিমের টার্ট ও পেস্ট্রি একেবারে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে যেসকল টার্ট ও পেস্ট্রি পাওয়া যায় সেগুলোর সমতুল্য।
টেম্পুরা শব্দটি কোথা থেকে এলো?
‘টেম্পুরা’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘টেম্পোরা’ থেকে। এর অর্থ ‘সময়কাল’ বা ‘বার’। স্পেন ও পর্তুগালের ধর্মপ্রচারকেরা ‘এম্বার ডেস’ এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের অন্যান্য পবিত্র দিনগুলো বোঝানোর জন্য ‘টেম্পোরা’ শব্দটি সাধারণত ব্যবহার করেন। এ ধরনের অনুষ্ঠানে ধর্মীয় গুরুদের নির্দেশে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা মাছ-মাংস খাওয়া কয়েকদিনের জন্য বন্ধ রাখে। এগুলোর বিকল্প হিসেবে তারা বরবটিকে মসলা দিয়ে তেলে ভেজে খেত, যার নাম পেক্সিনহোস ডা হোর্টা। ধর্মীয় প্রেক্ষাপট ছাড়াও এর অন্যান্য উপকারিতাও ছিল।
যেমন- যারা আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে মাছ-মাংস কিনতে পারতো না, তারা একে বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতেন। আবার অনেক নাবিক সমুদ্রযাত্রায় যাওয়ার আগে এই পেক্সিনহোস ডা হোর্টা নিয়ে যেত। এগুলো অনেকদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যেত এবং সুস্বাদু বলে এই খাবারটা তারা নিয়ে যেত। অবশ্য এভাবে কোনো খাবারকে লবণ ও মসলা দিয়ে কিউরিং ও সংরক্ষণ করার কৌশল বেশ পুরনো। এই পেক্সিনহোসই হলো টেম্পুরা। কিন্তু জাপানবাসীর সংস্কৃতি ও রুচির প্রভাবে বরবটি ছাড়াও চিংড়ি, মিষ্টি আলু, মাশরুম ব্যবহার করে টেম্পুরা তৈরি করা হয়।
তবে টেম্পুরা নামক খাবারটি জাপানে আসার পরপরই তা সাধারণ জনগণের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেনি। এর মূল কারণ ছিল টেম্পুরার চড়া দাম। তবে এডো যুগে (১৬০৩-১৮৬৭) এর মূল্য বেশ কমে যায়। ফলে এই টেম্পুরা শুধু ধনীদের কাছেই নয়, বরং মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের নিকটও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এডো যুগে টেম্পুরা জাপান জুড়ে যে সুপরিচিত ছিল তা বোঝা যায় একটি আঞ্চলিক গল্প থেকে। টোকুগায়া বংশের প্রথম টোকুগায়া শোগুন (সামুরাই প্রধান) ইয়েসু বার্ধক্যে নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তবে টেম্পুরার প্রতি তার ছিল গভীর আসক্তি। নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখলেও একদিন তিনি টেম্পুরা খেতে এতটাই মশগুল ছিলেন যে, অত্যধিক পরিমাণে টেম্পুরা খেয়ে ফেলেন, যা তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যদিও এই কাহিনী সত্য নাকি তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন উত্থাপন করেন, তবুও এই গল্প থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়, এডো যুগে টেম্পুরা সকলের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিল। এ যুগে মূলত ঝটপট বানানো কম দামী, সহজলভ্য ও সুস্বাদু খাবারগুলো সকলের নিকট প্রাধান্য পায়।
কীরকম এই টেম্পুরা?
একদম সহজ করে বলতে গেলে টেম্পুরা অনেকটা পাকোড়ার মতো। সবজি বা সামুদ্রিক মাছের পাকোড়া! চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, বরবটি, অ্যাসপারাগাস, বেগুনসহ বিভিন্ন সবজি ও মাছকে আটা, ডিম, বেকিং পাউডার, স্টার্চ, মসলা ও পানি দিয়ে বানানো হয় এই টেম্পুরা। তাছাড়া চিকেন ও টোফুর টেম্পুরাও পাওয়া যায়।
টেম্পুরা পরিবেশন করা হয় মসলা ও টেনসুয়ুর (সস) সাথে। আবার স্যুপ এবং রাইসের সাথেও পরিবেশন করা হয়। বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টেই মিরিন (রাইস ওয়াইন), ফিশ স্টক, সয়া সসের তৈরি একটি বিশেষ সস দেওয়া হয় টেম্পুরার সাথে।
মূলা ও আদা এর উপর কুঁচি করে কেটে দেওয়া হয়। আর এই খাবারে ইউজু নামক ফলটির ব্যবহার খুব সাধারণ বিষয়। ‘উডন’ এর সাথেও টেম্পুরার সংযোগটাও বেশ ভালো। উডন হলো গমের আটায় তৈরি মোটা আকারের নুডলস। এই নুডলস একটি বাটিতে গরম স্যুপের সাথে দেওয়া হয়। স্যুপের ধরন ও স্বাদ অঞ্চলভেদে পরিবর্তন হয়। এর সাথে মূলত ‘এবি’ বা চিংড়ির উডন পরিবেশন করা হয়। এই পুরো সেটকে ‘টেম্পুরা উডন’ বা ‘টেম্পুরা সোবা’ বলে। শীতের দিনে এই ডিশের চাহিদা বেশি থাকে। মসলার মধ্যে মাচা ও ওয়াসাবির গুঁড়া সকলের নিকট বেশি সমাদৃত।
যেসকল রেস্টুরেন্ট টেম্পুরা তৈরিতে অভিজ্ঞ, সেগুলোকে ‘টেম্পুরা-ইয়া’ বলে। উৎকৃষ্ট মানের টেম্পুরা-ইয়ায় এই ডিশ কিনতে খরচ করতে হবে ৫,০০০ ইয়েন বা এর বেশি। অর্থাৎ ৩,৭০০ টাকা প্রায়! অবশ্য কম মূল্যে ছোটোখাট দোকানগুলোতে টেম্পুরা কিনতে পারবেন। এজন্য মাত্র ৬০০-১,২০০ ইয়েন বা ৪০০-১,৫০০ টাকা খরচ করতে হবে।