‘যাহাতে নাইক মাদকতার দোষ
কিন্তু পানে করে চিত্ত পরিতোষ’
এটি চা নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনের কিছু কথা। ব্রিটিশরা যখন প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের প্রচলন শুরু করে, তখনকার দিনে বাঙালিদের চায়ের প্রতি আগ্রহী করতে যারপরনাই চেষ্টা করেছিল ইংলিশ শাসকরা। শুরুতে নাকি সাধারণ মানুষদের বিনামূল্যে চা পান করানো হতো। পরের কাহিনী তো সবার জানা।
১৬৫০ সালে চীনে চায়ের আবিষ্কারের পর ১৮০০ সালে বৃটিশদের হাত ধরে যে চা এই উপমহাদেশে এসেছিল, সেখানেই এখন চায়ের বিশাল একটি অংশ চাষ হয়। বাংলাদেশের সিলেটে মালনীছড়া চা বাগান হলো উপমহাদেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত চা বাগান। তখন থেকে চা পানের যে অভ্যেসটা ছড়িয়ে গেছে তা এখন এই স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারত, পাকিস্তান কিংবা পুরো বিশ্বে চা আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। আমাদের আড্ডায়, দুশ্চিন্তায়, মেঘের মতো মন খারাপের দিনে কিংবা একটুখানি প্রেমে, সাহিত্যে, শিল্পে; সবখানে জড়িয়ে আছে চায়ের চুমুক।
আলাপ আসতে পারে চায়ের মূল্য নিয়ে। বিশ্বজুড়ে চায়ের প্রকারভেদ অনুযায়ী চায়ের দাম আলাদা। আবার এই বাংলাতেও রয়েছে একাধিক মানের, প্রকারের চা। তবে খুব বেশি নয়। যে কারণে সমাজের নিম্নস্তরের মানুষ থেকে শুরু করে উঁচু; সবখানেই চায়ের পসার সমান সমান। তবে ইতিহাস বলছে, এমনও চা আছে যার প্রতি গ্রাম কিনতে গেলেই গুনতে হবে লাখ খানেক টাকা! বিশ্বাস হচ্ছে না তো? সেসব অবিশ্বাস্য দামী চা নিয়েই এই আয়োজন। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে দামী কিছু চায়ের তথ্য চলুন জেনে নেওয়া যাক।
দা হং পাও
পৃথিবীর সবচেয়ে দামী চা দা হং পাওয়ের দারুণ এক ইতিহাস আছে। একবার চীনের এক মিং রাজার মায়ের অসুখ হলো। সব চিকিৎসা যখন ব্যর্থ, তখনই রাজার মায়ের জীবন বাচালো এই দা হং পাও চা। চীনের উয়ি পাহাড়ের চূড়ায় চারটি ঝোপে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল এই দা হং পাও। বিশেষ ঔষধি গুণ সম্পন্ন সেই চা পান করেই সুস্থ হয়ে ওঠেন রাজার মা।
চীনা ভাষায় দা হং পাও অর্থ লাল রংয়ের গাউন। প্রতি গ্রামের মূল্য প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। প্রতি কেজির মূল্য সোয়া মিলিয়ন ডলারেরও উপরে। সত্যি বলতে, স্বর্ণের চেয়েও অন্তত ৩০ গুণ মূল্যবান দা হং পাও।
বাজারে এর মূল্য ঠিক রাখতেই কি না চাহিদা থাকা সত্ত্বেও চীন সরকার কঠোরভাবে দা হং পাওয়ের চাষ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এই চায়ের আসল স্বাদ আপনাকে নিয়ে যাবে সেই ১৮ শতকে, যখন প্রথম চা আবিষ্কার হয়। দা হং পাওয়ে চায়ের স্বাদের পাশাপাশি রয়েছে একধরনের ফুলের স্বাদ, যা আপনার মুখে লেগে থাকবে অনেকক্ষণ।
ইতিহাসের আরেকটু অংশ বাকি আছে। যে পাহাড়ের চূড়ার চারটি ঝোপে দা হং পাও পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলো এখনও সংরক্ষিত আছে।
পিজি টিপস ডায়মণ্ড টি ব্যাগ
প্রতিটি পিজি টিপস ডায়মণ্ড টি ব্যাগের জন্য আপনাকে গুনতে হবে ১৫ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের হিসেবে সাড়ে ১২ লাখ টাকা। দুটো কারণে এই চায়ের এতো বেশি দাম। প্রথমত, এটা একধরনের বিরল প্রজাতির সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চা। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি টি ব্যাগে রয়েছে ২৮০ টুকরো হীরে। যার পুরো কারুকার্য করেছে বিখ্যাত বুডলেস জুয়েলার্স। পিজি টিপসের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে, ‘লিমিটেড এডিশন’ হিসেবে ২০০৫ সালে ইংল্যান্ডের এটা বাজারে আনা হয়েছিল। কেবল কোম্পানির ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নয়, ইংল্যান্ডে শিশুদের জন্য একটি তহবিল গঠনের জন্যেও এই বিশেষ টি ব্যাগ বিক্রি করা হয়েছিল।
পাণ্ডা ডাং চা
বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে দামি কফি নাকি হাতির মল থেকে তৈরি হয়। পাণ্ডা ডাং চা অবশ্য তেমন কিছু নয়। তবে পাণ্ডার মল আছে বৈকি। মূলত চীনের সিচুয়ান প্রদেশে প্রথম এই চায়ের চাষ শুরু হয়। চা চাষে ব্যবহার করা হয় পাণ্ডার মল। এই চা পৃথিবীর অন্যতম দামী চা। যার মূল্য প্রতি কেজি ৭০ হাজার ডলার। বাংলাদেশের হিসেবে পায় ৬০ লাখ টাকার কাছাকাছি।
মজার ব্যাপার হলো, বিশেষ চাষ পদ্ধতির এই পাণ্ডা ডাং চা পেশাদার কোনো চা ব্যবসায়ী কিংবা চা চাষীর হাত ধরে আবিষ্কার হয়নি। শুরুটা করেছিলেন এক চীনা শিল্পী। পরে তিনিই এই চায়ের পেটেন্ট নিয়েছেন।
ভিন্টেজ নার্সিসাস চা
দা হং পাওয়ের মতো এই ভিন্টেজ নার্সিসাস চা চীনের উয়ি পাহাড়েই প্রথম পাওয়া যায়। মূলত গ্রিক দেবী নার্সিসাসের নামানুসারে এই চায়ের নামকরণ করা হয়েছে। এর বিশেষত্ব হলো, চায়ের ৬০ শতাংশ জারণ করা হয়। যত বেশি পুরনো হয় নার্সিসাস চা, ততই সুপেয় হয়। বছরের পর বছর এটা সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি দুই বছর পর তাপ দিয়ে পোড়ানো হয়।
এই চায়ের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য এর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কাঠ, ফুল কিংবা চকোলেটের ফ্লেভার দেওয়া হয়। প্রতি কেজি ভিন্টেজ নার্সিসাস চায়ের মূল্য সাড়ে ৬ হাজার মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মানে প্রায় ৫৫ লক্ষ টাকা।
ইয়োলো গোল্ড টি বাডস
প্রতি কেজি ৩ হাজার মার্কিন ডলার কিংবা ২৫ লাখ টাকা মূল্যের এই চায়ের বিশেষত্ব হলো গাছে থাকা অবস্থায় যখন পাতা গজায়, তখনই পুরো পাতায় ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী ইয়োলো গোল্ড টি বাডস বাগান থেকে বছরে কেবল একদিনই সংগ্রহ করা হয়। শুধু তা-ই নয়, চায়ের পাতা সংগ্রহ করতে ব্যবহার করা হয় স্বর্ণের কাঁচি। সাতবার প্রক্রিয়াজাতকরণের পর বাজারজাত করা হয় এই দুর্লভ প্রজাতির ইয়োলো গোল্ড টি বাডস।
ব্রোকেন লিফ ব্ল্যাক টি
কেবল ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো চা নয়, পাশাপাশি কেবলমাত্র ইউরোপেই এই চায়ের চাষ হয়। সব মিলিয়েই ব্রোকেন লিফ ব্ল্যাক টি বিখ্যাত। এই চায়ের মূল বিশেষত্ব হলো, শুধুমাত্র চা গাছের তিন নম্বর পাতা থেকেই এই চা উৎপাদন করা হয়। যে কারণে চায়ের স্বতন্ত্র ধরনের তামাটে রং হয়। পাশাপাশি চা পানে ফলের সুবাস পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ব্রোকেন ব্ল্যাক টি’র মূল্য ৪০৫ মার্কিন ডলার কিংবা প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার টাকা।
সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চা
রং আর কড়া স্বাদের জন্য সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চায়ের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। দামেও বেশ চড়া। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ১০ ধরনের চায়ের তালিকা করলে তাতে স্থান পাবে সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল।
ইম্পেরিয়াল চা চাষ হয় ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮ হাজার ফুট উপরে হিমালয়ের কোলে। সেই চা বাগান থেকে পাতা তোলার পর তা পাঠানো হয় ভারতের দার্জিলিংয়ে অবস্থিত মাকাইবাড়ী টি স্টেটে, যেটা কি না পৃথিবীর প্রথম কয়েকটি চা প্রক্রিয়াজাতকারী ফ্যাক্টরির একটি।
প্রতি কিলোগ্রাম সিলভার টিপস ইম্পেরিয়াল চায়ের মূল্য ৪০০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মানে প্রায় ৩৪ হাজার টাকার কাছাকাছি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এটি সবচেয়ে দামী চা।