মরুভূমি মানেই গাছপালা এবং জনমানবহীন বিস্তীর্ণ ধু-ধু প্রান্তর। কিন্তু এই মরুর বুকেই হঠাৎ হঠাৎ দেখা মিলতে পারে সুজলা-সুফলা মরুদ্যানের। বিশাল মরুর বুকে কোথাও মিষ্টি পানির উৎস থাকলে তার আশেপাশে বেড়ে উঠতে পারে সবুজ গাছপালা। ফলে দীর্ঘ মরুপথ পাড়ি দেবার সময় এই মরুদ্যানই হয়ে উঠতে পারে বেদুইনদের জীবনদায়ী আশ্রয়স্থল। ধীরে ধীরে এই মরুদ্যানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে জনপদ, বিস্তৃত হতে পারে ব্যবসা-বাণিজ্য।
এরকমই একটি মরুদ্যান সৌদি আরবের আল-আহসা মরুদ্যান। বিশ্বের আর দশটি মরুদ্যানের চেয়ে এর বিশেষত্ব হলো, এটি বিশ্বের বৃহত্তম মরুদ্যান। যেখানে অধিকাংশ মরুদ্যানের আকার হয় কয়েক হাজার বর্গমিটার থেকে শুরু করে কয়েক হেক্টর পর্যন্ত, সেখানে আল-আহসার আয়তন প্রায় ৮৫ বর্গকিলোমিটার। বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই মরুদ্যানটিতে শুধু খেজুর গাছই আছে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ, যা মরুময় আরবের বুকে সৃষ্টি করেছে এক ব্যতিক্রমী নয়নাভিরাম সৌন্দর্য।
রাজধানী রিয়াদ থেকে ৩৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আল-আহসা মরুদ্যানটির অবস্থান সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশে। যে প্রশাসনিক এলাকায় এর অবস্থান, তার নামকরণও করা হয়েছে মরুদ্যানটির নামানুসারেই- মোহাফাজাত আল-আহসা, তথা আল-আহসা গর্ভনোরেট। পারস্য উপসাগরের তীর থেকে মরুদ্যানটির দূরত্ব মাত্র ৬০ কিলোমিটার। মরুদ্যানটির কারণে সমগ্র আল-আহসা জেলাটিই হয়ে উঠেছে সৌদি আরবের সবুজতম এবং উর্বরতম জেলা।
‘আহসা’ শব্দটি মূলত আরবি ‘হাসা’ শব্দের বহুবচন। হাসা শব্দটি দ্বারা একধরনের বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক ঘটনাকে বোঝানো হয়। বিস্তীর্ণ মরুর বুকে কিছু কিছু স্থানের ভূ-গর্ভের গভীরে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে শক্ত, অভেদ্য শিলাস্তর তৈরি হতে পারে, যার অনেক ওপরে, ভূপৃষ্ঠে থাকে সাধারণ বালির স্তর। এসব স্থানে যখন বৃষ্টিপাত হয়, তখন বৃষ্টির পানি উপরের বালির স্তর ভেদ করে নিচে গিয়ে সঞ্চিত হতে থাকে।
নিচের শিলাস্তর অভেদ্য হওয়ায় এই সঞ্চিত পানি আর গভীরে হারিয়ে যেতে পারে না। আবার উপরে বালির স্তর থাকায় তা সূর্যের তাপে শুকিয়েও যেতে পারে না। ফলে এই দুইয়ের মাঝে ধীরে ধীরে তৈরি হতে থাকে বিশাল জলাধার। কিছু কিছু স্থানে প্রাকৃতিক ঝর্ণার মধ্য দিয়ে এই পানি প্রকৃতিতে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। অন্যান্য স্থানে কূপ বসিয়ে সহজেই এই পানি উত্তোলন করা যায়। এরকম স্থানে মাটির নিচে দিয়ে প্রবাহমান ঝর্ণার কলকল শব্দই ‘হাসা’ নামে পরিচিত।
মানব সভ্যতার সাথে সুপেয় পানির উৎসের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বিশাল মরুর বুকে স্বাদু পানির উপস্থিতির কারণে আল-আহসাও প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের পদচারণায় সমৃদ্ধ হয়ে আসছে। আল-আহসা মরুদ্যান আরব উপদ্বীপের সবচেয়ে প্রাচীন জনবসতিগুলোর মধ্যে একটি। ইসলামের আবির্ভাবেরও অনেক আগে এই অঞ্চলের সাথে প্রাচীন লেভান্ট, মিসরীয় এবং মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার সাথে যোগাযোগ ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
মিষ্টি পানির প্রাচুর্যের কারণে আল-আহসার আশেপাশে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলের মানুষ খাল খনন করে এবং সেচের ব্যবস্থা করে বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করতে শিখেছিল। পুরো আরব উপদ্বীপের মধ্যে আল-আহসাই একমাত্র স্থান, যেখানে চাল উৎপন্ন হতো।
প্রাচীনকাল থেকেই বণিকরা আল-আহসাকে যাত্রাপথের বিরতি হিসেবে ব্যবহার করত। মরিচ, ধুপসহ নানাবিধ পণ্যবাহী কাফেলাগুলোর নিয়মিত যাত্রাপথ ছিল এই স্থানটি। ফলে আল-আহসা নগরী ক্রমেই সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে শুরু করে। এখানকার মানুষরা কৃষিকাজ ছাড়াও কাপড় বোনা, সেলাই করাসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছিল। ধারণা করা হয়, ১০০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময় আল-আহসার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ। এটি ছিল সে তৎকালীন বিশ্বের নবম বৃহত্তম শহর।
মরুভূমির বুকে কোথাও পানির উৎসের দেখা মিললে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই গাছপালাও জন্মাতে শুরু করে। প্রথমে অবশ্য সেখানে শুধুমাত্র পানিই থাকে। কিন্তু পাখিরা দূরের আকাশে ওড়ার সময় পানির অস্তিত্ব অনুভব করে মরুদ্যানে নেমে এলে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন বীজ পানির উৎসের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। মাটি উর্বর হওয়ায় সেই বীজ থেকে সহজেই গাছপালা জন্মে এবং মরুদ্যানটিকে সবুজ বনভূমিতে পরিণত করে।
আল-আহসানে মরুদ্যানেও অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জুড়ে রয়েছে বিশাল বনভূমি। এসব বনে ২৫ থেকে ৩০ লাখ খেজুর গাছ ছাড়াও আছে নানান জাতের শস্য এবং ফলমূলের বৃক্ষ। আল-আহসার খেজুরের বাগানগুলো থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫ টন খেজুর উৎপাদন করা হয়। খালাসা খেজুরসহ বিশ্বের সবচেয়ে সুস্বাদু এবং বিখ্যাত জাতের কিছু খেজুরের উৎপত্তিস্থল হিসেবে আল-আহসা বিখ্যাত।
কৃষিকাজের জন্য আল-আহসার জনগণ নির্ভর করে এর অনেকগুলো প্রাকৃতিক ঝর্ণার ওপর। আহসা মরুদ্যানে এরকম ঝর্ণার সংখ্যা অন্তত ৬৫টি। এদের মধ্যে শুধু স্বাদু পানির ঝর্ণাই না, আছে উষ্ণ পানির প্রস্রবণও, যেগুলোর কয়েকটির তাপমাত্রা কখনও কখনও ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত পৌঁছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত আইন নাজ্ম প্রস্রবণ, যার সালফার সমৃদ্ধ উষ্ণ পানি বিভিন্ন রোগ নিরাময়ে সক্ষম বলে স্থানীয়ভাবে বিশ্বাস করা হয়।
আল-আহসার ভূ-গর্ভস্থ পানি অধিকাংশ স্থানেই ৫০০ থেকে ৬০০ ফিট গভীরে অবস্থিত। কিন্তু কিছু কিছু স্থানে সেগুলো ভূ-পৃষ্ঠের ৪০-৫০ মিটের কাছাকাছি দিয়ে প্রবাহিত হয়, যেখান থেকে সহজেই মোটরের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে ব্যবহার করা হয়। আহসার সর্ববৃহৎ ঝর্ণাগুলো গড়ে প্রতি মিনিটে ২০ হাজার গ্যালন পানি প্রবাহিত করতে পারে। সবগুলো ঝর্ণা দ্বারা একত্রে প্রতি মিনিটে প্রায় দেড় লাখ গ্যালন পানি প্রবাহিত হয়।
বেশকিছু স্থানে পানি ভূ-পৃষ্ঠে উঠে এসে ঝর্ণা এবং হ্রদের সৃষ্টি করে। এই হ্রদগুলো যে শুধুমাত্র চারদিকের ঝর্ণা থেকে আসা পানিকেই আকৃষ্ট করে, তা না। এগুলো দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদেরকেও সমানভাবে আকৃষ্ট করে। মানুষ এখানে বনভোজন করার জন্য বা স্নান করার জন্য, কিংবা নিছক প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্যও বেড়াতে আসে। এসব হ্রদের এবং ঝর্ণার পাশে বিভিন্ন স্থানে নারীদের জন্যও স্নানঘরের ব্যবস্থা রাখা আছে।
শুধু পর্যটন কেন্দ্রই না, আল-আহসা একইসাথে সৌদি আরবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং বাণিজ্য নগরী। ত্রিশের দশকে নিকটবর্তী দাম্মাম শহরে খনিজ তেল আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই আহসা জেলাটি অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলক্ষেত্র আল-গাওয়ার অয়েল ফিল্ডের অবস্থান এই আহসা জেলাতেই। এখান থেকে প্রতিদিন প্রায় পৌনে চার মিলিয়ন ব্যারেল তেল উত্তোলন করা হয়।
পারস্য উপসাগরের তীরে অবস্থিত হওয়ায় আল-আহসা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ‘আরবের প্রবেশপথ‘ নামে পরিচিত ছিল। ইসলামের শুরুর দিকে আরবের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত অঞ্চলগুলো থেকে আগত হজ্জযাত্রীদের প্রতিটি কাফেলা আল-আহসার উপর দিয়েই মক্কার দিকে অগ্রসর হতো। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এটি ছিল ইয়েমেন এবং ইরাকে যাতায়াতের মধ্যে প্রধান ট্রানজিট। এখনও পর্যন্ত এই এলাকাটি সৌদি আরব থেকে পার্শ্ববর্তী আরব আমিরাত, কাতার এবং ওমানে যাওয়ার অন্যতম প্রধান মাধ্যম।
আল-আহসা শুধুমাত্র মরুদ্যান হিসেবেই না, একইসাথে প্রাচীন নগরীর নিদর্শন হিসেবেও বিখ্যাত। এর সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনের অনেক কিছু এখনও অক্ষত আছে। মরুদ্যানকেন্দ্রিক শহরগুলোর বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত প্রাচীন মসজিদ, দুর্গ, কূপ, খাল এবং সেচব্যবস্থা আজও এর হাজার বছরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করে চলছে।
২০১৮ সালে ইউনেস্কো আল-আহসাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে দেয়া বর্ণনা অনুযায়ী, আল-আহসা হচ্ছে মানুষের সাথে প্রকৃতির মিথস্ক্রিয়ার এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ।