ছোটবেলায় আমরা সকলেই গালিভার ট্রাভেলসের গল্প পড়েছি। গালিভার নামক এক ভ্রমণকারী ঘুরতে ঘুরতে লিলিপুটদের দেশে এসে পড়েন, যে দেশে সকলেই ছিল বামন। সাধারণ উচ্চতার কোনো মানুষ ছিল না সেখানে। এরপর লিলিপুট আর গালিভারকে নিয়ে ঘটনা প্রবাহ এগোতে থাকে। এবার গল্পের কাহিনী ছেড়ে বাস্তবে ফেরা যাক। বাস্তবেও রয়েছে এমন একটি গ্রাম, যেখানে শুধু বেঁটে লোকদের বসবাস। এমন আবার হয় নাকি? চলুন আজকে জেনে নিই এমন এক গ্রামের কথা, যেখানে গেলে দেখা মিলবে অসংখ্য কম উচ্চতার মানুষের সাথে।
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সিচুয়ান প্রদেশের একটি দূরবর্তী গ্রাম ইয়াংসি। অন্যান্য গ্রাম থেকে এ গ্রামটি একদিক দিয়ে একেবারেই আলাদা। অসংখ্য বামনদের বসবাস এই গ্রামকে ভিন্নতা এনে দিয়েছে। গ্রামের শতকরা ৪০ ভাগ মানুষই বামন। বামনরা যে চীনের অন্য কোনো এলাকা থেকে এসে এই গ্রামে বসবাস শুরু করেছে, ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও এমন নয়। এই গ্রামেই তাদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।
বিস্তারিত বিবরণে যাওয়ার আগে খর্বাকৃতির মানুষদের সম্পর্কে কিছু কথা বলে রাখা প্রয়োজন। বিজ্ঞানের ভাষায়, কিছু কিছু মানুষের জিনগত কারণে স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। স্বাভাবিক উচ্চতার তুলনায় তাদের উচ্চতা বেশ খানিকটা কম হয়।
- অনেক ক্ষেত্রে মানুষ স্বাভাবিক উচ্চতার হলেও তাদের শরীরের কোনো কোনো অঙ্গ অপেক্ষাকৃত ছোট হয় এবং বাকি অঙ্গগুলো স্বাভাবিক থাকে। বিজ্ঞান বলে, হাড়ের স্বাভাবিক বৃদ্ধি না হওয়াই এসব ক্ষেত্রে দায়ী।
- আবার কিছু মানুষের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়েও অনেক কম হয়। জিনগত বা জন্মগত বিভিন্ন ত্রুটিকে এসব ক্ষেত্রে দায়ী করে থাকে বিজ্ঞান।
একজন স্বাভাবিক মানুষের উচ্চতা ৪ ফুট ১০ ইঞ্চির কম হয়ে থাকলে তাকে খর্বাকৃতির বা বামন বলে গণ্য করা হয়। সাধারণত বামনদের গড় উচ্চতা ধরা হয় ৪ ফুট। ইয়াংসি গ্রামের সর্বাপেক্ষা লম্বা বামনের উচ্চতা ৩ ফুট ১০ ইঞ্চি এবং সর্বাপেক্ষা খাটো বামনের উচ্চতা ২ ফুট ১ ইঞ্চি।
এই গ্রামে বামনদের এত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানীদের কাছে এক কৌতূহলের বিষয়। এই গ্রামের লোকদের সম্পর্কে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জানাজানি হয় ১৯৫১ সালে। যদিও ১৯১১ সাল থেকে এই গ্রাম এবং গ্রামের অধিবাসী নিয়ে কানাঘুষা শোনা যেত, কিন্তু ১৯৫১ সালের আগে ঠিক কেউ আমলে নেয়নি ব্যাপারটি। ১৯৪৭ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী ড. কেরিল রবিন ইভানস তার এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন, “আমি ঐ এলাকায় বেশ কিছু বামন দেখেছিলাম।”
১৯৫১ সালে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য নির্দেশ দেয়া হয় সরকারিভাবে এবং রিপোর্টে বলা হয়, “ইয়াংসি গ্রামে ছোট ছোট হাত-পাওয়ালা অনেক মানুষ দেখা গেছে।” অতঃপর বিজ্ঞানী এবং অন্যান্য অনুসন্ধানকারীরা গ্রামটিতে পরিদর্শনে যান সরেজমিনে তদন্ত করে এমন অস্বাভাবিক ঘটনার কারণ খুঁজে বের করার জন্য।
তারা সম্ভাব্য সকল রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করেন; যেমন– তাদের শরীরের বিভিন্ন রকম পরীক্ষা করা হয়, ঐ এলাকার পানি, মাটি, এমনকি শস্যগুলোও নিরীক্ষা করে দেখা হয়। তারা ধারণা করেছিলেন, মাটিতে হয়ত অতিরিক্ত মাত্রায় পারদের উপস্থিতি রয়েছে, যার কারণে তা শরীরে এমন প্রভাব ফেলছে। কিন্তু মাটি পরীক্ষা করে এমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি গ্রামের প্রত্যেক খর্বাকৃতির মানুষকে আলাদাভাবে পরীক্ষা করা দেখা হয়। কিন্তু সেরকম কোনো প্রমাণ মেলেনি, যাতে করে বিজ্ঞানীরা সেই কারণকে এমন অস্বাভাবিকতার যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে পারেন। ধোঁয়াশাতেই রয়ে গেল পুরো ব্যাপারটি, জানা গেল না প্রকৃত কারণ।
১৯৮৫ সালে ইয়াংসি গ্রামে একটি জরিপ করা হয়, যাতে ১১৯ জন বামনের বেঁচে থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। সবচেয়ে অবাক করা তথ্য হলো যে, একজন বামনের খর্বাকৃতির যে অস্বাভাবিকতা রয়েছে তা শুধুমাত্র তার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বংশানুক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে তার বংশধরদের মাঝেও। বিজ্ঞানীরা বহু চেষ্টা করেও আজ পর্যন্ত সঠিক কারণটি খুঁজে বের করতে পারেননি।
এমন খর্বাকৃতির কারণ সম্পর্কে ইয়াংসি গ্রামে অনেকগুলো প্রচলিত মতবাদ রয়েছে। গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তির মতে,
“আমরা সকলে বেশ সুখে-শান্তিতেই বসবাস করছিলাম। হঠাৎ এক গ্রীষ্মের রাতে অজানা এক রোগ ছড়িয়ে পড়ে আমাদের গ্রামে। ৫-৭ বছর বয়সী শিশুরা এতে আক্রান্ত হয় এবং ওদের স্বাভাবিক দৈহিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। শুধুমাত্র যে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধিই থেমে গিয়েছিল তা নয়, নানা রকম শারীরিক বিকলাঙ্গতাও দেখা দেয়।”
অনেকে বলে থাকেন, “অশুভ কিছুর ছায়া পড়েছে এই গ্রামে, তাই এমন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে দিনের পর দিন“। কুসংস্কারে বিশ্বাসী অনেক মানুষের ধারণা, তারা হয়ত তাদের পূর্বপুরুষদের মৃতদেহের সৎকার ঠিকঠাকভাবে করতে পারেনি, তাই তাদের অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপে এমনটা ঘটছে।
সবচেয়ে অদ্ভুত যে মতবাদটি রয়েছে তা হলো, বেশ কয়েক দশক পূর্বে ওয়াং নামক এক ব্যক্তি ইয়াংসি গ্রামে বসবাস করতেন। একদিন তিনি অদ্ভুত পা বিশিষ্ট একটি কালো রংয়ের কচ্ছপ দেখতে পান। আগ্রহের বশে সকল গ্রামবাসী একত্র হন কচ্ছপটিকে দেখার জন্য। এর মাঝে অনেকেই বলেন কচ্ছপটিকে ছেড়ে দেয়ার জন্য, আবার কিছু মানুষ এতে দ্বিমত পোষণ করেন। শেষমেশ কচ্ছপটিকে আগুনে ঝলসিয়ে ভূরিভোজ সারেন সকলে মিলে। তখন থেকে এই খর্বাকৃতির ব্যাধিটি সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ ধারণা করতে থাকে অদ্ভুত পা বিশিষ্ট কচ্ছপটির সাথে সেদিনের অন্যায় ব্যবহারের কারণেই আজ তাদের এমন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
অনেকে আবার বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া চীন-জাপান যুদ্ধের সময়ে বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহারকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু এমন যুক্তির বাস্তবিক কোনো ভিত্তি পাওয়া যায় না। কারণ সেই যুদ্ধের স্থান ছিল ইয়াংসি গ্রাম থেকে বহুদূরে। এই অদ্ভুত খর্বাকৃতির রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে বছরের পর বছর মানুষ এই গ্রাম ছেড়ে অন্য কোনো গ্রাম বা শহরে স্থানান্তরিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
চীন সরকার যে এমন একটি গ্রাম সম্পর্কে জানতো না, তা নয়। তবে চীনের কখনো কোনো মাথাব্যথা ছিল না এই গ্রামকে নিয়ে। এমনকি পর্যটকদের জন্যও কখনো এই গ্রামটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়নি। তবে চীন সরকারের কাছ থেকে এর ব্যাপারে কোনো সদুত্তর মেলেনি যে কেন গ্রামে ভ্রমণের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা ছিল।
এতসব কারণে এ গ্রামটির উন্নতি কখনো ত্বরান্বিত হয়নি। অবশেষে ইয়াংসিবাসীদের জীবনযাত্রার মানকে কিছুটা উন্নত করার জন্য ২০০৯ সালে এখানে একটি বিনোদন পার্ক স্থাপন করা হয়। ১৯-৪৯ বছর বয়সী প্রায় ১০০ জন বামন এখানে নাচ, গান সহ নানা রকম বিনোদনমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে থাকে। এই পার্কের মূল উদ্দেশ্য ছিল বামনদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক সাফল্য। এ পার্কের কারণে বামনেরা বহির্বিশ্বের মানুষের সাথে যোগাযোগের সুযোগ পেয়েছে। তারাও এখানে কাজ করতে পেরে খুব আনন্দিত।