পশ্চিম আমেরিকার ওয়াইওমিং রাজ্যের ব্ল্যাক হিল অঞ্চল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার একটি আদর্শ স্থান। পাহাড়ে হাইক করতে প্রতি বছর অসংখ্য মানুষ পাড়ি জমায় এই পাহাড়ের পাদদেশে। হাইক করতে করতে যখন দর্শনার্থীরা বেল ফশ নদীর তীরে পৌঁছায়, তখন সবারই চোখ আটকে যায় একটি টাওয়ার সদৃশ বস্তুর উপর। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে এটি কোনো প্রাচীন স্থাপত্য, যা এই অঞ্চলের আদিবাসীদের তৈরী। যেমনটা দেখা যায় মিশর, পেরু কিংবা স্কটল্যান্ডে। তবে কাছে গেলে সেই ভুল ভেঙে যায়। টাওয়ারটি প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্টি। দেখতে অনেকটা খাঁজকাটা চূড়ার মতো।
এর নাম ডেভিলস টাওয়ার কেন?
১৮৭৫ সালে আমেরিকান কর্নেল রিচার্ড আরভিং ডজের নেতৃত্বে বিজ্ঞানী ভূতত্ত্ববিদ ওয়াল্টার পি.জেনি ব্ল্যাক হিল অঞ্চলে একটি ভূতাত্ত্বিক গবেষণা চালান। তাদের কাছে খবর ছিল যে, এখানে অনেক স্বর্ণ মজুদ আছে। তারা সেখানে পৌঁছে কোনো সোনা খুঁজে পেলেন না ঠিকই, তবে এই টাওয়ারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ডজ একে বিশ্বের সবচেয়ে অসাধারণ চূড়াগুলোর একটি বলে উল্লেখ করেন। নেটিভ আমেরিকানরা একে ‘Lakota Matȟó Thípila’ বলে ডাকতো, যার অর্থ ‘হোম অভ বিয়ার’ বা ভাল্লুকের বাসস্থান। তবে যে ব্যক্তি নেটিভ আমেরিকার মানুষদের দেওয়া নামের অনুবাদ করেন, তিনি ভুলবশত Bad God’s Tower বা খারাপ দেবতার টাওয়ার অনুবাদ করেন। কর্নেল ডজ তাই এর নাম দেন ‘ডেভিলস টাওয়ার’। এই ভুল নামটিই একসময় বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
স্থানীয় উপকথা
কথিত আছে, ভাল্লুকের হাত থেকে বাঁচার জন্য স্থানীয়রা একটা পাথরের উপর উঠে হাঁটু গেড়ে বসে তাদের মহৎ আত্মার কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করে। মহৎ আত্মা তাদের প্রার্থনা শুনতে পায় এবং তাদের বাঁচাতে পাথরটিকে স্বর্গের দিকে প্রসারিত করে দেয়। তা-ও ভাল্লুকেরা চূড়ায় ওঠার চেষ্টা করতে থাকে। আর ভাল্লুকের নখের আঁচড়ে টাওয়ারের গায়ে খাঁজকাটা আকৃতি দেখা দেয়।
সাইয়ান ইন্ডিয়ানরা আরেকটি গল্প বলে। তারা বলে, ভাল্লুকেরা দুটি মেয়ে বাদে বাকি সবাইকে মেরে ফেলে। বেঁচে যাওয়া মেয়েরা তাদের বাসস্থানে ফিরে এসে ছেলেদের ঘটনাটি বলে। তারা তাদের ধর্মগুরুর মাধ্যমে জানতে পারে যে, ভাল্লুকের পায়ের নিচে তীর মারতে পারলেই তাদের মারা সম্ভব। ছেলেরা বুদ্ধি করে ভাল্লুকগুলোকে ওই চূড়ার কাছে নিয়ে যায় এবং ভাল্লুকেরা ভাবে ছেলেগুলো চূড়ার উপরে। ভাল্লুকেরা তখন চূড়ায় ওঠার জন্য বারবার চেষ্টা করতে থাকে, যার ফলে চূড়ার গায়ে বেশি বেশি খাঁজ দেখা দেয়। একসময় ছেলেদের ছোঁড়া একটি তীর ভাল্লুকের পায়ের খুব কাছে লাগে এবং ভাল্লুকেরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। এভাবেই উৎপত্তি হয় এই চূড়ার।
আধুনিক তত্ত্ব
বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর উন্নতির সাথে সাথে ডেভিলস টাওয়ার নিয়ে এক আধুনিক তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষ বিশ্বাস করে, এই টাওয়ার কোনো বহির্জাগতিক শক্তির সৃষ্টি। তারা মনে করে, এটি কোনো এলিয়েন স্পেসশিপ ল্যান্ডিং স্টেশন ছিল। এই ধারণার ওপর ১৯৯৭ সালে একটি সিনেমা নির্মাতাকে ‘Close Encounters of the Third Kind‘ নামে, যা মানুষের মধ্যে এই ধারণা আরও বদ্ধমূল করে। ২০১১ সালে ‘পল’ নামে একটি সিনেমা নির্মিত হয়, যেখানেও এই টাওয়ারের সাথে এলিয়েনের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে।
ভৌগোলিক বিবরণ
ডেভিলস টাওয়ার আমেরিকার ওয়াইওমিং রাজ্যে অবস্থিত। এটি ২৬৫ মিটার বা ৭৬৮ ফুট উঁচু। এর চূড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫,১১২ ফুট উঁচু। এটি ম্যাগমা বা লাভা সঞ্চিত হয়ে সৃষ্টি বলে ভূতাত্ত্বিকগণ মনে করেন। তাদের মতে, ভূপৃষ্ঠের ফাটলের মধ্যে গলিত ম্যাগমা সঞ্চিত হয়ে থাকে। ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে টেক্টনিক প্লেটের চাপে যখন রকি মাউন্টেনের উত্থান হয়, তখন এই জমে যাওয়া ম্যাগমার খণ্ড উঠে আসে। পরে হাজার বছর ধরে বাতাস এবং বৃষ্টির প্রভাবে আশেপাশের মাটি ক্ষয়ে যায় এবং জমাটবাঁধা এই ম্যাগমার চূড়া পড়ে থাকে।
কয়েক দশক ধরে ডেভিলস টাওয়ার মানুষের মধ্যে অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ক্লাইম্বিংয়ের জন্য প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ ছুটে আসে এখানে। দুটি সিনেমায় এই টাওয়ারের নাম থাকায় দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে এখানে। এছাড়া এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও উপভোগ করার মতো।
কয়েকটি বিশেষ তথ্য
- ডেভিলস টাওয়ার আমেরিকার সর্বপ্রথম স্বীকৃত জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯০৬ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট একে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করেন।
- ২০০৫ সালে নেটিভ আমেরিকানরা এই চূড়ার বিকৃত নাম পরিবর্তনের দাবি জানায়। তবে অনেক ইতিহাস এই নামের সাথে জড়িত থাকায় তাদের দাবি মানা হয়নি।
- এই টাওয়ারটি আগ্নেয়গিরি পাথর দ্বারা তৈরি হলেও এটি আসলে আগ্নেয়গিরি না। এমনকি খুব কাছেও কোনো আগ্নেয়গিরি নেই।
- অনেকে মনে করত, এটি আসলে ভেতর দিকে ফাঁপা। এর ভেতরে কোনো গোপন মিলিটারি বেজ বা এলিয়েন চেম্বার আছে। তবে ভূতাত্ত্বিকরা মনে করেন এটি ফাঁপা নয়।
- এর চূড়ার উপরের অংশ প্রায় একটা ফুটবল মাঠের সমান উঁচু। তবে এখানে ফুটবল খেলা যাবে না, কারণ সরকারি বিধি-নিষেধ রয়েছে।
- জুন মাসে এর চূড়ায় ওঠার অনুমতি নেই, কারণ সে সময় এখানে অনেক নেটিভ আমেরিকান ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়। এছাড়া কিছু রাস্তা শীতে পাখিদের বাসা বোনার জন্য বন্ধ করে রাখা হয়।