আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটি হলো অরোরা বা মেরুজ্যোতি। মেরু অঞ্চলের আকাশে দৃশ্যমান বিভিন্ন রঙের এই আলোকচ্ছটা সকলের চোখই ধাঁধিয়ে দেয়। যুগে যুগে একে ঘিরে জন্ম নিয়েছে অজস্র মিথ। অরোরার সৌন্দর্য ব্যাখ্যাতীত হলেও এর পেছনে প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের কারিকুরির কিন্তু স্পষ্ট একটি ব্যাখ্যা আছে।
সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে, বায়ুমণ্ডলের ম্যাগনেটোস্ফিয়ার স্তরের চার্জিত কণাসমূহ এবং থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে শক্তি সৃষ্টি হয়, যা অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হয় বায়ুমণ্ডলে। এই সঞ্চিত শক্তি যখন আলোকশক্তি হিসেবে বিকিরিত হয়, তখনই মেরুজ্যোতি দেখা যায়। সহজ ভাষায়, রঙ-বেরঙের আলোর খেলা দেখা যায়।
উত্তর অক্ষাংশে এটি অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দার্ন লাইটস বা সুমেরুজ্যোতি নামে পরিচিত। আর দক্ষিণে এর নাম অরোরা অস্ট্রালিস বা সাউদার্ন লাইটস বা কুমেরুজ্যোতি।
অরোরা বোরিয়ালিস বেশ কিছু স্থান থেকে দৃশ্যমান হলেও অরোরা অস্ট্রালিস দেখতে পাওয়ার স্থান বা জায়গা অত্যন্ত সীমিত। অরোরা বোরিয়ালিস এবং অরোরা অস্ট্রালিস দেখতে পাওয়া যায় এমন কয়েকটি জায়গা বা দেশ নিয়ে আজকের এই লেখা।
ইয়েলোনাইফ
কানাডার শহর ইয়েলোনাইফ সুমেরু প্রভা দেখার জন্য একটি উপযুক্ত শহর। কানাডার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত জায়গাটি থেকে দৃষ্টিগোচর একধরনের মেরুজ্যোতি, যাকে বলা হয় অরোরা বোরিয়ালিস বা নর্দার্ন লাইটস।
নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে এপ্রিলের শুরু পর্যন্ত শীতের দীর্ঘ ও স্বচ্ছ রাতে সুমেরুজ্যোতি সবচেয়ে ভালো দেখা যায়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুতেও দেখা মেলে এই মেরুজ্যোতির। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে আকাশে সবুজ, লাল ও ফিকে লাল রঙের আলোর সমাহার দেখা যায়।
মেরুজ্যোতি দেখার জন্য উড বাফেলো এবং জ্যাসপার ন্যাশনাল পার্ক হলো ইয়েলোনাইফের জনপ্রিয় দুটি স্পট। অনেক কোম্পানি আছে যেগুলো সুমেরু প্রভা দেখার অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করে থাকে। নিজে নিজেও ঘুরতে বের হওয়া যায় এবং মনোরম দৃশ্যের এই অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়। শর্ত হলো শহর থেকে যত দূরে যাবেন, তত উঁচু স্থানের স্পটে অরোরা দেখার জন্য যেতে হবে। স্পট যত উঁচুতে এবং অন্ধকারে ঘেরা, অরোরা বোরিয়ালিসও তত বেশি দৃশ্যমান ও আকর্ষণীয়।
ইয়েলোনাইফে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের শেষ পর্যন্ত অরোরা দেখার জন্য সঠিক সময়। তবে বিশেষভাবে চার্চিল এবং উড বাফেলোর কথা বললে অরোরা বোরিয়ালিস দেখার উপযুক্ত সময় আগস্টের শুরু থেকে মে মাস পর্যন্ত।
আইসল্যান্ড
চোখধাঁধানো প্রাকৃতিক দৃশ্যে ঘেরা আইসল্যান্ডে বিস্ময়কর ঘটনার অভাব নেই। বরফের গুহা, তুষারস্রোত ও আগ্নেয়গিরির অপার্থিব সৌন্দর্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে টিকে আছে আইসল্যান্ডের মেরুজ্যোতি বা অরোরা।
আইসল্যান্ডের আকাশে সারা বছরই অরোরা বোরিয়ালিসের অস্তিত্ব থাকে, কিন্তু তা সবসময় দেখা যায় না। পরিবর্তনশীল মেরুজ্যোতি শুধুমাত্র শর্তসাপেক্ষে সকলের দৃষ্টিলব্ধ হয়। শীতের সময়ে মূলত এই সুমেরু প্রভা দেখা যায়। উপযুক্ত সৌর গতিবিধি, স্বচ্ছ আকাশ এবং একদম কম আলো থাকলে সুমেরু প্রভার ঔজ্জ্বল্য আকাশে ছড়িয়ে পড়ে।
একটি মজার বিষয় হলো, শীতকালে আইসল্যান্ডে শুধুমাত্র দুই থেকে চার ঘণ্টা দিনের আলো থাকে। অর্থাৎ দিনের বাকি সময়টুকু পর্যটকেরা মেরুজ্যোতি দেখার সুযোগ পান। তাছাড়া শীতে দেশটি বরফে ঘেরা হওয়ায় তা প্রকৃতিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।
ফেয়ারব্যাংকস, আলাস্কা
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ফেয়ারব্যাংকস থেকে অরোরা খুব সহজেই দেখা যায়। আর এজন্য আপনাকে শীতকালের অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে না। কারণ এই শহরের অবস্থান অরোরা ওভালে।
ফেয়ারব্যাংকসে প্রায় সারা বছরই, বিশেষত আগস্টের ২১ থেকে এপ্রিলের ২১ তারিখ পর্যন্ত অরোরা বা মেরুজ্যোতির দেখা মেলে। এই শহরের একটু বাইরে অবস্থিত ইস্টার এবং মারফি ডোম থেকে অরোরার ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়, যা অন্য কোনো স্পট থেকে সচরাচর সম্ভব নয়।
আর এই স্পট দুটিতে তেমন আলো দূষণ না থাকায় মেরুজ্যোতি খুব পরিষ্কার করে দেখা যায়। শহরটির নিজস্ব অরোরা ফোরকাস্টিং বা পূর্বাভাস সিস্টেম রয়েছে। পর্যটকদের অরোরা দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থাও রয়েছে।
ট্রমসো
উত্তর নরওয়ের সবচেয়ে বড় শহুরে এলাকা ট্রমসো আর্কটিক সার্কেল থেকে ২১৭ মাইল উত্তরে অবস্থিত। অরোরা ওভালের মাঝে এটি অবস্থিত হওয়ায় মেরুজ্যোতির গতিবিধি কম হওয়া সত্ত্বেও তা সহজেই দেখা যায়।
শহরটিতে কানাডা, আলাস্কা, সাইবেরিয়ার মতো অতিরিক্ত ঠাণ্ডাও থাকে না, আবার আইসল্যান্ডের মতো ঝড়ো বাতাসও থাকে না। তাই সহনীয় পরিস্থিতিতে আরামে উপভোগ করা যায় এই প্রাকৃতিক আশ্চর্য।
ট্রমসো শহরের একদম ভেতর থেকে অরোরা দেখা সম্ভব। তবে তা বিরল। আবহাওয়া ভালো থাকলেও আলো দূষণ থেকে দূরে ও আরো অন্ধকার এলাকায় অরোরা দেখার সুযোগে বেরিয়ে পড়ে পর্যটকেরা।
শহরের কেন্দ্র থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই এরকম স্পট পেয়ে যাবেন। ট্রমসো থেকে ১২ মাইল দূরে অবস্থিত এর্সফজর্ডবোন, যেখান থেকে অরোরা ভালো করে দেখা যায়। তাছাড়া লোফোতেন দ্বীপপুঞ্জ, আল্টা, নর্দকাপ এবং কির্কেনস থেকেও অরোরা দৃশ্যমান।
গ্রিনল্যান্ড
গ্রিনল্যান্ডের আকাশে জাদুর মতো চলতে থাকে আলোর খেলা। অরোরা ভালোমতো দেখতে পাওয়ার একটি শর্ত হলো পরিচ্ছন্ন ও অন্ধকার আকাশ। গ্রিনল্যান্ড খুব ভালো করেই এই শর্ত পূরণ করে।
গ্রিনল্যান্ডের কাঙ্গেরলুসুয়াক থেকে দেখা যায় সবুজ রঙের পর্দার মতো মেরুজ্যোতি। বর্ণালির ত্বরণ, উদ্দীপনা এবং আয়নীকরণের ভিন্নতার ওপর নির্ভর করে আকাশে মেরুজ্যোতির রঙের পরিবর্তনও দেখা যায়। তবে এসব রঙের পরিবর্তন প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়েই তোলে, কোনো অংশে কমায় না।
এই দ্বীপ থেকে অরোরা দেখতে চাইলে কাঙ্গেরলুসুয়াকই সবচাইতে উপযুক্ত স্থান। আগস্টের শেষ থেকে এপ্রিলের শুরুর দিক পর্যন্ত সুমেরু প্রভা এই অঞ্চলে স্পষ্ট থাকে।
উত্তর সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড
সুইডেনের সবচেয়ে উত্তরের শহর কিরুনা। এখানে আইসহোটেল, পার্বত্য আবিস্কো ন্যাশনাল পার্কের মতো আকর্ষণ রয়েছে। আর এসব স্থান হতে অরোরা বোরিয়ালিসও দৃষ্টিগোচর। উত্তর সুইডেনে অরোরা দেখা গেলেও দক্ষিণ সুইডেনে এরকম প্রাকৃতিক দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। সেপ্টেম্বরের শেষের দিক থেকে এপ্রিলের শুরুর দিক অবধি উত্তর সুইডেনের আকাশে অরোরার রঙ ছড়িয়ে পড়ে।
ফিনল্যান্ডের ল্যাপল্যান্ড থেকে অরোরা দেখা সম্ভব। তবে নির্দিষ্ট কোনো স্থান বলা সম্ভব নয়, যেখান থেকে পরিষ্কারভাবে অরোরা বোরিয়ালিস দেখা যায়। আবহাওয়া এবং কুয়াশাচ্ছন্নতার উপর বিষয়টি নির্ভর করে। ল্যাপল্যান্ডের জনসংখ্যা কম হওয়ায় অরোরা দেখার জন্য নিরিবিলি ও অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থান পাওয়া কঠিন কিছু নয়। এখানেও শীতকালেই অরোরা স্পষ্টভাবে দেখা যায়।
তাসমানিয়া এবং নিউজিল্যান্ড
সুমেরুজ্যোতি বা নর্দার্ন লাইটসের কথা উঠলে অনেক স্থানের নামই নেয়া যায়। কিন্তু সাউদার্ন লাইটস বা অরোরা অস্ট্রালিস দেখার জন্য উপযুক্ত স্থানের তেমন কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না। সাউদার্ন লাইটস বা কুমেরু প্রভা দেখার জন্য আপনাকে যেতে হবে তাসমানিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে। অ্যান্টার্কটিকার বাইরে দক্ষিণ মেরু বা কুমেরুর সবচেয়ে কাছে এই দুটি স্থানই রয়েছে।
নিউজিল্যান্ডের স্টিউয়ার্ট দ্বীপ, কুইনস টাউন, টেকাপো লেক, দ্য কাটলিনস, ইনভারকার্গিল, আওরাকি, গ্রেট বেরিয়ার থেকে অরোরা অস্ট্রালিস দেখা যায়। শীতের সময় তথা জুন থেকে আগস্টের এই সময় কুমেরুতে অবস্থিত নিউজিল্যান্ডে সাউদার্ন লাইটস দৃষ্টিগোচর হয়।
আর তাসমানিয়ার ক্ষেত্রে হবার্ট, মাউন্ট নেলসন, মাউন্ট উইলিংটন, সাউথ আর্ম পেনিন্সুয়ালা, টিন্ডারবক্স, ককল ক্রিক, হাওডেনে অরোরা দেখার সুযোগ রয়েছে। জুন থেকে আগস্ট এবং ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি তাসমানিয়া থেকে ভালোমতো অরোরা দেখা যায়। অরোরা বোরিয়ালিসের মতো অরোরা অস্ট্রালিস ভালোমতো দেখতে হলেও শীতকালের অপেক্ষায় থাকতে হয়।