একটি জাহাজ দূর সমুদ্রের বুকে পাড়ি দিয়েছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে বলে। দিন যায়, রাত যায়, গন্তব্যের নিকটবর্তী হতে থাকে জাহাজটি। পৌঁছানোর কিছুদিন পূর্বেই হঠাৎ করে জাহাজটি উধাও হয়ে যায়, অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কোনো হদিস মেলে না। তবে জাহাজটি কি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল? নাকি সমুদ্রের বুকে লুকিয়ে থাকা কোনো গোপন শক্তির কবলে পড়েছিল? প্রশান্ত মহাসাগরে রয়েছে এমনই এক রহস্যময় জায়গা, যা ডেভিলস সী বা শয়তানের সাগর নামে পরিচিত। আসুন জেনে নেয়া যাক এ সম্পর্কে-
জাপান এবং বোনিন দ্বীপের মধ্যবর্তী একটি জায়গা ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল হিসেবে পরিচিত। আর এর আশেপাশের এলাকাটিকেই বলা হয়ে থাকে ডেভিলস সী বা শয়তানের সাগর। এটি জাপান, তাইওয়ান এবং ইয়াপ দ্বীপপুঞ্জকে সংযুক্ত করেছে। দশকের পর দশক জুড়ে এই স্থানটি এক অজানা রহস্যের আধার হিসেবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। এমন রহস্যময়তার কারণে জায়গাটি সাগরের বুকে একটি অশুভ স্থান হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের জমজ বলে থাকেন। ছোট ছোট নৌকা থেকে শুরু করে বিশাল জাহাজ এমনকি এ জায়গার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানগুলোও মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। এদের শেষ পরিণতি আসলে কী হয়, তা আজও জানা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল– এমন নামকরণের পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। চীনে প্রায় ১০০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে একটি পৌরাণিক মতবাদ চলে আসছে। তা হলো এই সাগরের পানির অতল গহীনে লুকিয়ে রয়েছে এক বিশাল ড্রাগন। সে যখন পানির নিচে চলাফেরা করে তখন সাগরের বুকে বড় বড় ঢেউ, ঘূর্ণিপাক, সামুদ্রিক ঝড়সহ চারিদিকে ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায়। ড্রাগন তার ক্ষুধা নিবারণের জন্য সমুদ্রপৃষ্ঠে চলাচলরত বিভিন্ন জাহাজ বা আকাশপথে চলমান কোনো বিমানকে টেনে পানির নিচে নিয়ে যায় এবং তাতে থাকা মানুষদের খেয়ে ফেলে। এ কারণেই জায়গাটি ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল নামে পরিচিত হয়ে আসছে সেই শতশত বছর আগে থেকে।
১৯৫২-৫৪ সাল, এ সময়টাতে মোট পাঁচটি সামরিক জাহাজ এ জায়গা অতিক্রম করার সময় নিখোঁজ হয়ে যায় এবং এতে প্রায় ৭০০ লোক প্রাণ হারান। আবহাওয়াবিদদের কাছ থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনার সময়গুলোতে আবহাওয়া একদম শান্ত ছিল এবং জাহাজগুলো থেকে কোনো ধরনের সাহায্যের আবেদনও করা হয়নি। এমন ঘটনার পর অনেকেই এই পৌরাণিক মতবাদটিকে সত্য বলে ভাবতে শুরু করেন।
১৮০০ শতকের দিকে লোকমুখে প্রায়ই শোনা যেত, অনেকেই ওই এলাকায় জাহাজে করে এক রহস্যময় নারীকে প্রদক্ষিণ করতে দেখেছেন। এতসব অশুভ জায়গার ঘটনাস্থল এই সাগরটিকে এক সময় শয়তানের সাগর বলে আখ্যায়িত করা হয়।
১২০০ শতকে চেঙ্গিস খানের দৌহিত্র, প্রাচীন চীনের অধিপতি কুবলাই খান জাপান আক্রমণের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকবার তার সুবিশাল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে সমুদ্রপথে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই সেই একই জায়গায় এসে জাহাজ নিখোঁজ হয়ে গেছে। শেষবার প্রেরিত যুদ্ধ জাহাজটিতে প্রায় ৪০,০০০ সৈন্য ছিল এবং ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল পার হওয়ার সময় একইভাবে জাহাজটি নিখোঁজ হয়ে যায়। পরে জাহাজ বা জাহাজের মানুষ সম্পর্কে কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এমনসব অদ্ভুত ঘটনা সম্পর্কে অবগত হওয়ার পর ১৯৫০ সালে জাপান সরকার রহস্যের কারণ উদঘাটনের উদ্দেশ্যে ৩১ জন ক্রু-বিশিষ্ট কাইও মারু নং ৫ নামক একটি বিশেষ জাহাজ পাঠান। দুর্ভাগ্যবশত এই অনুসন্ধানকারী জাহাজটিও নিখোঁজ হয়ে যায়। অতঃপর সে বছরই জাপান সরকার এই জায়গাটিকে সমুদ্রযাত্রার জন্য বিপদসংকুল হিসেবে ঘোষণা করে।
এর ঠিক দু’বছর পর ৬০ টন ওজনবিশিষ্ট তোশি মারু নামক একটি জাপানী জাহাজ একইভাবে গায়েব হয়ে যায়।
এই রহস্যের সমাধানের জন্য বিজ্ঞানীরা নিরন্তর গবেষণা করে চলেছেন। ১৯৯৫ সালে ল্যারি কুশ নামক একজন আমেরিকান লেখকের প্রকাশিত ‘দ্য বারমুডা ট্র্যায়াংঙ্গেল মিস্ট্রি সলভ্ড’ বইটিতে ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলে বিভিন্ন জাহাজ বা বিমান নিখোঁজের কারণ উল্লেখ করা হয়। বইটিতে বলা হয়েছে, এই এলাকায় সমুদ্রের তলদেশে প্রচুর পরিমাণে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি এবং ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা রয়েছে। আর এই কারণেই এখানে প্রায়শই নতুন নতুন দ্বীপ জেগে ওঠে এবং অনেক দ্বীপ বিলীন হয়ে যায়।
অনেক গবেষক বলে থাকেন, প্রায়শ হওয়া অগ্ন্যুৎপাত এবং ভূমিকম্পের কবলে পড়ে এ জায়গা দিয়ে অতিক্রমকারী জাহাজ বা নৌকাগুলো এবং যার কারণে জলযানগুলো সমুদ্রের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। ফলে পরবর্তীকালে তাদের আর কোনো হদিস পাওয়া যায় না।
পরিবেশবিদদের মতে, এমন অগ্ন্যুৎপাত বা ভূমিকম্পের কারণে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে। খুব আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এই জায়গাটি বিশ্বের কোনো মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। এ কারণে এই স্থানটির আয়তন বা অবস্থান সম্পর্কে খুব সুস্পষ্ট করে বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। মানচিত্রে এর উল্লেখ থাকলে হয়ত নাবিকদের আগে থেকেই এই অনাকাঙ্ক্ষিত জায়গা সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা প্রেরণ করা সম্ভব হতো।
১৯৭২ সালে লন্ডনের সাগা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘দ্য টুয়েলভ ডেভিল’স গ্রেভ ইয়ার্ডস এরাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ অনুচ্ছেদ থেকে জানা যায়, পৃথিবীতে সর্বমোট ১২টি স্থান রয়েছে যেখানে তীব্র চৌম্বকীয় আকর্ষণ অনুভূত হয়। আর ডেভিলস সী বা শয়তানের সাগরে অবস্থিত ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল এমনই এক জায়গা।
সায়েন্টিফিক আমেরিকানে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলের এই স্থানটিতে প্রায় ৩৭,০০০ মাইল এলাকা জুড়ে গভীর সামুদ্রিক খাদ রয়েছে এবং এখানে প্রচুর পরিমাণে উদগিরিত লাভা ও কার্বন ডাইঅক্সাইড রয়েছে।
১৯৭৩ সালে ল্যারি কুশ এবং আসাহি সিম্বুন (জাপানের একটি সর্বোচ্চ পঠিত সংবাদপত্র) এর সহ সম্পাদক শিগেরু কিমুরার যৌথ প্রয়াসে লেখা একটি বই থেকে মায়োজিনশো নামক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে জানা যায়। মারু নামক জাহাজটি যেখানে নিখোঁজ হয়েছিল এই আগ্নেয়গিরিটির অবস্থান ঠিক সেখানেই। এই আগ্নেয়গিরি থেকে থেমে থেমেই অগ্ন্যুৎপাত হয়ে থাকে। স্বভাবতই তা পানিতে প্রচন্ড আলোড়নের সৃষ্টি করে এবং শান্ত পানিকে মুহূর্তেই উত্তাল করে তোলে, যার ফলশ্রুতিতে পানির উপরে ভাসমান যানগুলোকে প্রবল আকর্ষণে পানির অভ্যন্তরে টেনে নিয়ে যায়।
অনেকগুলো সম্ভাব্য কারণের মধ্যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতকে মুখ্য কারণ বলে গণ্য করা হলেও সুনিশ্চিত করে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ অনেকটা এগিয়ে গেলেও অনেক সময় প্রকৃতির রহস্যের কাছে হার মেনে নিতে হয়। ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেলও এমন একটি প্রাকৃতিক রহস্য, যা এখনো জনমনে ধাঁধা সৃষ্টি করে রেখেছে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আমরা জানতে পারব এমন ঘটনার প্রকৃত কারণ।