পৃথিবীর ইতিহাসে এক নামে দুই দেশের উপস্থিতি নতুন কোনো ঘটনা নয়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, জার্মানি, রোডেশিয়া, আফ্রিকা, পাকিস্তান, সুদান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ইত্যাদি নামে একাধিক দেশের নাম রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি দেশ তার নিজের নামের আগে দিকের নাম উল্লেখ করে তাদের স্বতন্ত্রতার পরিচয় দিয়েছে। যেমন- উত্তর ও দক্ষিণ সুদান, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি। এক্ষেত্রে কারো সন্দেহ বা দ্বিধান্বিত হওয়ার সুযোগ তেমন নেই। কিন্তু ঝামেলা বাঁধালো আফ্রিকার দু’টি দেশ।
এই দুই দেশের নাম কঙ্গো এবং কঙ্গো। এদের নামের আগে কোনো দিক বা অবস্থানের নাম জুড়ে দেয়া নেই। আর ঝামেলার ইতিহাস নতুন নয়। কঙ্গো, DRC, কিনশাসা, ব্রাজাভিল, জায়ার, প্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো- এই শব্দগুলো বছরের পর বছর ধরে স্থানীয়, বহিরাগত নির্বিশেষে সকলের মাঝে এক মজার ধাঁধার ফাঁদ বুনে রেখেছে। এই দুই দেশের মাঝে যেমন মিল রয়েছে, অমিলও কিন্তু কম নয়। প্রজাতন্ত্রী কঙ্গোর এক স্থানীয় ছাত্রকে এই দ্বিধা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সে বেশ কৌতুকের স্বরে জবাব দিল-
“বিষয়টি এখন এমন দাঁড়িয়েছে, আমাদের এই নামের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার অভিনব পন্থা খুঁজে নিতে হবে। ওদের নাম যদি হয় গণপ্রজাতন্ত্রী, তাহলে আমরা নিশ্চয় ওদের বিপরীত ‘অগণপ্রজাতন্ত্রী’।”
পেছনের গল্প
আফ্রিকার অন্যতম প্রধান নদী কঙ্গোর তীর ঘেঁষে অবস্থিত বিশাল অঞ্চল জুড়ে অবস্থান এই দুই কঙ্গোর। প্রায় ১৫শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ বণিকদের আমগনের পর এই নদীর নামকরণ করা হয়েছিল। ‘কঙ্গো’ শব্দটি এই অঞ্চলে বাস করা বাকঙ্গো উপজাতিদের নাম থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। নদীর নামের সাথে মিল রেখে এর অববাহিকায় অবস্থিত অঞ্চলকেও সবাই কঙ্গো নামে চিনতো। এ অঞ্চলের বড় দু’টো শহরের নাম ছিল- কিনশাসা এবং ব্রাজাভিল। ১৯শ শতাব্দীতে ফরাসি (ব্রাজাভিল) এবং বেলজিয়ান (কিনশাসা) সাম্রাজ্যবাদের অধীনে চলে যায় এই দুই শহর।
১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বেলজিয়ান কঙ্গোর নামকরণ করা হয়েছিল ‘জায়ার’ হিসেবে। আর ফরাসিদের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করা কলোনির নাম কঙ্গো ছিল। জায়ার নামকরণের পেছনে প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন অঞ্চলটির একনায়ক মবোতো সেসে সেকো। নিজের আধিপত্যের প্রতীক হিসেবে দেশের নতুন নাম রেখেছিলেন তিনি। তখন হিসেব সহজ ছিল। একটি দেশের নাম কঙ্গো, যার রাজধানী ব্রাজাভিল। মবোতোর দেশ জায়ার, যার রাজধানী কিনশাসা।
কিন্তু কয়েক দশক পর নতুন করে জায়ারের বুকে অভ্যুত্থানের ডাক এল। এবার ক্ষমতায় আসলেন নতুন একনায়ক লরেন্ত কাবিলা। কাবিলা ক্ষমতা দখলের পর দেশের নাম বদলে পুনরায় ‘কঙ্গো’ রাখলেন। আর এখান থেকে শুরু হলো দ্বিধা। জটিলতা এড়াতে অনেকে কঙ্গো শব্দটির সাথে দেশের রাজধানীর নাম জুড়ে দেয়। যেমন- কঙ্গো-ব্রাজাভিল, কঙ্গো-কিনশাসা। কিন্তু দাপ্তরিক নথিতে দুই দেশের নাম যথাক্রমে ‘রিপাবলিক অভ কঙ্গো’ এবং ‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অভ কঙ্গো’।
ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অভ কঙ্গো
শুরুতে পূর্বের ‘জায়ার’ বা কাবিলার কঙ্গো থেকে ঘুরে আসা যাক। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অভ কঙ্গোকে অনেকে ‘কঙ্গো-কিনশাসা’ নামে চিনে। অর্থাৎ, এই দেশের রাজধানী শহর কিনশাসা। এর উত্তরে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং দক্ষিণ সুদান, পূর্বে উগান্ডা, রুয়ান্ডা এবং বুরুন্ডি, দক্ষিণে জাম্বিয়া এবং অ্যাঙ্গোলা এবং পশ্চিমে রিপাবলিক অভ কঙ্গোর সাথে সীমানা রয়েছে। প্রায় ২৩,৪৪,৮৫৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশটি আয়তনের দিক থেকে আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ।
বিশ্ব ব্যাঙ্কের বর্তমান সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় ৮ কোটি ১৩ লাখ লোকের বসবাস এই দেশে। দেশটির রাষ্ট্রভাষা ফরাসি হলেও স্থানীয়ভাবে লিঙ্গালা, কোঙ্গো, সোয়াহিলি, শিলুবা প্রভৃতি ভাষার প্রচলন রয়েছে। দেশটির সরকার ব্যবস্থা রাষ্ট্রপতি শাসিত। ডেমোক্রেটিক কঙ্গোর বর্তমান রাষ্ট্রনায়ক ফেলিক্স থিসেকেদি। দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় প্রায় ৭৭৪ মার্কিন ডলার। অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল দেশ কঙ্গো-কিনশাসাকে পৃথিবীর দরিদ্র দেশগুলোর তালিকায় ফেলা যায়।
রিপাবলিক অভ কঙ্গো
ডেমোক্রেটিক কঙ্গোর পশ্চিম সীমানায় অবস্থিত কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ব্রাজাভিল। তাই এর অপর নাম কঙ্গো-ব্রাজাভিল। ফরাসিদের উপনিবেশ থাকা অবস্থায় একে বণিকরা মধ্য-কঙ্গো হিসেবে চিনতো। মাত্র ৩,৪১,৯৯৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশটি এর প্রতিবেশী কঙ্গোর চেয়ে সাতগুণ ক্ষুদ্র। ২০১৯ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রায় ৫৩ লক্ষ ৮ হাজার মানুষের বাস এই দেশটিতে। এই দেশেরও রাষ্ট্রভাষা ফরাসি। কিন্তু, স্থানীয়দের মুখে কোঙ্গো/ কিতোবা এবং লিঙ্গালা ভাষাই বেশি প্রাধান্য পায়।
দুই দেশের জনগণের জাতীয়তা ‘কঙ্গোলিজ’। এদের সরকার ব্যবস্থা প্রজাতন্ত্র। প্রজাতন্ত্রের প্রধান বর্তমান রাষ্ট্রপতি ডেনিস সাসো এন-গুয়েসো। আয়তন এবং জনসংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে এরা কঙ্গো-কিনশাসা থেকে কিছুটা এগিয়ে। এদের মাথাপিছু আয় প্রায় ১,৩৬৯ মার্কিন ডলার।
রাজনৈতিক অস্থিরতার দুই কঙ্গো
কিনশাসা এবং ব্রাজাভিলের মাঝে বিমানপথের দূরত্ব সময়ের হিসেবে মাত্র পাঁচ মিনিট। প্রায় এক কিলোমিটার প্রশস্ত কঙ্গো নদী দ্বারা দুই রাজধানী শহর একে-অপরের থেকে আলাদা হয়ে আছে। কিন্তু নদীর দুই পাড়ের গল্প মোটামুটি একই। সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত মিল ছাড়াও দুই দেশের জনগণের মাঝে আন্তরিক সখ্যতা বিদ্যমান। তাই দুই দেশকে বিভক্তকারী নদীটি স্থানীয়দের নিকট কোনো প্রাচীর বা সীমানার কাঁটাতার নয়। বরং, তারা এই নদীকে দুই দেশের মাঝে যোগসূত্রকারী হিসেবে দেখে।
তবে, আঞ্চলিক সখ্যতার বাইরে রাজনৈতিক আঙিনায় দুই দেশই বেশ অস্থির সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৬৫ সালে মবোতো কর্তৃক কিনশাসার ক্ষমতা দখলের পর পরই ব্রাজাভিলের বুকে সামরিক অভ্যুত্থানের ডাক দেন ম্যারিয়েন এন-গোয়াবি। একদিকে পশ্চিমা মদদপ্রাপ্ত মবোতো এবং অপরদিকে মাক্স-লেনিন বাদী এন-গোয়াবি এক পরোক্ষ স্নায়ুযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দুই দেশকে অনিশ্চয়তার মাঝে ফেলে দেন।
এরপর থেকে দুই কঙ্গোতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে গৃহযুদ্ধ এবং অরাজকতা বেঁধে যায়। গৃহযুদ্ধের কারণে গত শতাব্দীতে কঙ্গো-কিনশাসায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। অপরদিকে, ১৯৭৯ সালে ব্রাজাভিলের সরকার পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন ডেনিস সাসো এন-গুয়েসো। প্রায় ১৮ বছর ক্ষমতায় থাকার পর ১৯৯৭ সালে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যায়। এরপর ৫ বছর দীর্ঘ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চলার পর পুনরায় মার্ক্সবাদী সরকার কায়েম করতে সক্ষম হন এন-গুয়েসো। তিনি এখন পর্যন্ত দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।
পর্যটনের স্বর্গ দুই কঙ্গো
স্নায়ুযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার বাইরে দুই কঙ্গো বহির্বিশ্বে বিখ্যাত এদের পর্যটন শিল্পের জন্য। আফ্রিকার বন্যতা এবং অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকৃতি একে পর্যটকদের নিকট আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এর পর্যটন চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে দু’টি দেশের কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি উদ্যান এবং অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন। কিনশাসার গারাম্বা জাতীয় উদ্যানটি জীববৈচিত্রের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদ্যান হিসেবে পরিচিত। একে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের ব্যাংক হিসেবে ডাকা হয়।
এছাড়া কাহুজি-বিগা, কুন্ডেলুঙ্গু এবং ভিরুঙ্গা উদ্যানগুলো বছর জুড়ে বিভিন্ন মহাদেশ থেকে আগত পর্যটকের পদচারণায় মুখরিত থাকে। কাহুজি-বিগা উদ্যানটি আফ্রিকার অন্যতম গরিলা অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে গরিলা সরবরাহের দিক থেকে এরা প্রথম স্থানে আছে। স্থানীয়রা সময় পেলে পরিবার নিয়ে এসব উদ্যানে ছুটে যায় রোমাঞ্চের নেশায়।
অপরদিকে ব্রাজাভিলের পর্যটনও কম নয়। রিজার্ভ ডু লেসিও লুনা, কোট সভাজ, ন্যুবাল-এনডোকি জাতীয় উদ্যানগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন অঞ্চলে। পর্যটকদের আকর্ষণের শীর্ষে আছে ওদাকা-কোকোয়া উদ্যান এবং লুফাউলাকারি জলপ্রপাত। কঙ্গো-ব্রাজাভিলের রেইন ফরেস্ট আমাজনের পর পৃথিবীর বৃহত্তম রেইন ফরেস্ট হিসেবে পরিচিত। হাইকিং, নৌবিহার এবং সাগরের পানিতে হারিয়ে যাওয়ার নেশায় এখানেও পর্যটকদের আনাগোনা দেখার মতো।
কঙ্গো নদীর দুই কূলে অবস্থিত দু’টি রাজধানী শহর নিয়ে গড়ে উঠেছে ভিন্ন দুই দেশ কঙ্গো। কাগজে-কলমে ভিন্নতা থাকলেও ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিক থেকে এরা এক জাতিসত্ত্বা। ১৯৬০ এ স্বাধীনতার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা একবিংশ শতাব্দীতে দুই কঙ্গোকে ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে এসেছে। একদিকে তুলনামূলকভাবে কিছুটা স্থিতিশীল রিপাবলিক অভ কঙ্গো নিজের সীমিত সম্পদ এবং পর্যটনকে কেন্দ্র করে ‘লিটল প্যারিস অভ আফ্রিকা’-য় পরিণত হয়েছে।
অপরদিকে দীর্ঘ অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থায় জর্জরিত ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অভ কঙ্গো দারিদ্র্যের সাথে সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তবে আশা করা যায়, সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সকল বাধা-বিপত্তি মোকাবেলা করে দুই কঙ্গো নিজেদেরকে বিশ্বমঞ্চে উন্নত দেশের কাতারে নিতে সক্ষম হবে।