বেশ কিছুদিন ধরেই অনলাইন দুনিয়ায় আমাজন বনে আগুন লাগার ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়ে। সপ্তাহব্যাপী চলা দাবানলের আক্রোশে সেখানকার জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। ১.৪ বিলিয়ন একর এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই বন দক্ষিণ আমেরিকার বৃহৎ একটি অংশে নিজেকে অনেকটাই আড়াল করে রেখেছে সভ্য জগত থেকে। এত বড় বনকে ঘিরে একটি বৃহৎ বাস্তুসংস্থান গড়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। সেখানে থাকবে নানা জাত আর বর্ণের পশুপাখি, যারা বছরের পর বছর ধরে সেখানে জীবন ধারণ করে আসছে।
এদের ভেতর আছে সাইফাই মুভি থেকে উঠে আসা কোনো গিরগিটি কিংবা দু’চোখ জুড়ানো রূপকথার বর্ণিল পাখির দেখাও মেলে এই রহস্যময় বনে। একেবারে শান্তশিষ্ট প্রাণী যেমন আছে, তেমনই মুহূর্তে জীবন সংশয়ে ফেলে দেওয়া ভয়ঙ্কর প্রাণীরও বাস এই আমাজনে। যাদের নিত্যদিনের পদচারণা আমাজনকে জীবন্ত করে রেখেছে বছরের পর বছর। আমাজনে এখন পর্যন্ত ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪০০ প্রজাতির উভচর এবং প্রায় ১৩০০ প্রজাতির পাখি। মজার ব্যাপার হলো, প্রায় প্রতিদিনই এখানে নতুন নতুন প্রজাতির প্রাণীর দেখা মেলে। টিকে থাকার লড়াই কিংবা খাবারের জন্য যুদ্ধ- সবই এখানকার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বহুকাল ধরে আমাজনকে আপন করে নেওয়া এমন কিছু প্রাণীর কথা নিয়েই আজকের লেখাটি।
১. জাগুয়ার
জাগুয়ার শব্দটি এসেছে স্থানীয় আমেরিকান শব্দ ‘yaguar’ থেকে, যার অর্থ ‘যে একলাফে হত্যা করে’। এর নামের সঙ্গে কাজের প্রচুর মিল, শিকারকে সে চোখের পলকেই কাবু করে ফেলে। যদিও দৌড়ানোর চেয়ে আমাজনের জাগুয়ার ফাঁদ পেতে শিকার ধরতেই বেশি ওস্তাদ। বিশেষ করে গাছ থেকে টার্গেট ঠিক করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়াতেই জাগুয়ার বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ‘কিলারদের কিলার’ এই প্রাণীর একটি কামড়ই হয়তো শিকারকে নিস্তেজ করে দিতে পারে। জলে-স্থলে সবখানেই এদের সমান দক্ষতা। যার কারণে আমাজনের সাক্ষাত ত্রাস প্রাণীটি।
জন্মের পর বাচ্চা জাগুয়ার মায়ের সঙ্গেই ঘোরাফেরা করে। বড় হতে হতে সে শিকার করা শেখে এবং একাই চলাফেরা করে। একটি পূর্ণবয়স্ক জাগুয়ারের ওজন ১০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এদের শরীরের ছোপ-ছোপ দাগের কারণে সহজেই চেনা যায়, সেইসঙ্গে এই দাগ ক্যামোফ্লাজ হিসেবেও কাজ করে শিকার ধরার সময়।
অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় জাগুয়ারের চোখ আকারে বড়, সেগুলো মাথার আকারের অনুপাতেও অনেকটা বড় দেখতে। বাচ্চা জাগুয়ারের চোখের আইরিস নীল রঙের হয় এবং প্রাপ্তবয়স জাগুয়ারের আইরিস সোনালী থেকে লালচে বাদামী রঙও ধারণ করে সময়ে-সময়ে। নিশাচর প্রাণী হিসেবে পরিচিত হলেও সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা যায়, এরা দিনের বেলাতেও শিকার করে বেড়ায়!
প্রাচীন মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় বাসিন্দাদের ভেতর সাহসী মানুষদের জাগুয়ারের সঙ্গে তুলনা করা হতো। এগুলোর প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের ধর্ম, শিল্প আর মিথলজিতে। তাদের উপাসনালয়গুলোর প্রবেশমুখে জাগুয়ারের মাথার অবয়ব তৈরি করা হতো, যাতে তারা উপাসনালয়কে নিরাপত্তা দিতে পারে। এছাড়াও মায়া সভ্যতায় জাগুয়ারের বিশেষ স্থান রয়েছে।
২. গ্লাস ফ্রগ
আমাজনের আরেকটি মনোমুগ্ধকর প্রাণী হলো গ্লাস ফ্রগ। মূলত এদের শরীরের স্বচ্ছ বর্ণের কারণে এমন নামকরণ করা হয়েছে। স্বচ্ছ হওয়ার কারণে এর ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রায় পুরোটাই দেখা যায়। কাঁচের মতো স্বচ্ছ হলেও শরীরের নিম্নাংশ একটু সবুজ বর্ণের। যার কারণে এগুলো সহজেই গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। জীবনের বেশিরভাগ সময় গ্লাস ফ্রগ গাছের উপরই কাটিয়ে দেয়। প্রজনন মৌসুমে কেবল মাটিতে নেমে আসে তারা, তারপরও খুব মনোযোগ দিয়ে না দেখলে এদের চোখে পড়ার সম্ভাবনা কম।
বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত গ্লাস ফ্রগের প্রায় ৪০ টি প্রজাতির দেখা পেয়েছেন, যদিও এটি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। আকারে এরা ৩ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে, তবে উত্তরের দিকে মানুষের হাতের তালুর সমান গ্লাস ফ্রগের দেখা পাওয়া যায়। এরকম বড় আকারের গ্লাস ফ্রগ বেশি দেখা যায় মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়।
নিশাচর প্রাণীটি রাতের বেলাতেই মূলত খাবারের সন্ধানে বের হয় এবং গাছের ছোট ছোট পোকামাকড় খেয়েই বেঁচে থাকে এরা। প্রজনন মৌসুমে গাছের ডালে কিংবা পরিষ্কার পানিতে ডিম ছাড়ে গ্লাস ফ্রগ। ডিম ফুটে বড় হওয়ার পর সেগুলো আবার ডাঙায় উঠে আসে।
৩. গোলাপি ডলফিন
আমাজন বনের বুক চিরে যে নদী বয়ে গেছে সেখানে বাস করা অনেকগুলো প্রাণীর ভেতর গোলাপি ডলফিন অন্যতম। মূলত এর গায়ের গোলাপি বর্ণের কারণেই এমনটা হয়েছে। তবে জন্মের পর ডলফিনগুলোর গায়ের রঙ থাকে ধূসর বর্ণের। বড় হতে হতে গোলাপি বর্ণ চলে আসে চামড়ায়। স্থানীয়রা একে বোটো, বুফেও ইত্যাদি নামে ডেকে থাকে। বিশাল আঁকাবাঁকা নদীতে পথ চলতে গেলে এই চমৎকার প্রাণীগুলোকে সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায়। নিরীহ প্রজাতির হওয়ায় স্থানীয়রাও এগুলোকে সার্বক্ষণিক সাথে রাখে, ভ্রমণ করতে আসা নৌকাগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় এপার থেকে ওপার। এমন মিশুক একটি প্রাণীর সঙ্গ কে-ই বা ছাড়তে চায়!
তবে বর্তমানে এদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। মিঠাপানির এই প্রাণীটি সেখানে পরিবেশ দূষণের শিকার। তাছাড়া বাঁধ নির্মাণের কারণেও এরা স্থান পরিবর্তন করে ফেলছে। পরিবেশবিদরা বলেন, অচিরেই গোলাপি ডলফিনের বড় একটি অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে নদী দূষণের ফলে।
৪. ম্যাকাও
আমাজনের আকাশকে বর্ণিল করে তোলা এই পাখিটি সবচেয়ে সামাজিক প্রাণীগুলোর একটি। আমাজনে মোটামুটি ১৪ রকমের ম্যাকাওয়ের দেখা মেলে। তোতাপাখিদের ভেতর এদের আকারই সবচেয়ে বড়। শরীরজুড়ে নানা রঙের পালকের উপস্থিতি একে দিয়েছে আলাদা এক সৌন্দর্য। লাল, নীল, সোনালী এবং সবুজের অদ্ভুত এক মিশ্রণের একট প্যাটার্ন রয়েছে শরীরজুড়ে। মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতো এদের রঙের প্যাটার্নেও রয়েছে বৈচিত্র্য। তাছাড়া ঠোঁটের গঠনগত বৈশিষ্ট্যেও ভিন্নতা দেখা যায়।
আমাজনের আকাশ মাতিয়ে রাখা ম্যাকাও মাত্রই শোরগোল করতে পছন্দ করে। এরা আকাশে ওড়ে দলে দলে, এক ঝাঁকে ২০-৩০টি পাখি থাকে। ম্যাকাও নিজের সঙ্গীর সাথেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দেয়। এদের জীবনকালও চমৎকার, প্রায় ৬০ বছর বাঁচে এরা। সামাজিক এই প্রাণীটি অর্থবহুল শব্দ করতে পটু; নিজেদের এলাকা নির্ধারণ, খাবারের খোঁজ, সঙ্গীকে ডাকার জন্য ম্যাকাও বিভিন্ন শব্দ করে থাকে। একসঙ্গে ঘোরাঘুরি এবং খাবার শেয়ার করলেও নিজেদের সঙ্গীর ব্যাপারে ম্যাকাও খুবই সাবধানী! গাছে থাকা পোকামাকড়, গাছের পাতা ইত্যাদি খেয়েই এরা বেঁচে থাকে।
সৌন্দর্য আর মানুষের কথা নকল করার ক্ষমতার কারণে পশ্চিমা বিশ্বে এদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। তাই পাখি শিকারিদের আনাগোনা হরহামেশাই দেখা যায় এই বনে। পাখি বিক্রির কারণে এখানে পাখির সংখ্যা কমে যাওয়ার আশংকা করেন পরিবেশবিদরা।
৫. পিরানহা
আমাজনের নদীর পানিতে লাল রঙের পিরানহার আধিক্য দেখা যায়। মূলত মিঠাপানির মাছটির পেটের নিম্নাংশে লাল রঙের উপস্থিতির কারণে একে লাল পিরানহা বলা হয়। যদিও আরও বেশ কয়েকটি রঙের পিরানহা রয়েছে আমাজনের নদীতে। মিলিয়ন বছর আগে থেকেই এরা মিঠাপানির প্রাণি ছিল। বর্তমানে আমাজনের জলে, আর্জেন্টিনা, ভেনিজুয়েলা, উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা, হাওয়াই এবং বাংলাদেশেও এদের দেখা পাওয়া যায়। ৩০টিরও অধিক প্রজাতির মাছটি সত্যিকার অর্থেই মাংসাশী। সাধারণত এরা আকারে ৫-১০ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে, তবে মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। এরা মাংসপাগল হলেও এদের খাদ্য তালিকায় তৃণও দেখা যায়। পোকামাকড়, মরা পাখি, নদীর অন্যান্য মাছকে দলবদ্ধভাবে আক্রমণ করেও পিরানহা খাদ্য জোগাড় করে।
পিরানহার ধারালো দাঁত আর ক্রুদ্ধ দৃষ্টির জন্যই একে সবাই ভয় করে মূলত। নিমিষেই শিকারকে খুবলে খেয়ে ফেলতে এর জুড়ি নেই। তবে খিদে না থাকলে পিরানহা কখনোই আক্রমণে আগ্রহ দেখায় না। চীনসহ বেশ কিছু দেশে পিরানহা সৌন্দর্যের একটি বস্তু। তাদের একুরিয়ামগুলোতে প্রায়ই পিরানহা শোভা পায়।
৬. ব্ল্যাক কাইমেন
আমাজনের জলে ওঁৎ পেতে থাকা সবচেয়ে ভয়ানক প্রাণীটির নাম ব্ল্যাক কাইমেন। এটি দেখতে আমেরিকান অন্যান্য কুমিরের মতো হলেও এর গায়ের রঙে কিছুটা ভিন্নতা আছে। আকারে এগুলো একেকটি ২০ ফুট লম্বা হয়। ধারালো দাঁতগুলো সবসময়ই খাবারকে টুকরো করার জন্য তৈরি থাকে। পুরো পৃথিবী তো বটেই, দক্ষিণ আমেরিকাতেও কাইমেন প্রজাতির এই কুমির আকারে সবচেয়ে বড়। ছোটবেলায় এরা সাধারণত মাছ শিকার করেই বেঁচে থাকে। পরিণত একটি কাইমেন সামনে যা পায় তা-ই খায়। বিশেষ করে পিরানহা, ক্যাটফিস এদের নিত্যদিনের খাবার। এছাড়াও বন্যা হলে এরা স্থলভাগে উঠে আসে এবং স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার করে খায়। ব্ল্যাক কাইমেন ৫০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
৭. মাকড়সা বানর
বানরের এই প্রজাতিটির এমন অদ্ভুত নামকরণের কারণ এর লম্বা লেজ! এই লেজের সাহায্যে এরা এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে। অভিযোজনের ফলে এই প্রজাতির বানরের লেজটি আলাদা অঙ্গের মতো কাজ করে। সহজেই পুরো শরীরের ভার নিতে পারে শক্তিশালী এই অংশটি। সাধারণত আমাজনের ফলমূল খেয়েই এরা বেঁচে থাকে। সামাজিক প্রাণী হিসেবে এদের বেশ সুনাম রয়েছে। এদের দৈনন্দিন কাজকর্মেও সামাজিকতার ছাপ পাওয়া যায়। বিশ্বে যে কয়টি প্রজাতির বানরের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে তাদের ভেতর মাকড়সা বানর অন্যতম। আর তাদের বিলুপ্তির বড় একটি কারণ হলো মানুষ।
৮. সবুজ এনাকোন্ডা
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর শক্তিশালী যে সাপটি তার নাম এনাকোন্ডা। আর আমাজনের জলে রাজত্ব করা এই সাপটি যে কারও জন্যই হতে পারে ভয়ানক এক আতঙ্কের নাম। আকারে এটি ১৮ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে আর ওজন হয় প্রায় ১৭০ পাউন্ড।
পূর্ণবয়স্ক একটি এনাকোন্ডা প্রতিদিন গড়ে ৪০ পাউন্ড খাবার খেয়ে থাকে। তার প্রাথমিক খাদ্য তালিকায় থাকে পানির উপরের অংশে ভাসমান খাদ্যগুলো। এছাড়াও কোনো প্রাণী যখন পানি খেতে আসে তখন সুযোগ পেলে এনাকোন্ডা প্রাণীটিকে আক্রমণ করে। যত বড় প্রাণীই হোক না কেন, এনাকোন্ডা নিজের শক্তিশালী পেশি দিয়ে সহজেই শিকারকে চেপে ধরে। শিকারের মৃত্যু নিশ্চিত হলে সেটাকে সে নিজের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এনাকোন্ডার খাদ্য তালিকায় জাগুয়ার, কুমির হতে শুরু করে বনের কোনো প্রাণীই বাদ পড়ে না! একটা এনাকোন্ডা মোটামুটি ১০ পর্যন্ত বেঁচে থাকে এবং জীবনের পুরোটা সময় জুড়েই সে আকারে বাড়তে থাকে।
সুবিশাল আমাজন বনে কত রকমের প্রাণী রয়েছে তার হিসাব নেই। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নতুন প্রজাতির প্রাণীর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে রহস্যময় এই বনে, আর এর পানিতে। ভবিষ্যতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এমন একটি জীববৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হলে মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষের বনায়ন ধ্বংসের বলি হয়ে এসব প্রাণী যাতে বিলুপ্ত না হয়ে পড়ে, সেটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদেরকেই। কারণ এগুলো নির্দিষ্ট কারও সম্পদ নয়; এগুলো আমাদের সম্পদ, পৃথিবীর সম্পদ।