ভারত মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র মরিশাসের নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের কথা পৃথিবী বিখ্যাত। আফ্রিকার পূর্ব উপকূল জুড়ে এর অবস্থান। রাজধানী পোর্ট লুইস। ভারত মহাসাগরেরই আরেক সুপরিচিত দ্বীপ রাষ্ট্র মাদাগাস্কারের ৮০০ কিলোমিটার পূর্বে মরিশাসের অবস্থান। আগ্নেয়গিরিময় এই রাষ্ট্রের চারপাশ জুড়ে রয়েছে প্রবাল প্রাচীর যা একে জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে।
সম্প্রতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার এই দ্বীপের জলসীমায় তেলবাহী একটি জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। ঠিক মাঝ বরাবর দু’ টুকরো হয়ে ভেঙে যাওয়া এই জাহাজ থেকে হাজার হাজার টন জ্বালানী তেল মিশে যাচ্ছে সাগরে। চলতি মাসের ১৭ তারিখ ব্লুমবার্গ কুইক টেকের একটি টুইটে এ সম্পর্কিত একটি ভিডিও প্রকাশিত হয়। ‘এম ভি ওয়াকাশিও’ নামের এই জাহাজটির মালিক জাপানের নাগাসাকি শিপিং।
প্রায় ৪ হাজার টন জ্বালানী তেল নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে ব্রাজিলগামী জাহাজটি গেল মাসের ২৫ তারিখ মরিশাসের প্রবাল প্রাচীরে আটকে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতি তৎক্ষণাৎ কেন মরিশাস কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে সকলকে জানায়নি সে বিষয়ে আবহাওয়াবিদরা ক্ষুব্ধ। ইতোমধ্যেই প্রায় এক হাজার টন তেল সমুদ্রের পানিতে মিশে গিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে ভারত মহাসাগরীয় ওই অঞ্চলের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার পরিবেশ সম্পর্কিত জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে। ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা করতে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানায় মরিশাস। কানাডা ও ফ্রান্স এতে বন্ধুত্বের পরিচয় দিয়ে সাড়া দেয়। ফ্রান্সের বক্তব্য অনুযায়ী নিকটবর্তী রি-ইউনিয়ন দ্বীপ থেকে দূষণ যন্ত্রপাতি নিয়ে একটি নৌযান এবং একটি সামরিক বিমান ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। উল্লেখ্য যে এককালে মরিশাস ফ্রান্সেরই উপনিবেশ ছিল।
সামুদ্রিক পরিবেশকে বিপন্ন করার জন্য মরিশাসের জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন জাহাজটির মালিক আকিহিকো হিনো। যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন তিনি। জাপানের পররাষ্ট্র দপ্তরের নির্দেশে একটি সাহায্যকারী দল সংকট নিরসনে মরিশাসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।
তেল নিঃসরণের পরিমাণ বিবেচনায় এখন অবধি ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলোর তুলনায় মরিশাসের দুর্ঘটনাটি খুব বড় না হলেও এর পরিবেশগত প্রভাব অত্যন্ত ভয়াবহ (৩০০,০০০ টন ক্রুড ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনারও সাক্ষী ইতিহাস)। মরিশাসের মতো এতটা সমৃদ্ধ অথচ নাজুক বাস্তুতন্ত্রের যে অপরিসীম ক্ষতিসাধন হয়েছে তেল নিঃসরণের কারণে তা পুনরুদ্ধারে নিদেনপক্ষে এক দশক সময় প্রয়োজন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই স্থানীয় জেলেরা ভীত হয়ে পড়েছেন তাদের জীবন জীবিকার মূল উৎসের বেহাল দশা পর্যবেক্ষণ করে। উপকূল জুড়ে ভাসছে মৃত মাছ আর অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণী। স্থানীয় অধিবাসীরা খড় ও ঘাসের সমন্বয়ে বিশালাকার শোষক ব্যবস্থা নির্মাণ করেছেন তেলের ছড়িয়ে পড়া রোধ করার জন্য।
ভুরদাপানাইকেন, একজন স্থানীয় জেলে। উপকূলীয় অন্যান্য জেলেদের মতো তার ভবিষ্যতও এখন ঘোর অন্ধকার। জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পন্থা মাছ ধরা এখন প্রায় বন্ধ হওয়ার দশা। বাবা, ভাই এবং আত্মীয় স্বজনদের সাথে প্রায় ৫৫ বছর যাবত এই পেশায় তিনি নিয়োজিত। গড়ে প্রতিদিন মাছ ধরে তার আয় হয় ৫০০ রুপি। ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলে আয়ের পরিমাণ ২০০০ রুপি পর্যন্তও হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক এই দুর্ঘটনায় সমুদ্রের পরিবেশ ভয়াবহভাবে বিপর্যস্ত হওয়ায় তার রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ভুরদাপানাইকেনের মতো এমন আরও অসংখ্য জেলে পরিবার এখন হতাশায় দিন গুজরান করছেন।
লম্বায় ৩০০ মিটার এই জাহাজটি একটি চার্টার্ড (ভাড়া করা) ট্যাংকার ছিল। মিটসুই ওএসকে লাইনসের ভাড়া করা ট্যাংকারটি তিন ধরনের তরল পরিবহন করে নিয়ে যাচ্ছিল- ৩৮৯৪ টন কম সালফার বিশিষ্ট জ্বালানী তেল, ২০৭ টন ডিজেল এবং ৯০ টন লুব্রিক্যান্ট। জাহাজটি মরিশাসের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলীয় একটি প্রবাল প্রাচীরে আঘাত হানে জুলাইয়ের ২৫ তারিখ। এর প্রায় দু’ সপ্তাহ পর এটি থেকে সমুদ্রের পানিতে তেল মিশে যাওয়া শুরু হয়। আটকে পড়া ট্যাংকারের খবর শুনে তৎক্ষণাৎ ভুরদাপানাইকেন তার বাইকে করে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েন। ঘটনার ভয়াবহতা তাকে দারুণভাবে গ্রাস করে।
পৃথিবী এর আগেও বহুবার সমুদ্রে জ্বালানী তেল ছড়িয়ে পড়া প্রত্যক্ষ করেছে। তবে মরিশাসের এই দুর্ঘটনা একেবারেই আলাদা। পৃথিবীর অসংখ্য চলচ্চিত্রের দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়া স্বচ্ছ নীল এই জলসীমা তেলের কারণে ঘন কালচে বাদামী রঙ ধারণ করেছে বিভিন্ন জায়গায়। সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের মাঝে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলটি অজস্র জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য। মরিশাস পৃথিবীর অন্যতম জীববৈচিত্র্য হটস্পট। এই অঞ্চলে বসবাসরত বেশ কিছু প্রজাতি কেবল এই সামুদ্রিক পরিবেশের জন্যই নির্ধারিত এবং মৌলিক। পৃথিবীর অন্য কোথাও এদের প্রাকৃতিক কোনো অস্তিত্ব নেই, ঠিক যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনের ক্ষেত্রে।
সাবেক গ্রীনপিস স্ট্র্যাটেজিস্ট সুনীল মোক্ষানন্দের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকায় সাগরের স্রোত এবং বয়ে চলা বাতাস পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। স্রোত ও বায়ুপ্রবাহের কারণে জলের উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়া তেল ভাসতে ভাসতে বাস্তুতন্ত্রের সবচেয়ে ঘন, তাৎপর্যপূর্ণ, নাজুক অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ ট্যাংকারের মোট জ্বালানীর প্রায় এক তৃতীয়াংশ স্থানান্তর করা গেলেও যে পরিমাণ সমুদ্রের জলে মিশে গিয়েছিল সেটিই এখন দুশ্চিন্তার মূল কারণ।
এ অঞ্চলের সামুদ্রিক পরিবেশে প্রায় ১৭০০ প্রজাতির বসবাস। জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য বিষয়ক কনভেনশন অনুযায়ী এদের মাঝে প্রায় ৮০০ প্রজাতির মাছ, ১৭ প্রকারের সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী এবং কচ্ছপের ২ টি প্রজাতি বিদ্যমান। সুবিশাল প্রবাল প্রাচীর, সামুদ্রিক ঘাস এবং জোয়ারধৌত গরান বনভূমি (mangrove forest) এই তিনটি পৃথক বৈশিষ্ট্যের সম্মিলনে মরিশাসের সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান এতটা বৈচিত্রপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ। ইউনিভার্সিটি অফ ব্রাইটনে সামুদ্রিক জীববিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত ডক্টর কোরিনা সিওক্যানের মতে,
পৃথিবীতে মরিশাসের মতো এতটা সমৃদ্ধ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান খুব কমই আছে। তেল নিঃসরণের দুর্ঘটনাটি পুরো সামুদ্রিক পরিবেশকেই প্রভাবিত করবে। খালি চোখে সমুদ্রের জলের উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়া জ্বালানিটুকুই আসলে সমস্যার শেষ না বরং ঘটনার ভয়াবহতা এখান থেকেই শুরু। বিস্তীর্ণ জলরাশির উপরের স্তরে শুধু সেটুকুই দেখা যায় যা পানিতে অদ্রবণীয়। জ্বালানী তেলের মাঝে বিদ্যমান বেশ কিছু উপাদান পানিতে দ্রবণীয়। এরপর আরেক প্রকারের উপাদানসমূহ একীভূত হয়ে পানির অভ্যন্তরে একটি ফোমের মতো তৈরি করবে। সবশেষে সবচেয়ে ভারী উপাদানগুলো একেবারে সমুদ্রের তলদেশে গিয়ে জমা হবে। অর্থাৎ সামুদ্রিক পরিবেশের প্রায় পুরোটাই নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
১৯৯৭ থেকে ২০০৭ সাল, এই এক দশকে মরিশাসের জীবিত প্রবালের সংখ্যা কমে গেছে প্রায় ৭০%। পুরো বিশ্বজুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ খাদ্য অথবা আয়ের উৎস হিসেবে প্রবালের উপর নির্ভরশীল। মরিশাসের মতো বিশ্বখ্যাত উপকূলীয় পর্যটন কেন্দ্রের একটি স্তম্ভ হিসেবে অবদান রেখে এসেছে এই প্রবালের বসবাস। প্রবালকে ঘিরে যাদের জীবন আবর্তিত হচ্ছে তারা একইসাথে পর্যটকদের গাইড হিসেবেও ভূমিকা রাখছে। মরিশাসের জাতীয় প্রবৃদ্ধির ২০% আসে পর্যটন খাত থেকে। শুধু তাই নয়, মোট জনসংখ্যার ২০% সরাসরি কর্মসংস্থানের জন্য এই বিপুল সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের উপর নির্ভরশীল।
সামুদ্রিক পরিবেশ, অধিবাসীদের জীবনযাত্রা এসবের পাশাপাশি মরিশাসের সর্বশেষ এই দুর্ঘটনা জ্বালানী তেল শিল্পকেও হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ট্যাংকার দিয়ে পরিবহনকৃত তেলে সালফারের পরিমাণ নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক চলছে। ইতোমধ্যে ট্যাংকারের ক্যাপ্টেন ভারতীয় নাগরিক সুনীল কুমার নন্দেশ্বর এবং তার সহকারী এক শ্রীলঙ্কান নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন লঙ্ঘন এবং অবৈধ পথ অনুসরণের অভিযোগ আনা হয়েছে।