বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষতার এই যুগে যোগাযোগের নানা মাধ্যম আবিষ্কৃত হয়েছে। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন পৃথিবীর দূরের প্রান্তকে কাছে নিয়ে এসে যোগাযোগকে অনেক সহজ করছে ঠিকই, কিন্তু আমরা যদি সশরীরে কোনো স্থানে যেতে চাই তাহলে নিশ্চতভাবেই আকাশপথ, জলপথ, রেলপথ, সড়কপথের উপরই ভরসা করতে হবে। এই সবগুলো পথই যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে মানুষের কাছে সবচেয়ে সহজ এবং বহুল ব্যবহৃত পথ হচ্ছে সড়কপথ। এই সড়কপথেরই আবার কত রকমফের- রাজপথ, ফুটপাথ, গলিপথ! পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে পথগুলো হয় ভীষণ পরিকল্পিত। হরেক রকম গাড়ীতে ঠাসা কয়েক লেনের সোজা, প্রশস্ত রাস্তা, রাস্তার পাশের বিচিত্র ল্যাম্প পোস্ট, ট্রাফিক লাইট এই রাস্তাগুলোর চিরাচরিত চেহারা। কিন্তু বড় বড় শহরেই আবার এমন সব রাস্তাঘাট আছে যেগুলোর চেহারা একেবারেই অন্যরকম। বিচিত্র আর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের এই রাস্তাগুলো দেখলে সত্যি অবাক হতে হয়। চলুন আজ পরিচিত হওয়া যাক এমনই কিছু অদ্ভুত রাস্তাঘাটের সাথে।
আমব্রেলা স্ট্রীট (এগুইডা, পর্তুগাল)
পর্তুগালের এগুইডা শহরের একটি সরু গলি। বছরের একটি বিশেষ সময়ে গলির আকাশে রঙ-বেরঙের ছাতার প্রদর্শনী লক্ষ্য করা যায়। উপরে রামধনু রঙের ছাতা, নিচে রাস্তা, রাস্তার পাশে নানা শিল্পের আসর – এ সত্যিই দারুণ এক ব্যাপার। রাস্তার উপরে ছাতা টাঙ্গানো থাকার কারণেই এই পথের নাম হয়েছে ‘আমব্রেলা স্ট্রীট’।
বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এই শহরে একটি আর্ট ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়। তারই অংশ হিসেবে এই ছাতাগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়। দেখে মনে হয়, এই বুঝি উড়ে চলে গেল ছাতা। কিন্তু যায় না। কারণ ছাতাগুলো তার দিয়ে বাঁধা থাকে। ছাতাগুলো রাস্তায় চলতে থাকা পথিকদের কাঠফাটা রোদ্দুরে শীতল ছায়াই দেয় না শুধু, এর বর্ণিল রঙের সৌন্দর্য দিয়ে মনও রাঙিয়ে দেয়। খুব বেশিদিন হয়নি এই উৎসব চালু হয়েছে, এরই মধ্যে ইন্টারনেটের কল্যাণে সারা পৃথিবীতে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। অদ্ভুত সুন্দর এই রাস্তা দেখতে তাই পর্তুগালে পর্যটকের ভিড় বাড়ছে।
ব্লু স্ট্রীট, মরক্কো
আফ্রিকা মহাদেশের আটলান্টিক পাড়ের দেশ মরক্কোর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে রয়েছে জাদুকরী এক শহর। শহরটির নাম শেফশাওয়ান। একে Blue Pearl of Morocco-ও বলা হয়, সংক্ষেপে Blue City। কারণ এই শহরের বাড়িঘরের দেয়াল, দরজা, এমনকি রাস্তাঘাটও নীল রঙে রাঙানো। স্থাপত্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বিচিত্র এই শহরের রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। সেই ইতিহাস থেকে এই শহরের নীল নামকরণের ব্যাখাও পাওয়া যায়। মুসলমানরা স্পেন অধিকার করলে স্পেন থেকে অনেক ইহুদীরা মধ্যপ্রাচ্যে পালিয়ে আসে। এদের কেউ কেউ মরক্কোতে আসে এবং শেফশাওয়ান শহরে বসতি গড়ে।
তাদের ঐতিহ্য ছিল দেয়াল, রাস্তাঘাট নীল রং করে রাখা। আকাশের নীল রঙের অনুকরণে তারা মর্ত্যের বাড়িঘরে, রাস্তাঘাটেও নীল রঙ করতো। এটি নাকি তাদের ঈশ্বরের শক্তির কথা মনে করিয়ে দিতো। সেই ঐতিহ্য আজও প্রচলিত আছে এবং শহরটিকে আজকের বিখ্যাত ‘ব্লু সিটি’তে পরিণত করেছে।
ব্যাল্ডউইন স্ট্রীট, নিউজিল্যান্ড
নিউজিল্যান্ডের নতুন শহর ডুনেডিনের নগর পরিকল্পনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল লন্ডনের ডিজাইনারদের। তারা ডুনেডিনের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকে মাথায় রেখে পুরো শহরের সব রাস্তা তৈরী করেছিল গ্রীড প্যাটার্নে। ফলে এই শহরের অনেক রাস্তা খাড়া পর্বতের উপর দিয়ে যাওয়ার কারণে রাস্তাগুলো হয়েছে ভীষণ খাড়া। ব্যাল্ডউইন স্ট্রীট হচ্ছে এর মধ্যে সবচেয়ে খাড়া। পৃথিবীর সবচেয়ে খাড়া রাস্তা। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, সবচেয়ে সোজা খাড়া সড়ক হিসেবে গিনেস বুকে নাম লিখিয়েছে ব্যাল্ডউইন স্ট্রীট। অনেকেই অবশ্য একে সবচেয়ে খাড়া রাস্তা হিসেবে মানতে রাজী নন। তাতে কি? এর চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি নিউজিল্যান্ডের বিখ্যাত একটি পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। রাস্তার দু’পাশে সুদৃশ্য রেস্তোঁরা আছে। পর্যটকের ভিড় থাকায় অনেকে এখানে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের জন্য চাঁদা আদায় করেন। জোকার আর দর্শকের চিৎকার চেঁচামেচিতে মুখরিত থাকে ব্যাল্ডউইন স্ট্রীট।
লাম্বার্ড স্ট্রীট, যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত শহর স্যানফ্রান্সিসকোয় অবস্থিত লাম্বার্ড স্ট্রীট বিশ্বব্যাপী খ্যাতি কুড়িয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বাঁকানো রাস্তা হওয়ার কারণে। স্যানফ্রান্সিসকোর ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে রাস্তা তৈরী করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। লাম্বার্ড স্ট্রীট তৈরীর দায়িত্ব পড়েছিল যার কাঁধে তিনি এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেন এবং বেশ ভেবে-চিন্তে রাস্তাটির পরিকল্পনা করেন। তিনি ভেবে দেখেন যে, সড়কটি যদি সোজা করে তৈরী করা হয় তাহলে অনেক খাড়া হবে যার ফলে রাস্তাটি বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। তাই তিনি রাস্তাটিকে আঁকাবাঁকা করে বানানোর সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে দৃষ্টিনন্দন লাম্বার্ড স্ট্রীট। এই সড়কটির সাথে কিন্তু স্যানফ্রান্সিসকোর ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। লাম্বার্ড স্টীটের নামকরণ করা হয়েছে ফিলাডেলফিলার এক ব্যক্তির নামে।
লাম্বার্ড স্ট্রীট অনেক দীর্ঘ একটি রাস্তা। রাশিয়ান হিলের চূড়ায় খাড়া অংশে এর একটিমাত্র ব্লকই কেবল বাঁকানো। বাঁকানো অংশে রয়েছে হেয়ারপিন প্যাটার্নের আটটি বাঁক। প্রতিটি বাঁকে রয়েছে সুন্দর করে ছাঁটা ফুলগাছের নান্দনিক শোভা। রাস্তার পাশের রাশিয়ান হিলের রাজকীয় ম্যানশনগুলো রাস্তার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
দ্য জুলিও স্ট্রীট, আর্জেন্টিনা
প্রত্যেকটি বড় শহরের একটি প্রধান রাজপথ থাকে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ারসের প্রধান রাজপথ হচ্ছে নাইন দ্য জুলিও স্ট্রীট। এটি পৃথিবীর প্রশস্ততম রাজপথ হিসেবে পরিচিত।
আর্জেন্টিনার স্বাধীনতা দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে সড়কটি নির্মিত হয়। ১৮১৬ সালের ৯ জুলাই দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সড়কের নাম নাইন দ্য জুলিও স্ট্রীটও রাখা হয়েছে দেশটির স্বাধীনতা দিবস অনুসারেই। সড়কটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৩০ এর দশকে এবং সমাপ্ত হয় ১৯৮০ সালে। ১৪০ মিটার প্রশস্ত, ১৮ লেনের এই রাজপথের কেন্দ্রে রয়েছে ৭০ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট সূচালো স্মৃতিস্তম্ভ।
ট্রাফিক সিগন্যালে লাল বাতি জ্বললে রাস্তায় বাজিকর, আগুনখেকোসহ বিচিত্র রকমের পথশিল্পীদের নানান কীর্তি দেখতে পাওয়া যায়। সড়কটি দেখতে গিয়ে আপনি যদি ব্যস্ত শহরের শব্দের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যান তাহলেও চিন্তার কিছু নেই। পুরো রাস্তা জুড়ে রয়েছে গুল্মঘেরা চত্বর এবং পার্ক। সবুজ বৃক্ষরাজির সমারোহে সাজানো পার্কগুলোতে বসার জন্য বেঞ্চও আছে, যাতে আপনি বসে বসে পুরো সড়কে ঘটতে থাকা সব ঘটনাই দেখতে পাবেন।
ম্যাজিক রাউন্ড এবাউট, ইংল্যান্ড
লন্ডনের সুইনডনে অবস্থিত ম্যাজিক রাউন্ড এবাউট পৃথিবীর সবচেয়ে বিভ্রান্তকর রাউন্ড এবাউট। অনেকগুলো রাস্তা এসে যখন একটি বৃত্তাকার রাস্তায় মিলিত হয় তখন এই বৃত্তাকার সংযোগস্থলকে রাউন্ড এবাউট বলে। ম্যাজিক রাউন্ড এবাউটের কেন্দ্রে একটি বড় রাউন্ড এবাউটকে ঘিরে পাঁচটি ছোট রাউন্ড এবাউট রয়েছে। ১৯৭২ সালে নির্মিত এই রাউন্ড এবাউটের নাম নেয়া হয়েছে ব্রিটেনের একটি শিশুতোষ টিভি সিরিজ থেকে। এই রাউন্ড এবাউটটি সুইনডেনের যানজট অনেকটাই হ্রাস করেছে।
বিশ্বজুড়ে আরো নানা রকম অদ্ভুত রাস্তা আছে। যেমন- সুইজারল্যান্ডের জিওমেট্রিক স্ট্রীট। এই রাস্তার পাশের দেয়ালে রয়েছে রঙ-বেরঙের জ্যামিতিক নকশা। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনের পিঙ্ক স্ট্রীট আরেক অদ্ভুত সড়ক। এখানে পুরো রাস্তাটাই গোলাপি রঙ করা। অদ্ভুতুড়ে এসব রাস্তাঘাট সেসব দেশ আর শহরকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে আর পর্যটকদেরকে উপহার দিয়েছে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যের আধার। সুযোগ পেলে রাস্তাগুলো ঘুরে দেখতে ভুলবেন না!
ফিচার ইমেজ – boredpanda.com