একটি দেশ দরিদ্র হওয়ার পেছনে যেমন অনেকগুলো কারণ থাকে, তেমনই একটি দেশের ধনী হওয়ার পেছনেও অনেকগুলো কারণ থাকে। কেবল ঈশ্বর প্রদত্ত খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য দেশকে উন্নতি এনে দেয় না। বরং দেশের মোট সম্পদের পরিমাণের পাশাপাশি নতুন নতুন উপার্জনের সফল পথ, বেকারত্বের সবচেয়ে কম হার, প্রাকৃতিক সম্পদ আর সবচেয়ে বড় কথা জীবনের মান কতটা উন্নত তা বলে দেয় একটি দেশ কতটা ধনী।
এ পর্যায়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর অবস্থা, কেন তারা ধনী; সর্বোপরি কীভাবে ধনী তা জেনে নেওয়া যেতে পারে।
কাতার (জিডিপি ১ লাখ ২৯ হাজার ৭২৬ মার্কিন ডলার)
খনিজ তেলের খনি এই কাতারের মোট উপার্জনের ৭০ শতাংশই আসে তেল থেকে। এই পরিমাণ দেশের মোট রপ্তানি পণ্য হতে উপার্জনের ৮৫ শতাংশ। এছাড়া আসন্ন ২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রায় ২১ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই দেশের মানুষ উত্তরাধিকারসূত্রে বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িত। শুধু তা-ই নয়, এশিয়া এবং আফ্রিকা অঞ্চল থেকে শ্রমিক আমদানির ব্যাপারে কাতারের বিশেষ সুনাম আছে। এখানকার আরেকটি উঠতি অর্থনৈতিক খাত হলো পর্যটন। প্রতিনিয়ত এই খাতের আধুনিকায়ন করছে কাতার। ফলাফল হিসেবে বাড়ছে লভ্যাংশ। এটা সত্যি যে, খুব ছোট দেশ হয়েও খনিজ তেলের বিশাল ভাণ্ডারের সুবিধা পাচ্ছে কাতার। মূলত এ কারণেই অদূর ভবিষ্যতে তাদের আর্থিক সঙ্কটের মুখে পড়ার সুযোগ নেই। আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোও এ কারণে কাতারকে সমীহের চোখে দেখে।
লুক্সেমবার্গ (জিডিপি ১ লাখ ১ হাজার ৯৩৬ মার্কিন ডলার)
ধনী দেশগুলোর তালিকায় লুক্সেমবার্গ দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের নাম লিখিয়ে রেখেছে। এখানকার রক্ষণশীল নীতির সঙ্গে স্বাস্থ্যবান শিল্পখাত ও স্টিল সেক্টর এই দেশের সম্পদের মূল উপাদান। ইউরোপের ছোট্ট এই দেশটির পুরোপুরি এখনও শহর হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। এখানকার বেশিরভাগই গ্রামীণ পরিবেশ। সঙ্গে রয়েছে নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
বিশাল শিল্পখাত থাকা স্বত্বেও দেশজুড়ে সবুজের ছোঁয়া লুক্সেমবার্গকে বিশ্বজুড়ে পরিচিত হয়েছে একটি মডেল দেশ হিসেবে। পর্যটন খাতও দেশটির উপার্জনের অন্যতম একটি মাধ্যম। এখানকার অর্থনীতি অত্যন্ত উদ্ভাবনমুখী। লুক্সেমবার্গের মুদ্রাস্ফীতির হারও অনেক কম।
সিঙ্গাপুর (জিডিপি ৮৭ হাজার ৮২ মার্কিন ডলার)
সিঙ্গাপুরের মুক্ত অর্থনীতির নীতি এই দেশের অর্থনৈতিক শক্তিকে বেগবান করে চলেছে। এখানেই রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বন্দর। পুরো দেশ ভীষণভাবে জাহাজ ও পরিবহন ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। পাশাপাশি মুক্ত বাণিজ্যের স্বপক্ষের দেশে শত রকমের সংস্কৃতির প্রভাব এখানকার অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করেছে। এখানকার জীবনমানের খরচ অনেক বেশি। এই দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন দেশ, সেরা বিমানবন্দর ও তাদের সুবিধা বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। অর্থাৎ, সিঙ্গাপুরের ধনী হওয়ার পেছনে দেশ হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্যকে উন্নতিকরণ ও সেসব খাতের উপর নির্ভরশীল হওয়া অন্যতম কারণ।
ব্রুনাই (জিডিপি ৭৯ হাজার ৭১০ মার্কিন ডলার)
ব্রুনাই হলো সেই দেশ, যারা কি না স্থানীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে ছোট দেশ হয়েও অনেক সম্পদশালী হয়েছে, জিডিপিতে প্রভাব রেখেছে। অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিতে ব্রুনাইয়ের নাম বিশ্বজোড়া। এখানে নেই কোনো ইনকাম ট্যাক্স, নেই কোনো সেলস ট্যাক্স। তাছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে এ দেশের সরকার বড় ধরনের ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
১৯৮৪ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর ব্রুনাই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে দারুণভাবে এগিয়েছে। এ দেশের সম্পদশালী হওয়ার পেছনে অপরিশোধিত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সিঙ্গাপুরের পর দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে মানব সূচক উন্নয়নে সবচেয়ে এগিয়ে ব্রুনাই। এতসব সাফল্যের ফলাফলস্বরুপ, এরই মধ্যে ব্রুনাই ‘উন্নত দেশ’ এর তালিকায় নিজের নাম লিখিয়েছে।
কুয়েত (জিডিপি ৭১ হাজার ২৬৩ মার্কিন ডলার)
আরও একটি আরব দেশ কুয়েত, যাদের সম্পদের মূল উৎস খনিজ তেল। এই খাত থেকে দেশটি সবচেয়ে বেশি উপার্জন করে, যা দেশটির রাজস্ব আয়ের ৯৫ শতাংশ, রপ্তানিরও ৯৫ শতাংশ। তাছাড়া বিশ্বজুড়ে অপরিশোধিত তেলের ১০ শতাংশ রয়েছে কুয়েতের মাটিতে। তেলশিল্পের পাশাপাশি কুয়েত এখন উপার্জনের নতুন নতুন পথ খুঁজছে, যেগুলো তাদের ভবিষ্যতের দিনগুলোতে আর্থিক সঙ্কট থেকে বের করে আনবে। বলে রাখা ভালো, কুয়েতের সাংবিধানিক আমিরের সংসদীয় ব্যবস্থা রয়েছে।
আয়ারল্যান্ড (৬৯ হাজার ৩৭৪ মার্কিন ডলার)
আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন হলো দেশটির রাজধানী। এই শহর পর্যটকদের পছন্দের তালিকায় থাকে উপরের দিকে। শুধু তা-ই নয়, ডাবলিন হলো সেই শহর যেখানে অনেক জনপ্রিয় লেখক জন্মেছেন। এই দেশের অর্থনীতি ব্যবসা ও বিনিয়োগের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। জনগণের জন্য বিশ্বের অন্যতম সেরা জীবনমান নিশ্চিত করে চলেছে দেশটি। ২০০৮ সালের পর এখানকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি খানিকটা কমে গেলেও এখনও জিডিপির হার অনেক বেশি।
আয়ারল্যান্ড বিদেশি বিনিয়োগের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। সাবেক এই ব্রিটিশ কলোনির রয়েছে মজুদকৃত তেলের প্রাচুর্যতা। এছাড়াও মৎস্যশিল্প, কাঠশিল্প, খনিজ ও জলবিদ্যুৎ শিল্প এখানকার অন্যতম অর্থনৈতিক খাত।
নরওয়ে (জিডিপি ৬৯ হাজার, ২৯৬ মার্কিন ডলার)
স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ নরওয়ে তার অপরূপ সবুজ প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জাদুঘরগুলোর জন্য বিখ্যাত। এখানকার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিশ্র অর্থনীতি দেশটির শিল্পায়নের পর থেকে দারুণ উন্নতি করেছে। মৎস্যশিল্প, প্রাকৃতিক গ্যাস আর অপরিশোধিত তেল এ দেশের অর্থনীতির মূল ভিত। নরওয়ে মুক্ত অর্থনীতির অনুসারী। আয়ারল্যান্ডের মতো এই দেশও তার উন্নত জীবনমানের জন্য বিখ্যাত। নরওয়ে খুব কম বেকারত্ব ও বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার নিশ্চিতকারী অত্যন্ত উৎপাদনশীল একটি দেশ।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (জিডিপি ৬৭ হাজার ৬৯৬ মার্কিন ডলার)
সংযুক্ত আরব আমিরাত হলো মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল আয়তনের একটি দেশ, যার জনসংখ্যা মাত্র ৯ মিলিয়ন। এখানকার বেশিরভাগ উপার্জন আসে খনিজ তেল থেকে। তবে এই দেশের টেলিকম খাতও এখানকার মোট আয়ে বিশেষ প্রভাব রাখে। বিশ্বজুড়ে আরব আমিরাত তাদের তেলের ব্যবসাকে যেমন ছড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনই প্রযুক্তি ও সেবাখাতকে করছে আরও উন্নত। সাম্প্রতিক কালে আরব আমিরাতের পর্যটনখাত নজর কেড়েছে। ২০০৭-২০০৯ সাল পর্যন্ত দেশের আর্থিক দুরবস্থার দিনগুলোতে এই পর্যটনখাত দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখার পেছনে ভূমিকা রেখেছিল। এ দেশে ইনকাম ট্যাক্স দেওয়া লাগে না, যে কারণে ব্যবসায়ীদের জন্য এটা এক রকম স্বর্গ।
রিপাবলিক অব সান মারিনো (জিডিপি ৬৪ হাজার ৪৪৩ মার্কিন ডলার)
ইতালির কোল ঘেঁষে অবস্থান করা সান মারিনো ছোট্ট একটি দেশ হলেও এখানকার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অনেক বড় ও উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। পৃথিবীর অন্যতম ক্ষুদ্র দেশ এই সান মারিনো। এখানকার বেকারত্বের হার ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে কম। ভৌগলিক বিচারে সান মারিনো ইতালির ছায়া পেলেও জাতীয়তার প্রশ্নে এই দেশ কখনও কখনও ইতালির চেয়েও এগিয়ে। এখানকার পর্যটন খাত দেশের মোট রাজস্বের সবচেয়ে বড় প্রভাবক।
এই বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) ধনী হওয়ার কৌশল জানার বাংলায় অনুবাদ করা ৪টি বইয়ের কালেকশন
২) থিংক অ্যান্ড গ্রো রিচ