ভাবুন এমন একটি শহরের কথা, যেখানে নেই রাজনীতি, নেই দারিদ্র্য, নেই অপরাধ, এমনকি নেই টাকার নোটও। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে নির্বিশেষে বসবাস করতে পারে এ শহরে। কী ভাবছেন? নিছক কল্পনা? কল্পনার রাজ্য মনে হলেও বাস্তবেই এমন এক শহর রয়েছে। আর তা বেশি দূর নয়, পাশের দেশ ভারতে।
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভিলুপুরাম জেলায় অবস্থিত এই শহর। নাম অরোভিল। এর কিছু অংশ পাশের পুডুচেরি রাজ্যে বিস্তৃত। ‘অরোভিল’ নামটির উৎপত্তি ফরাসী শব্দ ‘অরোর’ (Aurore) থেকে, যার অর্থ ‘ভোর’। তাই অরোভিল ‘ভোরের শহর’ (City of Dawn) নামেও পরিচিত। এছাড়াও অনেকের মতে শহরটির নাম অরোভিল হয়েছে ভারতের বিশিষ্ট দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক গুরু যোগী শ্রী অরবিন্দুর নামানুসারে। তিনিই ছিলেন এই শহরের স্বপ্নদ্রষ্টা। শ্রী অরবিন্দুর ফরাসী বংশোদ্ভুত সহকারী মিরা আলফাসা প্রথম তার গুরুর এই স্বপ্নকে একটি মূর্তরুপ দান করেন।
মিরা আলফাসা এই শহরটিতে ‘The Mother’ নামে পরিচিত। তার বিশ্বাস ছিল যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শুভবুদ্ধি ও শুভ চিন্তার মানুষদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৈশ্বিক শহর সমগ্র মানবজাতিকে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে। একইসাথে এটি ভারতীয় রেনেঁসা বা নবজাগরণেও যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে মিরা আলফাসা বিবৃতি দেন যে, “অরোভিল একটি সার্বজনীন শহর হতে চায় যেখানে বর্ণ, রাজনীতি ও জাতীয়তা নির্বিশেষে সকল দেশের নারী ও পুরুষ শান্তি ও প্রগতির সাথে বাস করতে সক্ষম হবে।” পরের বছর ভারত সরকার কর্তৃক অরোভিলের ধারণাটি ইউনেস্কোর সাধারণ সভায় উত্থাপন করা হয় ও সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। এর দু’বছর পর ১৯৬৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পরিকল্পিত এলাকার কেন্দ্রে একটি বটগাছের নিচে প্রায় ৫,০০০ মানুষ শহরটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য জড়ো হন। ভারতের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য সহ পৃথিবীর ১২৪টি দেশ থেকে প্রতিনিধিরা আসেন এ অনুষ্ঠানে। প্রত্যেক প্রতিনিধি নিজ নিজ দেশের কিছু মাটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সবার জন্মভূমির মাটি মিশ্রিত করে একটি শ্বেত মার্বেলে তৈরি পদ্ম আকৃতির পাত্রে রাখা হয়। এটি বর্তমানে অরোভিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে সংরক্ষিত আছে। যথেষ্ট নাটকীয়তার মধ্যে দিয়েই অরোভিলের যাত্রা শুরু বলা যায়। একইসাথে মাদার (The Mother) অরোভিলের জন্য চার দফার একটি সনদ প্রণয়ন করেন। এই চারটি দফা হলো–
১) অরোভিল কারো একার না। এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য। কিন্তু কেউ অরোভিলের বাসিন্দা হতে চাইলে, তাকে অবশ্যই স্বর্গীয় চেতনাবোধের স্বেচ্ছাদাস হতে হবে।
২) অরোভিল হবে অফুরান শিক্ষা, অবিরাম প্রগতি ও শাশ্বত তারুণ্যের একটি স্থান।
৩) অরোভিল অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝে একটি সাঁকো হতে চায়। সকল আবিস্কারের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সুবিধাসমূহ গ্রহণ করে অরোভিল ভবিষ্যৎ উপলব্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।
৪) প্রকৃত মানব ঐক্যের মূর্ত প্রতিরুপের জন্য বস্তুগত ও আত্মিক গবেষণার একটি স্থান হবে অরোভিল।
বর্তমানে ৪৯টি দেশের প্রায় ২,৫০০ মানুষ অরোভিলে বাস করেন। এর দুই-তৃতীয়াংশই ভারতীয়। অন্যান্য জাতীয়তার মধ্যে রয়েছে ফরাসী, রাশিয়ান, আমেরিকান, জার্মান, ব্রিটিশ, ইসরায়েলি, মেক্সিকান, চীনা, জাপানি, শ্রীলঙ্কান, নেপালী, আইসল্যান্ডিক, চেক, ডাচ, ব্রাজিলিয়ান, আর্জেন্টাইন ইত্যাদি। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্তের মানুষই আছে এই শহরে। অরোভিলে ৫০ হাজার মানুষের বাসস্থান সংকুলানের ব্যবস্থা আছে। প্রতি বছর প্রায় ৫,০০০ পর্যটক এই বিশেষ শহর দেখতে আসেন।
বিচিত্র এই অরোভিলের নগর পরিকল্পনাটিও মনোমুগ্ধকর। নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী শহরের বাইরের দিকে ১.২৫ কি. মি. প্রশস্ত এলাকা হবে সবুজ গাছপালা পরিবেষ্টিত ‘গ্রিন বেল্ট’। এই অংশটি একইসাথে খাদ্য, প্রয়োজনীয় কাঠ, ওষুধের সরবরাহ ও বন্য প্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হবে। সেইসাথে নগর ও নিসর্গের মধ্যকার সীমারেখাও এঁকে দেয় এই অংশটি। বর্তমানে এটি ৪০৫ হেক্টর জায়গাজুড়ে অসম্পূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরো অরোভিলই বিভিন্ন স্তরে বিভক্ত। গ্রিন বেল্টের পরের অংশে রয়েছে ৯৩ হেক্টরের ‘সাংস্কৃতিক এলাকা’। শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধুলার বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করা হবে এ অংশে। এরপরে রয়েছে ৭৩ হেক্টরের ‘আন্তর্জাতিক এলাকা’। এখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্যাভিলিয়ন থাকার কথা রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্তরবিভক্ত এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো ‘আবাসিক এলাকা’। ১৮৯ হেক্টরের এই আবাসিক অংশটিতে ৫৫% গাছপালা ও ৪৫% দালান-কোঠা নির্মিত হবার পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থাৎ নগরের অভ্যন্তর ভাগেও নগর ও নিসর্গের মেলবন্ধনের ব্যবস্থা আছে।
অরোভিলকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ শহর হিসেবে তৈরি করার নিমিত্তে আবাসিক এলাকার পরে ১০৯ হেক্টর ‘শিল্প এলাকা’ রাখা হয়েছে। এখানে ছোট ও মধ্যম মানের শিল্পকারখানা, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শহরের প্রশাসন অবস্থিত। অরোভিলের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত ‘শান্তি এলাকা’। অরোভিলের ‘মাতৃমন্দির’, সংলগ্ন সুদৃশ্য বাগান, অ্যাম্ফিথিয়েটার ও মানব ঐক্যের নিদর্শন সেই শতাধিক দেশের মাটি দিয়ে ভরা পাত্রটি এই এলাকায় সংরক্ষিত। শহরের সামগ্রিক কাঠামোটি সর্পিলাকারে তৈরি।
১৯৮০ সালের আগে পন্ডিচেরির শ্রী অরবিন্দু সোসাইটি অরোভিলের প্রশাসনিক তত্ত্বাবধানে ছিল। ১৯৭৩ সালে মিরা আলফাসার মৃত্যুর পরে এই সোসাইটির সাথে অরোভিলের অধিবাসীদের সম্পর্কে ফাটল ধরতে থাকে। ১৯৮০ সালে ভারতীয় সরকার অরোভিল ইমার্জেন্সি প্রভিশন– ১৯৮০ অ্যাক্ট এর মাধ্যমে অরোভিলের ব্যবস্থাপনার ভার নিজের হাতে নিয়ে নেয়। যদিও প্রথম দিকে অরবিন্দু সোসাইটি অরোভিলের প্রশাসনে সরকারের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আপিল করে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায় সরকারের পক্ষেই যায়। এরপরে অরোভিলের জন্য একটি ত্রি-স্তরবিশিষ্ট প্রশাসনিক কাঠামোর প্রবর্তন হয়। এই কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তরে আছে ভারত সরকারের অনুমোদিত একটি গভর্নিং বোর্ড। এর সদস্য সকলেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও সমাজকর্মে অবদান রাখা প্রখ্যাত ভারতীয়। দ্বিতীয় স্তরে আছে একটি ৫ সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা পরিষদ, যার সদস্যরা মানবসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা অরোভিলের অধিবাসী। তৃতীয় পর্যায়ে আছে অরোভিল ফাউন্ডেশন। এটি একজন চেয়ারম্যান দ্বারা পরিচালিত স্বতন্ত্র পরিষদ, যা ভারত সরকারের জনসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে থাকে। অর্থাৎ অরোভিলের প্রশাসনে জনপ্রতিনিধি রয়েছে, কিন্তু কোনো প্রত্যক্ষ সরকার ব্যবস্থা নেই।
অরোভিলের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিও বেশ বিচিত্র। এখানে নেই কোনো কাগুজে বা ধাতব মুদ্রার প্রচলন। একটি মূল অ্যাকাউন্টে শহরের প্রত্যেক অধিবাসীকে একটি অস্থায়ী অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। প্রত্যেকের কাছে থাকে ‘অরোকার্ড’ নামে এক ধরনের ডেবিট কার্ড। সব ধরনের লেনদেন এই কার্ডের মাধ্যমেই হয়। শহরের অর্থনীতির ৭০% আসে বাইরের অনুদান থেকে। এর মধ্যে ২৩% আসে সরকারী অনুদান থেকে, ২২% ভারতের নাগরিকদের অনুদান থেকে, আর ২৫% আসে বিদেশী পর্যটক ও শুভাকাঙ্খীদের অনুদান থেকে। এছাড়া শহরের প্রত্যেক অধিবাসীর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে মাসিক অনুদান দেওয়ার নিয়ম আছে। জনগণের অর্থনীতির উৎস হিসেবে আছে পর্যটন শিল্প, নির্মাণ শিল্প, তথ্য প্রযুক্তি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা ইত্যাদি। প্রতিটি খাতের আলাদা আলাদা ইউনিট আছে। আশেপাশের এলাকাগুলো থেকেও প্রায় ৫,০০০ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অরোভিলের এই ইউনিটগুলোতে।
অরোভিলে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ। শহরের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হয় অগণিত সোলার প্যানেল দ্বারা। তবে বিগত কয়েক বছরে অপরাধমুক্ত শহর অরোভিলে অপরাধপ্রবণতা বাড়তে দেখা গেছে। হত্যা, যৌন নির্যাতন, লুট প্রভৃতি বিভিন্ন অপরাধের প্রাধান্য লক্ষিত হয়েছে অরোভিলে। এমনকি অ্যালকোহল ব্যবহারেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না অনেকে। অনেকের মতে যে পরিমাণ অর্থ ও বিদেশী অনুদান অরোভিলের অর্থনীতিতে প্রবেশ করে, তার তুলনায় এর উন্নয়নের গতি অনেক মন্থর। অনেক সমাজবিজ্ঞানীই এর বর্তমান অবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নন।
তবে তারপরেও বলতে হয়,যে লক্ষ্য নিয়ে অরোভিলের যাত্রা শুরু, তা আসলেই অনবদ্য। যদিও এর কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য এখনও অনেক দূরে, তবু এক টুকরো অরোভিল যেন আগামীর বৃহত্তর মানব ঐক্যের অগ্রদূত।