জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এতটাই ব্যাপক ও সর্বগ্রাসী যে তা আমাদের জন্য কল্পনা করাও কঠিন। দূর অতীতের জলবায়ু পরিবর্তন মানব সভ্যতার গতিপথকে বেশ কয়েকবার পাল্টে দিয়েছিল। তবে প্রকৃতির কারণে ঘটা পূর্ববর্তী সেসব জলবায়ু পরিবর্তন ছিল ধীর গতির, যা মানুষসহ গাছপালা ও প্রাণীজগৎকে অভিযোজিত হওয়ার জন্য লম্বা একটি সময় দিয়েছিল। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের যে ধারা তা অতীতের তুলনায় অত্যন্ত দ্রুতগতির। যেমন- ঊনিশ শতকের তুলনায় বর্তমানে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রায় ১.২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। আর এর পেছনের মূল কারণ বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের আধিক্য, যা তৈরি করছে গ্রিন হাউজ এফেক্ট। গ্রিন হাউজ এফেক্ট দ্রুতগতিতে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করছে।
গ্রিন হাউজ এফেক্ট তৈরিতে পৃথিবীর সব অঞ্চলের অবদান এক নয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আয় বৈষম্যভেদে গ্রিন হাউজ এফেক্ট তৈরিতে মানুষের অবদানের তারতম্য হয়। গবেষণাটির দেওয়া তথ্যানুসারে, পৃথিবীর এক বিলিয়ন ধনী মানুষ যেখানে মোট গ্রিন হাউজ গ্যাস সমূহের ৬০% উৎপাদনের জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী, সেখানে সবচেয়ে দরিদ্র তিন বিলিয়ন মানুষকে ৫% গ্রিন হাউজ গ্যাসের জন্য দায়ী করা যায়।
জলবায়ুর সব উপাদান একে অন্যের সাথে সংযুক্ত। যেকোনো একটির পরিবর্তন অন্যান্য উপাদানকেও প্রভাবিত করে। যেমন- বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্র এখন পূবের্র তুলনায় অনেক বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করছে। শিল্পবিপ্লব শুরুর সময়ের সাথে তুলনা করলে সমুদ্রের পানির অম্লতা এখন ৩০% বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের তুলনায় সমুদ্রের উষ্ণতাও বেড়েছে। সমুদ্রের উপরের ২,৩০০ ফুট পর্যন্ত গভীর পানির তাপমাত্রা ১৯৬৯ সালের তুলনায় প্রায় ০.৩ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে।
উষ্ণতা বৃদ্ধি সমুদ্রের আয়তন বৃদ্ধি করছে, যা সমুদ্রের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ২০১৭ সালে আর্কটিকে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৪,৪৮,০০০ বর্গ মাইল কম বরফ জমাট অবস্থায় ছিল। আর্কটিকে বর্তমানে গ্রীষ্মকালে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বেশি বরফ গলছে, কিন্তু শীতকালে সে তুলনায় জমাট বাঁধছে কম। বরফ কমার সাথে সাথে সূর্যের আলো প্রতিফলন করার জন্য বরফের সাদা পৃষ্ঠের পরিমাণ কমছে, যা অবশিষ্ট বরফকে আরও দ্রুতগতিতে গলিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, ২০৫০ সাল নাগাদ আর্কটিকে আর কোনো বরফ অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে বরফবিহীন উন্মুক্ত আর্কটিক সাগর অতিরিক্ত তাপ শোষণ করে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে দেবে। সমুদ্রের এমন আচরণ বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক পানি প্রবাহের যে চক্র বর্তমানে বিদ্যমান, তাকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে।
সাধারণত মহাসাগরের উপর পৃষ্ঠের গরম পানি বিভিন্ন চক্রাকার ঘূর্ণনের মাধ্যমে মেরু অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে তারা বরফের শীতল স্পর্শে ঠান্ডা হয়। পানি ঠান্ডা হলে তাদের ঘনত্ব বাড়ে এবং তারা নিচের দিকে নেমে গিয়ে সমুদ্রের তলকে আঘাত করে। উপর থেকে নিচের দিকে নামতে থাকা পানির চাপে তলদেশে পানি আবার বিষুবরেখার দিকে সরে যেতে শুরু করে। এই পুরো প্রক্রিয়াটি গ্লোবাল ওশান কনভেয়ার বেল্ট বা বিশ্ব মহাসমুদ্রের স্রোত পরিবাহক হিসেবে পরিচিত। মহাসাগরগুলোতে এমন কয়েকটি ওশান কনভেয়ার বেল্ট রয়েছে, যার উপর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বতর্মান বৃষ্টিপাত, মৌসুমী বায়ু প্রবাহ, আবহাওয়া নির্ভরশীল।
বরফ গলা পানির ঘনত্ব লবন পানির ঘনত্বের চেয়ে কম। বরফ গলা কম ঘনত্বের পানির পরিমাণ মেরু অঞ্চলে বেড়ে গেলে তা ওশান কনভেয়ার বেল্টগুলোর চক্রকার গতিকে হ্রাস করবে। ইতিমধ্যে গলফ স্ট্রিম কনভেয়ার বেল্টের গতি ২০০৮ সালের তুলনায় ১৫% হ্রাস পেয়েছে, যা গত ১,৬০০ বছরের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এই কনভেয়ার বেল্টগুলোর স্বাভাবিক গতি ও প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হওয়ায় বায়ুপ্রবাহের দিকও পরিবর্তিত হচ্ছে। আর্কটিকের মতো এন্টার্কটিকেও একইভাবে বরফ গলা মিষ্টি পানি লবন পানিকে সমুদ্রের তলদেশ স্পর্শ করতে বাঁধা প্রদান করছে।
আবার এই উষ্ণ লবন পানি ঘন হয়ে নিচের দিকে যেতে না পারায় তা ভাসতে থাকা বরফের স্তরকে নিচের দিক থেকেও গলিয়ে দিচ্ছে। এন্টার্কটিকে বরফের পুরুত্ব বর্তমানে বছরে ১.৬ মিটার হারে হ্রাস পাচ্ছে, যেখানে ১৯৯২ সালের আগেও এই হ্রাসের গড় পরিমাণ ছিল বছরে ৩.৮ সেন্টিমিটার। পৃথিবীর মোট মিঠা পানির ৬০-৯০ ভাগ এন্টার্কটিকায় বরফ হিসেবে জমে আছে। যদি এন্টার্কটির্কের বরফ পুরো গলে যায়, তবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ২০০ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে উভয় মেরুর বরফ গলে গত একশো বছরে সমুদ্রের পানির উচ্চতা ৮.৯ ইঞ্চি বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১৮ সালের মে মাসে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জলবায়ু পরিবর্তনের অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি চিত্র সবার সামনে উপস্থাপন করেন। তাদের ভাষ্যমতে, যদি প্যারিস ক্লাইমেট চুক্তি অনুসারে বিশ্বের সব দেশ মিলে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ২.৫% এ সীমাবদ্ধ রাখতে সক্ষম হয়, তবে বৈশ্বিক জিডিপির পরিমাণ ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে। যদি তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পায়, তবে জিডিপি হ্রাসের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৫%। যদি কেউই কিছু না করে, তবে ২১০০ সালের মধ্যে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে, যার ফলে ২০১০ এর তুলনায় জিডিপি ৩০% এর বেশি হ্রাস পাবে।
ওর্য়াল্ড এমপ্লয়মেন্ট ও সোশ্যাল আউটলুক ২০১৮ এর তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ১.২ বিলিয়ন মানুষের জীবিকা সরাসরি হুমকির মধ্যে পড়বে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ খাত হলো কৃষি, মৎস ও বন। ২০০০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২৩ মিলিয়ন মানুষের জীবিকা নষ্ট হয়েছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য সঠিক পদক্ষেপ যদি গ্রহণ করা যায়, তবে ২০৩০ সালের মধ্যে কেবল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রেই ২৪ মিলিয়ন নতুন জীবিকা তৈরি করা সম্ভব।
জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করবে তা দেখার জন্য ভবিষ্যতের অপেক্ষায় থাকার প্রয়োজন নেই। এ পরিবর্তনের প্রভাব ইতিমধ্যেই আমাদের জীবনে পড়তে শুরু করেছে। যেমন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তা ভূট্টা উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এই ভূট্টা বিভিন্ন খামারে পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভূট্টার উৎপাদন কম হলে তা ভূট্টার দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মাংস, দুধ ও এর থেকে তৈরি করা প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ভোক্তাদের উপর অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষের অভিবাসন প্রক্রিয়াও আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বন্যা, খরা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে মানুষ অন্য এলাকায় কিংবা অন্য দেশে অভিবাসন করছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক কমিশনের তথ্যমতে, ২০০৮ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২২.৫ মিলিয়ন মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভিবাসী হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ এই অভিবাসীর সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৭০০ মিলিয়নে। ২০১৭ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ জলবায়ু পরিবর্তনকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য একটি ঝুঁকি হিসেবে ঘোষণা করে। তারা হিসেব করে দেখেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া যুক্তরাষ্ট্রের ১২৮টি সামরিক ঘাঁটির নিরাপত্তাকে সরাসরি বিঘ্নিত করবে।
প্রায় সকল সরকারী, বেসরকারী সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারাকে মানবসৃষ্ট কারণ বলে স্বীকার করে নিয়েছে। জাতিসংঘের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বর্তমান ধারাকে বন্ধ করার জন্য পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ শিল্পায়ন পূর্ববর্তী তাপমাত্রার থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ইতিমধ্যে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিল্পায়ন পূর্ববর্তী তাপমাত্রা থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বব্যাপী গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর মাধ্যমে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই গ্রহণ করা হয়েছে।
১৯৯২ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কিয়োটো প্রটোকল গ্রহণ করে। ২০০৯ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে কোপেনহেগেন অ্যাকর্ড ঘোষিত হয়, যেখানে রাষ্ট্রসমূহ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ শিল্পায়ন পূর্ববর্তী সময় থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধিতে সীমাবদ্ধ রাখার ঘোষণা দেয়। ২০১০ সালে চীন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য ২০২০ সালের মধ্যে কিছু লক্ষ্যে পৌঁছানোর কর্মসূচী গ্রহণ করে, যার ভেতর আছে ২০০৫ সালে চীনে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের যে হার ছিল তা থেকে ৪০% কম কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস নির্গমন করা (২০১৭ সাল নাগাদ চীন লক্ষ্যের ৯৭% অর্জিত করেছে ), নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ৯.৪ থেকে ১৫% এ উন্নীত করা (৬০% লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত), বনের পরিমাণ ১.৩ বিলিয়ন কিউবিক মিটার বৃদ্ধি করা (২০১৭ সালে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করেছে) এবং ২০০৫ সালের তুলনায় ৪০ মিলিয়ন হেক্টর বনভূমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা (৬০% অর্জিত)।
২০১৫ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহার বিষয়ক এক পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যাতে মার্কিন রাজ্যসমূহ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করে তার পরিমাণকে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০০৫ সালের মাত্রা থেকে ৩২ শতাংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। ২০১৫ সালে জলবায়ু বিষয়ক প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে বিশ্বের ১৯৫টি দেশ স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুসারে, ২০২৫ সালের ভেতর দেশগুলো ২০০৫ সালে যে পরিমাণ গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গত করেছে তার তুলনায় ২৬-২৮% কম গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন করবে। একইসাথে তারা ২০২০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থ দরিদ্র দেশসমূহকে ৩ বিলিয়ন ডলার সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। ২০১৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন, যদিও অন্যান্য দেশসমূহ প্যারিস চুক্তি মেনে চলার ঘোষণা দিয়েছে।
প্রাক-শিল্পায়ন যুগের তুলনায় পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যায়, তবে পরবর্তীতে কোনো পদক্ষেপই জলবায়ু পরিবর্তনকে রোধ করতে পারবে না। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র একাই বিশ্বের মোট কার্বন ডাই অক্সাইডের ২০% বায়ুমন্ডলে নির্গত করে। জলবায়ু বিষয়ক যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাই অত্যন্ত জরুরি। কলকারখানাগুলো থেকে কার্বন নির্গমনের হার কমানোর জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন কার্বন ট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে। চীন, জার্মানি, সুইডেন ও ডেনমার্ক মাংস, দুধ ও পোল্ট্রি শিল্পের উপর কার্বন ট্যাক্স আরোপ করেছে। বিশ্বব্যাপী যে গ্রিন হাউজ গ্যাস উৎপন্ন হয় তার ১৪.৫% আসে গবাদিপশুর খামার ও প্রক্রিয়াজাত মাংস উৎপাদনের বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে।
ইতিমধ্যে বায়ুমন্ডলে যে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড জমেছে তার ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনা সহজ নয়। তারপরও কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে আনার বিষয়ে বড় বড় দেশসমূহ গড়িমসি করছে। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় এ বিষয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির চালকের আসনে বসার সুযোগ চীনের সামনে তৈরি হয়েছে। নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে চীন এখন বেশ অগ্রগামী। বিশ্বে যে পরিমাণ ইলেকট্রিক গাড়ি বর্তমানে ব্যবহৃত হয়, তার অর্ধেকই চীনে ব্যবহৃত হচ্ছে। চীন বিভিন্ন রকম ভর্তুকি দিয়ে তার নাগরিকদের ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহারে উৎসাহী করছে। চীনের বাজার এত বড় যে, তা বিশ্বের গাড়ি নির্মাতাদের ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরি ও বাজারজাতকরণের প্রতি আগ্রহী করে তুলছে।
তবে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের পরও বাস্তবতা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য বিশ্বব্যাপী ঐক্যমত এখনও তৈরি হয়নি। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ভারত, জাপান মোট কার্বন ডাই অক্সাইডের ৬০ ভাগ উৎপাদন করে থাকে। ২০১৪ সালের হিসেব মতে, মাথাপিছু হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নাগরিকপ্রতি ১৬.২ মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন করে। তাছাড়া এ দেশগুলো, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বায়ুমন্ডলে ৮ বিলিয়ন মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন করেছে, যা বায়ুমন্ডলে জমা হওয়া গ্রিন হাউজ গ্যাসের তিন ভাগের একভাগ। তাই এ দেশগুলো গ্রিন হাউজ গ্যাস হ্রাসে কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বাকি দেশগুলোর উদ্যোগ বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাস করতে কোনো কাজে আসবে না।
জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ধীরে ধীরে এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ছে। বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রিন হাউজ গ্যাস কমানোর প্রতি নজর দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ছে। সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে এসব নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে পণ্য উৎপাদনের প্রযুক্তি। বিশ্বে যে পরিমাণ গ্রিন হাউজ গ্যাস বর্তমানে তৈরি হয়, তার ৫০% উৎপাদিত হচ্ছে পোল্ট্রি, ডেইরি ও মাংস উৎপাদনের বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে। দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এসব খাবারের চাহিদা সীমিত করার মাধ্যমে এগুলোর উৎপাদন হ্রাসের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ গতিপথ কী হবে তা নির্ধারণ করবে জলবায়ু পরিবর্তনের গতিকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারছি তার উপর। যদি এর গতিপথ রোধ করা সম্ভব না হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিষ্ক্রিয়তার জন্য ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যর্থ প্রজন্ম হিসেবে আমাদের সময়কে মনে রাখবে।