মধ্যপ্রাচ্যের শুষ্ক বায়ুর রুক্ষতার মাঝে হঠাৎ প্রাণের ঝঙ্কারের ন্যায় নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া লবণাক্ত হ্রদের নাম আরমিয়া। ইরানের বুকে অবস্থিত এই হ্রদকে স্থানীয়রা ‘উর্মিয়া’ নামেও ডাকেন। আজ থেকে ২০ বছর পূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন জরিপ সংস্থার হিসাবানুযায়ী, এই হ্রদটি ছিল এই অঞ্চলের বৃহত্তম লবণাক্ত পানির হ্রদ। মৃত সাগরের ন্যায় অতিরিক্ত লবণাক্ত এই হ্রদে প্লবতার ফলে একজন মাঝারি ওজনের মানুষ অনায়াসে ভেসে থাকতে পারতেন। ফলে হ্রদের প্রাকৃতিক রুক্ষতার মাঝেও গড়ে উঠে ইরানের অন্যতম বৃহত্তম পর্যটন শিল্প।
দুপুরের প্রচণ্ড রোদের তেজ কমে যখন বিকেলের স্নিগ্ধতা এসে বিরাজ করতো, ঠিক তখন ফ্ল্যামিঙ্গো পাখির আনাগোনা শুরু হতো হ্রদের বুকে। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং সারাদিনের ক্লান্তি ভুলতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ আসর জমাতো এই হ্রদের তীরে। এভাবে দিনকাল কেটে যাচ্ছিলো বেশ! কিন্তু কে জানতো সেদিনের প্রাণবন্ত আরমিয়া একদিন পরিণত হবে শুষ্ক মরু অঞ্চলে? ২০ বছর পরের আরমিয়া যেন তার পূর্ব পরিচয়ের মেকি রুপ নিয়ে টিকে আছে মৃতপ্রায় অবস্থায়। সেখানে প্রাণের কোনো উচ্ছ্বাস নেই; নেই ফ্ল্যামিঙ্গোদের কোলাহল। যতদূর চোখ যায়, শুধু অসীম শুষ্কতা আর রুক্ষতা। যেন রূপকথার তেপান্তরের পিশাচ এসে ভর করেছে মধ্যপ্রাচ্যের এই হ্রদের বুকে।
“আরমিয়া ঠিকই আছে। কিন্তু সেটা আগের মতো নেই। যেন অন্যগ্রহের কোনো অজানা স্থানের দৃশ্য অবলোকন করছি। আমি মাঝে মাঝে দেখি কিছু শুঁয়োপোকা দল বেঁধে হ্রদের শুকনো ডাঙায় পড়ে থাকা মৃত প্রাণীর দেহ থেকে লবণ কুঁড়িয়ে নিচ্ছে।“
এই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন গ্যারি লুইস। জাতিসংঘের আবাসন সমন্বয়ক সংস্থার ঊর্ধ্বতন এই কর্মকতার শৈশবের অধিকাংশ সময় কেটেছিলো আরমিয়া তীরে খেলা করতে করতে।
আরমিয়া হ্রদ পরিচিতি
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত আরমিয়া হ্রদকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম হ্রদ হিসেবে গণ্য করা হতো। পুরো হ্রদটির ক্ষেত্রফল প্রায় দুই হাজার বর্গ মাইল। ২০ বছর পূর্বের হিসাবানুযায়ী, আরমিয়া হ্রদে পানি ছিল প্রায় ৩০ বিলিয়ন ঘন মিটার। কিন্তু কিছু প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণে সেই হ্রদ আজ মৃতপ্রায়।
১৯৬৭ সাল থেকে এই হ্রদটি ইরান সরকারের বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণের আওতাধীনে আছে। যেহেতু হ্রদের পানির কোনো নির্গমনপথ নেই, তাই এর পানি প্রচণ্ড লবণাক্ত। বিখ্যাত লবণাক্ত হ্রদ মৃত সাগরের (ডেড সি) তুলনায় যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ। শীতের শেষে এই লবণাক্ততার পরিমাণ ৮ শতাংশে নেমে আসলেও হেমন্তের শুরুতে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২৬ শতাংশ পর্যন্ত। হ্রদের লবণাক্ততার উৎস হিসেবে বিভিন্ন সোডিয়াম এবং সালফার লবণের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
লবণাক্ততার ফলে এই হ্রদের জীববৈচিত্র্য অন্যান্য হ্রদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। লবণাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার উপযোগী বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং অণুজীব ব্যতীত অন্য কোনো জীবই এখানে টিকে থাকতে পারে না। শেলড্রে, ফ্ল্যামিঙ্গো এবং পেলিকানসহ বেশ কিছু প্রজাতির পাখি শীতকালে এই অঞ্চলে অতিথি পাখি হিসেবে পরিভ্রমণ করে।
আরমিয়া থেকে বলছি
“১৯৫৬ সালের হিসাব অনুযায়ী ইরানে মাথাপিছু পানির পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ঘন মিটার। আজ (২০১৪ সাল) সেটি কমে দাঁড়িয়েছে ১,৯০০ ঘন মিটারে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২০ সালের মধ্যে পানির পরিমাণ কমে দাঁড়াবে মাত্র ১,৩০০ ঘন মিটারে।”
বেশ আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিলেন গ্যারি লুইস। ইরানের হ্রদগুলো যেন হঠাৎ করেই শুকিয়ে যাচ্ছে। এদের মধ্যে আরমিয়া হ্রদের অবস্থা সবচেয়ে আশঙ্কাজনক। এই হ্রদ শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এই একে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা পর্যটন কেন্দ্র, লবণ শিল্প, পানি সম্পদ ভিত্তিক শিল্প কারখানাসহ বেশ কিছু শিল্প হুমকির মুখে রয়েছে। ইরানের মাথাপিছু পানির পরিমাণে চরম ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ইরানে আরমিয়া হ্রদের শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা এতটাই গুরুত্ব লাভ করেছে যে, বর্তমান রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি তার নির্বাচনী ইশতেহারে আরমিয়া হ্রদ পুনরায় প্রাণবন্ত করে তোলার মূল্যবান আশ্বাস দিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালের আরমিয়া হ্রদের পুরো আয়তন ইউরোপের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লুক্সেমবার্গের সমতুল্য ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালের মাথায় বিভিন্ন কারণে এই হ্রদ শুকিয়ে এর আসল আয়তনের প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর শুষ্ক অঞ্চলের উপর দিয়ে স্থানীয় তরুণরা বিভিন্ন মোটর যানে চড়ে আরমিয়া থেকে তাব্রিজ শহরে ভ্রমণ করে থাকে, যেখানে একসময় বয়ে চলতো হ্রদের লবণাক্ত পানি।
আরমিয়ার পানিশূন্যতার ফলে এই অঞ্চলের খাদ্যচক্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। বিভিন্ন লবণাক্ত জলজ প্রাণী এবং পাখির বিলুপ্তির ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। এবছর ৮ জানুয়ারি ইরান সরকারের বিবৃতি অনুযায়ী, আরমিয়া হ্রদের পানির উচ্চতা প্রায় ২৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। হ্রদের বর্তমান পানির পরিমাণ পূর্বের তুলনায় প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘন মিটার হ্রাস পেয়েছে।
হ্রদ শুকিয়ে যাওয়ার কারণ
হঠাৎ আরমিয়ার মতো বিশাল একটি জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে ইরান সরকার। দ্রুততার সাথে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হলো, এই হ্রদের শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের অভিশপ্ত খরা। ভৌগোলিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে সূর্য খাড়াভাবে তাপ দেয়ার ফলে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এখানকার তাপমাত্রা অনেক বেশি। কিন্তু পরিবেশবাদীরা খরার উপর একচেটিয়া দোষারোপের বিরোধিতা করেছেন।
আরমিয়া হ্রদ থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত আরেকটি হ্রদের নাম ভ্যান হ্রদ। তুরস্ক অঞ্চলে অবস্থিত এই হ্রদের পরিবেশের সাথে আরমিয়ার অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। প্রায় সমান পরিমাণ তাপমাত্রা বিরাজমান থাকলেও আরমিয়ার মতো ভ্যান হ্রদে কোনোরূপ বিপর্যয় দেখা যায়নি। তাই আরমিয়া বিপর্যয় নিয়ে বিজ্ঞানীরা নতুনভাবে গবেষণা শুরু করেন। এই গবেষণায় বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। ধরা পড়ে যায়, মুনাফালোভী সরকারী চক্রের অব্যবস্থাপনা এবং কৃষিকাজে অবাধে আরমিয়ার পানির অপব্যবহারসহ নানা চিত্র।
গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, আরমিয়ার শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে খরার ভূমিকার চেয়ে অন্যান্য কারণের ভূমিকা প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি। UNEP বা জাতিসংঘ পরিবেশ বিষয়ক সংস্থার হিসাবানুযায়ী, সেচ এবং ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে আরমিয়া হ্রদের প্রবাহ পরিবর্তন করা হয়েছে। এর ফলে হ্রদের পানির পরিমাণ ৬৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। হ্রদের শুষ্কতার ফলে এই অঞ্চলে আবহাওয়ার উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে। হ্রদের পানিতে বাঁধ নির্মাণের ফলে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ১০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
হ্রদ বিপর্যয় নিয়ে আরো বিশদভাবে জানতে হলে প্রথমেই আমাদের হ্রদের উৎস নিয়ে পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। জারিনেহ নদীসহ প্রায় ১৩টি নদীর পানি এসে মিলিত হয়েছে আরমিয়া হ্রদের বুকে। নদীর পানি ছাড়াও বারিপাতের ফলে পতিত পানিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস থেকে পানি প্রবাহিত হয়েছে আরমিয়ার বুকে।
১৯৯৯ সালে ইরান সরকার কর্তৃক এক প্রকল্পে জারিনেহ নদী থেকে পানিপ্রবাহ পরিবর্তন করে নিকটবর্তী শহর তাব্রিজে প্রেরণ করা হয়। তাব্রিজের মতো আধুনিক শহরে পানির চাহিদা পূরণের অন্যতম উৎস হয়ে দাঁড়ানো জারিনেহ নদী আরমিয়া হ্রদে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সেদিকে সরকার কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে মাইন্দোয়াব, আজারশার, বোনাব, গুগানসহ বেশ কয়েকটি শহরে জারিনেহ নদীর পানি সরবরাহ করা শুরু করে শুরু করে।
পরপর দুটো প্রকল্পে অভাবনীয় সাফল্য লাভের পর সরকার কর্তৃক তৃতীয় প্রকল্প হাতে নেয়া হলে দেশটির সংসদ সদস্য নাদের ঘাজিপুর এর প্রতিবাদ করেন। ততদিনে আরমিয়া হ্রদের পানি দ্রুতগতিতে হ্রাস পেতে থাকে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঘাজিপুর সাহেব জানান,
“ঠিক কী কারণে বোনাব এবং আজারশারের পানির চাহিদা পূরণ করতে আরমিয়া হ্রদের প্রধান উৎস জারিনেহ নদীকে বেছে নেওয়া হলো, সেটা আমার বোধগম্য নয়। আরমিয়ার বিনিময়ে কেন তাব্রিজের কারখানাগুলো চলবে? এদিকে আমাদের আরমিয়া মরে যাচ্ছে!”
আবার কেউ যদি মনে করে, শুধু নগরায়ণের খেসারত দিতে গিয়ে আজ আরমিয়া দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে, তাহলে ভুল করবেন। সম্প্রতি আরমিয়া অঞ্চলের কৃষকদের একটি সিদ্ধান্তের ফলে নতুন করে সংকটের মুখে পড়েছে আরমিয়া হ্রদ। বছরের পর বছর আঙুর চাষে লোকসান হবার পর এখানকার চাষীরা আঙুর চাষ পরিত্যাগ করে আপেল চাষ করা শুরু করেন। ফলে পূর্বের তুলনায় পানির চাহিদা বেড়ে যায় প্রায় ১২ গুণ। এই পানির চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়ে উঠতে হয়েছে আরমিয়া হ্রদসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য প্রধান জলাধারগুলোকে। নাসের কারামি নামক এক অধ্যাপক কৃষকদের এই সিদ্ধান্ত আরমিয়া হ্রদ বিপর্যয়ের পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করবে বলে চিহ্নিত করেছেন।
আরমিয়া এখন রক্তিম
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে নাসার অ্যাকুয়া নামক কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবিতে আরমিয়া হ্রদের পানি কিছুটা সবুজাভ দেখা যায়। সেবছর জুলাই মাসে অ্যাকুয়া উপগ্রহ পুনরায় আরমিয়া হ্রদের কিছু ছবি তুলে নাসার গবেষণাগারে প্রেরণ করে। কিন্তু এবার আরমিয়া হ্রদের পানির রঙ পূর্বের ন্যায় সবুজ ছিল না। বরং এর রঙ কিছুটা লালচে ছিল। হঠাৎ করে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে মৃতপ্রায় আরমিয়ার পানির রঙ বদলে যাওয়ায় অনেকেই ভীত হয়ে পড়েন। স্থানীয়রা এর কারণ হিসেবে পানিতে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের নিষ্কাশনকে দায়ী করলেও এই ধারণার সাথে সম্পূর্ণ একমত হননি বিজ্ঞানীরা। তাই আরমিয়ার রঙ পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা শুরু হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী, অতিরিক্ত পরিমাণে পানি শুকিয়ে যাওয়ার ফলে আরমিয়া হ্রদের লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। উষ্ণ তাপমাত্রা এবং লবণাক্ত পানি Dunaliella নামক শৈবালের বংশবিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ। বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই শৈবালের প্রাচুর্যের ফলেই পানির রঙ ধীরে ধীরে লালচে রূপ ধারণ করেছে। স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ তুরাইন নাসাকে জানান,
“ডুনালিয়েলা সাগরের পানিতে সবুজ রঙ ধারণ করলেও অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি এবং আলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে এর রঙ পরিবর্তিত হয়ে লালচে হয়ে যায়।”
আরমিয়ার লালচে পানির ঘটনা একদম নতুন নয়। এর পূর্বেও আরমিয়ার পানি লবণাক্ততা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে লাল হয়েছে। কিন্তু বসন্তকালীন বৃষ্টি এবং তুষারপাতের ফলে এর লবণাক্ততা পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে গেলে পানির রঙ পুনরায় সবুজ হয়ে যেত।
বর্তমানে চলমান খরা এবং আরমিয়া বিপর্যয়ের ফলে পুনরায় সবুজ আরমিয়া ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা দিন দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, লাল পানির আরমিয়া নিয়ে কি আমাদের শঙ্কিত হওয়া সমীচীন? এর উত্তর হবে, আরমিয়ার স্থায়ী লালচে পানি যেন এক আগাম অশনি সংকেত। এজন্য আমাদের শঙ্কিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
আরমিয়া রক্ষায় ইরান সরকারের কার্যক্রম
আরমিয়া ধ্বংসের পেছনে যেমন ইরান সরকারের হাত রয়েছে, অপরদিকে আরমিয়া রক্ষায়ও ইরান সরকারের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ইরানি পরিবেশ মন্ত্রণালয় এর সাথে UNDP-এর যৌথ সম্মেলনে আরমিয়া রক্ষার জন্য সর্বমোট ২৪টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। আরমিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ এই হ্রদ রক্ষায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি ক্ষমতা গ্রহণের পর তার প্রথম সরকারি সম্মেলনে আরমিয়া রক্ষার উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করেন। আরমিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসের আঘ এই কমিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি ট্রেণ্ডজ ম্যাগাজিনকে জানান,
“আরমিয়া রক্ষা করার এই মিশন খুবই জটিল। প্রাথমিকভাবে সহজ মনে হলেও আমরা হ্রদের পানি রক্ষার্থে বেশ কয়েক বছর ধরে হিমশিম খাচ্ছি। যদি সবকিছু ঠিকঠাকভাবে চলে, তারপরও ১০ বছরে আরমিয়া হ্রদের মাত্র অর্ধেক পরিমাণ পানি রক্ষা করা সম্ভব হবে। একটি-দুটি পদক্ষেপ নিলে চলবে না, আমাদের দরকার দীর্ঘমেয়াদি মানসম্মত প্রকল্প।”
তবে বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে- ‘যত গর্জে, তত বর্ষে না’। ইরান সরকারের কাজের শোরগোলের তুলনায় এর ফলাফল নিতান্ত শূন্যই বলা চলে। মিলিয়ন ডলার প্রকল্প অনুমোদনের পরও একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনে ইরানের অবস্থান নবম। ওদিকে আরমিয়া হ্রদ নীরবে শুকিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।
ইরানের স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, আরমিয়া রক্ষার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন আরমিয়ার পানি বণ্টনে কৃষিখাতে এর সরবরাহ হ্রাসকরণ, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নগরীতে আরমিয়ার পানি সরবরাহ নিষিদ্ধকরণ ইত্যাদি। কিন্তু এর ফলে স্থানীয় কৃষক সম্প্রদায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনকি তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ।
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সরকার অনুমোদিত ২৪টি প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা কী? চলুন এই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মুখ থেকেই এর উত্তর জেনে আসা যাক। আরমিয়া হ্রদ রক্ষা কমিটির প্রধান ইশা কালান্তারি এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেন যে, অব্যবস্থাপনার ফলে ২০২৩ সালের মধ্যে আরমিয়া রক্ষা করা সম্ভব হবে না। সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত অর্থের ঘাটতিকে এর পেছনে দায়ী করেন ইশা। এটি রক্ষা করার জন্য এখন বিদেশি সাহায্যের কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। গত বছর নভেম্বরে ইরানি মন্ত্রী মোহাম্মদ ইসমাইল সাঈদি জানান,
“আরমিয়া হ্রদ রক্ষার উদ্দেশ্যে গৃহীত অধিকাংশ প্রকল্পই এখন সরকারের অবহেলায় বন্ধ রয়েছে। এসব প্রকল্পের অগ্রগতি এখনও শূন্যের ঘরে।“
একদিকে ইরান সরকারের টালবাহনা, অপরদিকে নগরায়ণের চরম মূল্য পরিশোধ করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সম্পদ আরমিয়া হ্রদ আজ মৃতপ্রায়। কৃত্রিম উপগ্রহের চোখে লালচে আরমিয়া যেন তপ্ত ধরণীর বুকে করুণ রক্তক্ষরণের কঠিন প্রতিচ্ছবি। কথায় আছে, পানির অপর নাম জীবন। এভাবে একের পর এক জলাধারের বিলুপ্তির মাধ্যমে আমাদের প্রিয় গ্রহ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মূল্যবান সম্পদ পানি। এর সাথে সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে শত শত প্রজাতির প্রাণ। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের অভিশপ্ত থাবা থেকে মুক্তি পেতে হলে খুব দ্রুত আরমিয়া সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি। এর দায়িত্ব শুধু ইরান সরকারের একার উপর ছেড়ে দিলে চলবে না। এর জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশের সরব অবদান রাখা এখন সময়ের দাবি।
ফিচার ইমেজ: Financial Tribune