রাজনৈতিক মেরুকরণের মুখে উগ্র জাতীয়তাবাদের যেখানে বাড়বাড়ন্ত, সেখানে পৃথিবীতে এমন মানুষও নেহায়েত কম নন, যাদের কোনো জাতীয়তাই নেই। দেশ থাকতেও যারা দেশহীন, অস্তিত্ব থাকতেও যারা পরিচয়হীন। নিজেদের দেশেই এদের কোনো স্বীকৃতি নেই।
এই হতভাগা মানুষেরা একটি দেশে জন্মান, বেড়ে ওঠেন, কিন্তু সেই দেশের রাষ্ট্রীয় বেশিরভাগ সুযোগ-সুবিধা থেকেই বঞ্চিত হন তারা। পড়াশোনা, চিকিৎসা, বিয়ে এবং জমি ক্রয়ের মতো নাগরিক সুবিধার বেলায় মানুষগুলো চরমতম অবহেলার শিকার হন। ভাগ্যপীড়িত এই মানুষেরা অনেকেই মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে দেশচ্যুত হন।
একটি দেশের নাগরিকত্ব আইনে যখন কেউ আর সে দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হন না, তখনই মূলত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সে দেশে পরাধীন হয়ে যান। তাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত আইনের বলে বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় কাজে তারা আর অংশগ্রহণ করতে পারেন না।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা UNHCR-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোনো দেশের নাগরিক নয়, এমন মানুষগুলোর এক-তৃতীয়াংশই হলো শিশু। আর রাষ্ট্রের নাগরিকের মর্যাদা না পাওয়া এসব গোষ্ঠীগুলো সে দেশে সংখ্যালঘু।
নাগরিকত্বহীন গোষ্ঠীগুলো অনেকসময় জাতিগত নিধনের শিকার হন। যার কারণে বাধ্য হয়ে তারা দেশ ত্যাগ করেন, নয়তো মারা পড়েন নিজ দেশেই। পৃথিবীতে এরকম কয়েকটি দেশ আছে, যারা পালিয়ে আসা মানুষগুলোকে আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৪ সালে UNHCR বিশ্বে নাগরিকত্ব সমস্যা পুরোপুরি মেটানোর জন্য ১০ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প অনুমোদন করে। সে প্রকল্পের কথা তোলা থাক। আজকের লেখায় আমরা মূলত জানব বৃহৎ পাঁচটি নাগরিকত্বহীন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় সম্পর্কে।
১. কুর্দি
কুর্দিস্তান যদি দেশ হতো, তবে তার আয়তন দাঁড়াত পাঁচ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। ইরাক, ইরান, তুরস্ক ও সিরিয়ার সঙ্গে ছড়ানো-ছিটানো সীমানা রয়েছে তাদের, যদিও কুর্দিরা একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জন্য বহু আগে থেকে দাবি করে আসছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমারা একটি স্বাধীন কুর্দি রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে যখন তুরস্কের নতুন সীমানা নির্ধারিত হয়, তখন ‘লসেন চুক্তি’র কারণে কুর্দিদের জন্য কোনো জায়গা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়নি।
ছড়িয়ে থাকা কুর্দি অঞ্চলগুলোতে তিন থেকে চার কোটি কুর্দি বসবাস করে। এতো বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী নিয়েও তারা সবসময় জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে আসছে। নিজ ভূমে তাদেরকে ‘ভিনদেশি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, যা তাদের সকল দিক থেকে নিরাপত্তাহীন করে রেখেছে। কিন্তু এই কুর্দিদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা, আছে ভীষণ সমৃদ্ধ এক সংস্কৃতিও। কুর্দিদের মধ্যে ধর্মীয়ভাবে মুসলিমদের সংখ্যাধিক্য থাকলেও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীও রয়েছেন।
ইরাকের একনায়ক সাদ্দাম হোসেন ১৯৮০ সালে তিন লক্ষ ইরাকি কুর্দির নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। পরবর্তীতে কুর্দিরা যখন অস্ত্র তুলে নেয়, সাদ্দাম হোসেনের বাহিনী কুর্দিদের একটি গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাঁচ হাজার বেসামরিক নারী-পুরুষকে হত্যা করে। এ অভিযানে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ রয়েছে। সাদ্দাম-পরবর্তী সময়ে কুর্দিরা কুর্দিস্তান নামে স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল লাভ করে।
সিরিয়ায় ১৯৬২ সাল থেকে কুর্দিদের বিরুদ্ধে নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কুর্দিরা খুবই খারাপ সময় পার করছে সেখানে।
২. রোহিঙ্গা
বাংলাদেশের কুতুপালং শরণার্থী শিবির সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ নাগরিকত্বহীন মানুষদের থাকার অস্থায়ী আবাস। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকার কর্তৃক পরিচালিত জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে লাখ-লাখ মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। বর্তমানে সেখানে আট লক্ষেরও এর অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম অবস্থান করছে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জাতি হিসেবে অভিহিত করে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, বৌদ্ধ অধ্যুষিত রাখাইন অঞ্চলে নবম শতাব্দীতে সর্বপ্রথম মুসলিমরা পা রাখে। সেই থেকে বসতি স্থাপনের একটি পর্যায়ে ক্রমেই এলাকাটি বৌদ্ধ থেকে মুসলিমপ্রধান জনপদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বহু শতাব্দী ধরে এখানে বসবাস করার কারণে রোহিঙ্গাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে।
১৯৮২ সালে মিয়ানমার নাগরিকত্বের নতুন আইন পাস করে, যেখান থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নাগরিক তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এই আইনের ফলে রাতারাতি তারা রাষ্ট্রহীন একটি জাতিতে পরিণত হয়। তাদের সকল নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় এবং রোহিঙ্গাদের জমিজমা বাজেয়াপ্ত করা হয়।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের একটি সশস্ত্র দল মিয়ানমার পুলিশের চেকপোস্টে হামলা করে, যার জের ধরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা নিধনে মেতে ওঠে। জাতিগত নিধনের এক পর্যায়ে সরকারের সঙ্গে উগ্রপন্থী কিছু বৌদ্ধভিক্ষুও যোগ দেয়। অল্প সময়ের ভেতর রাখাইনে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় এবং রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গুম, হত্যা, ধর্ষণের শিকার হয়ে হাজার-হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে। জাতিগত নিধনের ইতিহাসে এই ঘটনা সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ তৈরি করেছে।
৩. ফিলিস্তিনি
যেসব জাতি নিজ ভূখণ্ড থাকার পরও নিধনের স্বীকার হচ্ছে, তাদের ভেতর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন অন্যতম। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো যখন স্বাধীন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের জন্য অনেক আগে থেকে বলে আসছে, আমেরিকানরা তাদের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করছে বারবার। তাদের সমর্থন পেয়ে ইসরায়েল ক্রমান্বয়ে ফিলিস্তিনিদের জায়গায় নিজেদের বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে।
ভাষার প্রশ্নে ফিলিস্তিনিরা অভিন্ন অর্থাৎ আরবি হলেও ধর্মের দিক দিয়ে এই জাতিটির মধ্যেও রয়েছে বিভিন্নতা। শতকরা ১৫ ভাগ কপটিক খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর পাশাপাশি শতকরা ৮৫ ভাগ হচ্ছেন মুসলিম।
১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ ফিলিস্তিনকে ভেঙে ইহুদি এবং আরব অঞ্চল গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এ উদ্যোগে সম্মত হয়নি। যার পরিণতি ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। এরপর থেমে থেমে চলা উত্তেজনা-সংঘর্ষে ফিলিস্তিনিরা একটু একটু করে হারাতে থাকেন নিজেদের ভূখণ্ড। ১৯৬৭ সালে ছ’দিন ধরে চলমান যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনিদের গাজা উপত্যকা এবং পশ্চিম তীর ইসরায়েলিদের দখলে চলে যায়।
নিজেদের ভূমি হারিয়ে ৫০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি নিজ দেশে পরাধীন হয়ে পড়েন। বর্তমানে নতুন করে ইসরায়েল প্রতিনিয়তই নিজেদের অধিকৃত অঞ্চলের সীমানা বাড়াচ্ছে। ফলে আরও বেশি সংখ্যক ফিলিস্তিনি জনগণ নিজেদের এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন।
৪. রোমা
‘জিপসি’ নামটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। এই রোমা বা রোমানিদেরই মূলত জিপসি বলে সম্বোধন করা হয়। অনেকেই রোমানিদের মিশরীয় হিসেবে ভুল করেন। রোমানিরা ইউরোপে জাতিগত নিধনের শিকার হয়েছিলেন। রোমানিরা মূলত হরিয়ানা, রাজস্থান, পাঞ্জাবের মতো কিছু এলাকা নিয়ে রোমা জাতি গঠন করেছিল। তের থেকে পনের শতাব্দীতে তারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তাদেরও রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি।
ইউরোপে থাকাকালীন রোমারা জায়গা-জমি কেনায় আগ্রহী ছিল না। এমনকি তারা ঘরও বাঁধত না, মোটামুটি যাযাবর জীবন-যাপনের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে অসংখ্য রোমানিকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
এই যাযাবর জাতি যুগোস্লোভিয়াতে বেশ ভালো অবস্থানেই ছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের দিকে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রটির পতনের পর বলকান অঞ্চলগুলো থেকে হাজার-হাজার রোমানিকে বিতাড়িত করা হয়। তাদের সকল নাগরিক-অধিকার যখন একে একে খর্ব হতে থাকে, তখন রোমানিরা নিজেদের আদি নিবাসগুলোতে ফিরে যেতে শুরু করে কোনোরকম নিয়ম-নীতি না মেনেই।
এতে করে মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রোর মতো দেশগুলোতে আশ্রয় নেবার পর তাদের উপস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। কারণ সেসব দেশে নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য তাদের কাছে কোনোরকম লিখিত কাগজপত্র ছিল না।
বলকান অঞ্চল এবং ইউরোপজুড়ে এখনো অসংখ্য রোমানি ছড়িয়ে আছে। ইতালিতেও বিশ হাজারের অধিক রোমা নাগরিকত্বহীন বসবাস করছে। মেসিডোনিয়াতে দু লক্ষাধিক রোমানি বসবাস করছে, যারা এখনো নাগরিকত্বের জন্য লড়ে যাচ্ছে। নাগরিকত্ব ছাড়া প্রতিনিয়ত তারা মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে, তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। বলতে গেলে তাদের যাযাবর হিসেবে থাকার অভ্যাসই আজ তাদের নাম-পরিচয়হীন করে দিয়েছে!
৫. থাইল্যান্ডের জাতিগত সংখ্যালঘু
থাইল্যান্ডে বর্তমানে বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষ জাতিগত কোনো পরিচয়ের স্বীকৃতি ছাড়াই বসবাস করছে। থাইল্যান্ডের উত্তরে মায়ানমার এবং লাওস সীমান্তে জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চলে এসব জনগোষ্ঠী বসবাস করে। অঞ্চলগুলো একত্রে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল বা ‘স্বর্ণ-ত্রিভুজ’ হিসেবে পরিচিত, যেখানে হাইল্যান্ড জাতিগোষ্ঠী এবং মিশ্র মিলিশিয়াদের বসবাস। এরা একসময় মায়ানমার এবং থাই সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল।
থাইল্যান্ডে বসবাস করা লাখ লাখ অস্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর ভেতর আখনা, লানু, লিসু, ইয়াও অন্যতম। ১৯৮০ সাল থেকে তারা নাগরিকের স্বীকৃতি পেতে আবেদন করে আসছে। কিন্তু অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে তাদের নাগরিকত্বের আবেদনে সাড়া দিচ্ছিল না থাই সরকার।
সম্প্রতি সে দেশের সরকার চেষ্টা করছে অনুপ্রবেশকারী জনগোষ্ঠীগুলোকে নাগরিকত্ব দেওয়ার। এজন্য ২০১৩ সালে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে আশি হাজার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার পথ তৈরি করেছে থাই সরকার। এদের বেশিরভাগই অতীতে আগত শরণার্থীদের সন্তান এবং এ তালিকায় রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গাও।
এগুলো ছাড়াও পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য জাতি নিজের পরিচয় এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। চীন, কুয়েত, মালয়েশিয়া, আইভরি কোস্ট, কেনিয়া, নেপালসহ বেশ কিছু দেশে এরকম রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন জনগোষ্ঠী বসবাস করছে। এতে করে পৃথিবীর বড় একটি জনগোষ্ঠী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এভাবেই জাতিগত পরিচয়হীনভাবে বেড়ে উঠছে, যারা জানে না- তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে সামনের দিনগুলোতে!
বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/