কেমন হতো, যদি শীতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় সূর্যের দেখা মিলছে না, কিংবা শুধু রাতের পর রাত চলে যাচ্ছে, কিন্তু আলোকিত দিন আসছে না?
বাংলাদেশ হচ্ছে একটি নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ, যেখানে সূর্যের আলোর খুব একটা অভাব পড়ে না। কিন্তু এই আমাদের বাংলাদেশ যদি শীতের মাঝে অনন্ত রাতে ডুবে থাকতো, তাহলে কেমন হতো? কখনো ভেবে দেখেছেন এটা? এটা সম্ভব হতো, যদি আমাদের দেশটির অবস্থান উত্তর মেরু বা দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি কোথাও হতো। তার মানে যেসব দেশ সেসব জায়গায় আছে তারা কি তাহলে শীত আসলে সূর্যের দেখা পায় না? হ্যাঁ, ব্যাপারটি এরকমই।
পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের বেশ কিছু জায়গায় বছরের শেষ ভাগে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের অংশে বছরের মাঝামাঝি এমনইভাবে সূর্যের দেখা পাওয়া যায় না। তাহলে কি ভ্যাম্পায়ার অথবা ভয়ানক জীবগুলো সেসব জায়গায় বেশি থাকে, যেখানে সূর্যের আলো সহজে পৌঁছায় না? সেসব জায়গার মানুষেরা কীভাবে বসবাস করছে? আর কী কারণেই বা সেখানে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সূর্যের আলো পৌঁছায় না? এসব প্রশ্নের উত্তর নিচে বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হবে।
প্রথমেই জেনে নেয়া যাক, কী কারণে উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের কিছু জায়গাতে শীতকালে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। এই বিষয়টি মূলত ঘটে থাকে মেরুবৃত্তের ভেতরের অংশগুলোতে, যখন সূর্যের মধ্যভাগ বা চাকতিটি মুক্ত দিগন্তের নিচে চলে যায়। পৃথিবীর অক্ষীয় ঢাল প্রায় ২৩ ডিগ্রী, ফলে উত্তর গোলার্ধের মুক্ত দিগন্তের নিচে যদি সূর্যের আলো অবস্থান করে, তাহলে সেসব জায়গায় টানা অনেকদিন রাতের মতো অবস্থা তৈরি হয় এবং অন্যপাশে দক্ষিণ গোলার্ধে তখন টানা দিনের আলো ফুটে থাকে অর্থাৎ রাতের দেখা মেলে না। টানা রাতের মতো পরিবেশ তৈরি হওয়াকে ইংরেজিতে পোলার নাইট বা মেরু রাত্রি বলা হয়ে থাকে। যখন রাতের সময়টা টানা ২৪ ঘণ্টা অতিক্রম করে, তখন সেটাকে মেরু রাত্রি বলা হয়।
উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ডিসেম্বরের দিকে সূর্যের আলো এন্টার্কটিক ( দক্ষিণ মেরু ) বৃত্তের অঞ্চলে পড়ছে। কিন্তু একই সময়েই অন্য পাশে আর্কটিক (উত্তর মেরু) বৃত্তের অঞ্চলে পড়ছে না, ফলে এই মেরু রাত্রির সৃষ্টি হয় এবং এর ব্যপ্তিকাল কয়েক মাস।
এই মেরু রাত্রি কয়েক রকমের হয়ে থাকে । যেমন-
- অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল পোলার নাইট কয়েক রকম পোলার নাইটের মধ্যে একটি। যখন কোনো গোধূলী ছাড়া অন্ধকারাচ্ছন্ন টানা রাত বিরাজ করে, তখন একে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল পোলার নাইট বলা হয়। সূর্য যখন দিগন্তের নিচে ১৮-২৩.৫ ডিগ্রীর মধ্যে থাকে, তখন এটি হয়। সাধারণত ১৪ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত উত্তর মেরুতে এবং ১৫ মে থেকে জুলাইয়ের শেষভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ মেরুতে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল পোলার নাইট হতে দেখা যায় ।
- যখন মধ্যাহ্নের দিকে একঝলক দিনের আলো দেখা যায়, সেই সময়কে নটিক্যাল পোলার নাইট বলা হয়। আলোর প্রতিসরণের ফলে এমনটি হয়। সূর্য তখন দিগন্তের নিচে প্রায় ১২ ডিগ্রীর চেয়ে কমে থাকে। কানাডার নুনাভাটের এলার্টে বছরের নভেম্বরের শেষভাগ থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এ ধরনের পোলার নাইট হতে দেখা যায়। এই জায়গাটি কানাডার উত্তরদিকের শেষ সীমায় অবস্থিত।
- আরেকটি হচ্ছে সিভিল পোলার নাইট। এই সময়ের ক্ষেত্রেও মধ্যাহ্নের দিকে হালকা আলো দেখা যায়। নরওয়ের ভালবার্ড নামক জায়গায় নভেম্বরের ১১ তারিখ থেকে জানুয়ারির ৩০ তারিখ পর্যন্ত এর ব্যপ্তিকাল।
এবার কিছু জায়গার সাথে পরিচিত হওয়া যাক, যেখানে বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময় সূর্যের আলো পৌঁছায় না এবং সেখানকার মানুষ কীভাবে সেই পরিস্থিতিতে বসবাস করছে।
ভালবার্ড, নরওয়ে
বছরে ৪ মাস (২৬ অক্টোবর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি) রাতের অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকে নরওয়ের আর্কিপেলাগো বা দ্বীপপুঞ্জ স্ভালবার্ড। ২,৬০০ এরও বেশি মানুষ বসবাস করছে এখানে। এখানে রয়েছে তুন্দ্রা বনভূমি, যেখানে মেরু ভালুক, ভালবার্ড রেইনডিয়ার ও আর্কটিক শিয়াল আছে। তাপমাত্রা সেখানে -২৫ ডিগ্রী থেকে -৩০ ডিগ্রীর মধ্যে থাকে, যার ফলে বেশিরভাগ মানুষ ঘরের ভেতরেই থাকে এবং কাজ করার পাশাপাশি অনেক বেশি মদ্যপান করে সময়টা হাসিখুশিভাবে কাটানোর চেষ্টা করে।
সেইসাথে এখানকার লোকজনদের আয়কর কম দিতে হয়। কয়লা খনিভিত্তিক কাজ এখানে প্রচুর। তাছাড়া অসাধারণ মেরুপ্রভা দেখা যায় এখানে। পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তর প্রান্তের শহর লংইয়ারবিন এখানে অবস্থিত। এখানকার অন্যতম বিস্ময়কর একটি স্থাপনা হচ্ছে গ্লোবাল সিড ভল্ট, যেখানে সব প্রজাতির বীজ সংরক্ষণ করা আছে। একে সিড ব্যাংকও বলা হয়। কোন মহাদুর্যোগে যদি পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা ধ্বংস হয়ে যায়, তবে পুনরায় বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে জীবন ফিরিয়ে আনার জন্য এই ভল্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
ট্রমসো শহর, নরওয়ে
আর্কটিক সার্কেলের ৩২১ কি.মি. উত্তরে নরওয়ের আরেকটি শহর হচ্ছে ট্রমসো, যেখানে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সূর্যের আলো পৌঁছায় না। একটি মজার ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তর দিকে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টি হচ্ছে ট্রমসো বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় ৭০,০০০ মানুষের বসবাস এখানে। এটি একটি ছোট্ট দ্বীপের মতো জায়গা। ১৯৬০ সালের দিকে সেখানে আর্কটিক ক্যাথেড্রাল (Arctic Cathedral) তৈরি করা হয়, যা সেখানকার অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন।
কিরুনা, সুইডেন
সুইডেনে অবস্থিত কিরুনা নামে একটি শহর আছে, যেটি আর্কটিক সার্কেলের ৫০ কি.মি. উত্তরে, যেখানে প্রায় ১৮,০০০ মানুষ বসবাস করছে। কিরুনাতে প্রায় ২৮ দিন যাবৎ কোনো সূর্যের আলোর দেখা মেলে না। এটি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পৌরসভা এবং এখানে লৌহ আকরিকের খনিও আছে।
উটকিয়াগভিক, আলাস্কা, যুক্তরাষ্ট্র
এরপর আসা যাক যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত একটি শহরে, যার নাম উটকিয়াগভিক, যেটি আলাস্কা রাজ্যের একটি অংশ। এর আগের নাম ছিল ব্যারো টাউন। এখানে প্রায় ৬৫ দিন সূর্যের দেখা মিলবে না এবং এ বছরের শেষ সূর্যোদয়টা হয়ে গেল এই ১৮ নভেম্বর। ধরে নেয়া হচ্ছে, আগামী বছরের ২৩ জানুয়ারিতে পরবর্তী সূর্যের উদয় হবে সেই শহরে। মাত্র ৪,৪০০ এর কিছু বেশি মানুষ নিয়ে এই শহরটি দাঁড়িয়ে আছে সাগরের পাড়ে, যেজন্য এই এলাকার সাগর এবং তিমি শিকারের সাথে ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে এখানকার আদিবাসী মানুষদের। এই শহরেই আছে ইনুপিয়াক হেরিটেজ সেন্টার, যা সেই দেশের মধ্যে যথেষ্ট বিখ্যাত একটি স্থাপনা।
মুরমানস্ক, রাশিয়া
রাশিয়ার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মুরমানস্ক একটি শহর, যেখানে প্রায় ৬ সপ্তাহ পোলার নাইট বিরাজ করে। এখানে বসবাস করে প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। এখানে শীতের তীব্রতা কিছুটা কম, পাশাপাশি সূর্যের আলো ছাড়া বেশিদিন থাকতেও হয় না।
এরকম পরিস্থিতিতে সেখানকার মানুষ অভ্যস্তই বলা চলে, তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন চলতে থাকে। রাতের মতো অন্ধকারে বাচ্চারা স্কুলে যায়, মাঠে খেলাধুলা করে। তার সাথে যে মনোমুগ্ধকর মেরুপ্রভা দেখা যায় এই জায়গাগুলোতে, সেটি দেখতে এবং আরো অনেক কিছু উপভোগ করতে হাজার হাজার মানুষ সেখানে ঘুরতে যাচ্ছে এবং অদ্ভুত স্মৃতি সাথে করে নিয়ে ফিরছে।
পাঠক, লোকসমাগম কম এমন জায়গায় প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে সূর্যের আলো ব্যতীত দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পার করার বিষয়টা কল্পনা করলে কেমন অনুভূতি হয় আপনার?