বাস্তবতা কখনো কখনো হার মানায় মুখরোচক কল্পকাহিনিকে। বাস্তব জীবনের গল্পই বেশ রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে। যেমনটা ঘটেছে আন্দ্রেজ রুজোর সঙ্গে। আমাজনের গহীন অরণ্যে এক রহস্যময় নদীর খোঁজ পান আন্দ্রেজ। টগবগ করে ফুটছে সে নদীর পানি। রহস্যময় এ নদীর নাম শান্যাই-টিম্পিশকা। নদীকে শুধু প্রত্যক্ষ করেই ক্ষান্ত হননি, রূপকথার গল্পের বয়ে চলা সেই ফুটন্ত পানির নদী যে বাস্তবেই আছে, তা গোটা দুনিয়াকে জানিয়েছেন আন্দ্রেজ।
২০১৪ সালে টেডএক্স-এর এক বক্তৃতায় এ নদী নিয়ে তার অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ প্রায় সমস্ত তথ্য-উপাত্ত এবং ফলাফল সকলের সামনে তুলে ধরেন আন্দ্রেজ রুজো। ‘দ্য বয়েলিং রিভার অফ দ্যা আমাজন’ শীর্ষক সেই বক্তৃতার সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হচ্ছে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
লিমায় বেড়ে উঠা বালক হিসেবে আমার দাদা আমাকে পেরুতে স্প্যানিশদের বিজয়ের গল্প শুনিয়েছিল। গল্পে আতাহুয়ালপা ছিল ইনকা সাম্রাজ্যের রাজা। স্প্যানিশরা আতাহুয়ালপাকে বন্দী করে হত্যা করে। এরপরে পিজারো এবং তার সহযোদ্ধারা রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠে। তাদের বিজয় ও গৌরবের সোনালী গল্প স্পেনে গিয়ে পৌঁছায়। এতে করে স্প্যানিশরা আরও সোনা ও গৌরব অর্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। শহরে ফিরে গিয়ে তারা ইনকাদের বলে, “বলো, আমরা অন্য কোন সভ্যতা জয় করবো? কোথায় অসংখ্য সোনা আছে?”
ইনকারা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাদেরকে বলে, “আমাজনে যাও। সেখান থেকে তোমরা ইচ্ছামতো সোনা সংগ্রহ করতে পারবে। সেখানে পাইতিতি নামে এক হারানো শহর আছে। শহরের স্প্যানিশ নাম ডোরাডো। সে শহরের পুরোটাই সোনা দিয়ে তৈরি।” এ কথা শুনে স্প্যানিশরা সোনা খুঁজতে আমাজন জঙ্গলে চলে যায়। তবে তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিল। যারা ফিরে এসেছিল তাদের মুখে মুখে শোনা যায় অসংখ্য কেচ্ছা-কাহিনী। এদের মধ্যে আছে শক্তিশালী শামানদের (আদিবাসী গোষ্ঠী) গল্প, বিষাক্ত তীরন্দাজ যোদ্ধাদের গল্প; সেখানকার গাছেরা এতই উচুঁ হয় যে সেগুলো নাকি সূর্যকে ঢেকে ফেলে, মাকড়সা নাকি পাখি ধরে খায়, সাপ নাকি আস্ত মানুষ গিলে খায়। এবং সেখানে এমন এক নদী আছে যা প্রতিনিয়ত ফুটছে!
এসব আমার শৈশবের স্মৃতি। এরপর ১২ বছর কেটে গেছে। আমি এসএমইউতে (সাউদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটি) পিএইচডি করছি। পেরুর ভূ-তাপীয় শক্তির সম্ভাবনা বোঝার চেষ্টা করছি। আমার যখন সেই রূপকথার গল্পের কথা মনে পড়ে যায়, আমি সকলকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা শুরু করি। প্রশ্নটি হলো, ফুটন্ত নদীর কি আসলেই অস্তিত্ব আছে? আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি তেল, গ্যাস ও খনির কোম্পানির সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করলাম, এবং সর্বসম্মতভাবে উত্তরটি ছিল— না।
পৃথিবীতে ফুটন্ত নদী দেখা যায়, তবে সেগুলো আগ্নেয়গিরির সাথে সম্পর্কিত। কারণ, এত বড় ভূ-তাপীয় বহিঃপ্রকাশের জন্য একটা শক্তিশালী তাপ উৎসের প্রয়োজন। এবং এখানে এই লাল বিন্দুগুলো দেখতে পারেন (মানচিত্র দেখিয়ে), এগুলো হলো আগ্নেয়গিরি। আমাজনে কোনো আগ্নেয়গিরি নেই। পেরুর বেশিরভাগ অংশেও নেই। কাজেই আমরা এখানে ফুটন্ত নদী থাকার কোনো আশা রাখতে পারি না।
একদিন পারিবারিক নৈশভোজে সেই একই গল্প বলার সময় আমার আন্টি আমাকে জানান, “কিন্তু না আন্দ্রেজ, আমি সেখানে ছিলাম। আমি সেই নদীতে সাঁতার কেটেছি।” তখন আমার আংকেল লাফিয়ে উঠে বললেন, “না, আন্দ্রেজ, সে মজা করছে না। দেখো, ভারী বৃষ্টিপাতের পর তুমি তাতে সাঁতার কাটতে পারবে। এবং এ নদী একজন শক্তিশালী শামান (আদিবাসী ধর্মযাজক) দ্বারা সুরক্ষিত। তোমার আন্টি, তার স্ত্রীর বান্ধবী।” এ্যা…….তাই না-কি? (আংকেলের কথা শুনে আন্দ্রেজের প্রতিক্রিয়া)
আপনারা যেমন জানেন, বৈজ্ঞানিকভাবে সংশয় থাকা সত্ত্বেও, আমি জঙ্গলে হাইকিংয়ের জন্য গেলাম; যার নেতৃত্বে ছিলেন আমার আন্টি। জায়গাটি নিকটতম আগ্নেয়গিরির কেন্দ্র থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সত্যি বলতে, আমি রূপকথার গল্পে থাকা আমাজনের সেই ‘উষ্ণ-প্রস্রবণ’ দেখার জন্য নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলাম। কিন্তু তারপরে, আমি কিছু একটা শুনতে পেলাম। সেটা ছিল একটা মৃদু তরঙ্গ যা কাছে আসার সাথে সাথে ক্রমশ জোরালো হচ্ছিল। অনেকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্রমাগত আছড়ে পড়ার শব্দের মতো শোনাচ্ছিল। এরপর আমরা যত কাছে গিয়েছি গাছের মধ্য দিয়ে তত ধোঁয়া ও বাষ্প উঠে আসতে দেখেছি।
অতঃপর আমি এটা (ফুটন্ত নদী) দেখতে পেলাম। আমি সাথে সাথে পানিতে থার্মোমিটার ধরলাম, এবং গড় তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। এটা একেবারে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফুটন্ত নয়, তবে অবশ্যই এর খুব কাছাকাছি। নদীটি গরম ছিল এবং দ্রুত প্রবাহিত হচ্ছিল।
আমি নদীর প্রতিকূলে থেকে এ নদীকে অনুসরণ করে চলতে লাগলাম। আসলে নদীর সবচেয়ে পবিত্র স্থানে শামানের আখড়া ছিল। এটা অদ্ভুত। কারণ, এখান থেকে ঠাণ্ডা স্রোতের প্রবাহ শুরু হয়। গল্প অনুযায়ী, এর এক দিকে জলের দেবী ইয়াকুমামার বাড়ি। ইয়াকুমামা এক দৈত্যাকার সাপের আত্মা; যে পানি উত্তপ্ত করে এবং ঠাণ্ডা পানির জন্ম দেয়। এখানে একটা উষ্ণ-প্রস্রবণ দেখতে পাই। যা পাথরের চাঁইয়ের নিচ দিয়ে ঠাণ্ডা পানির সঙ্গে গরম পানিকে মিশিয়ে দিচ্ছিল; এটা এভাবে লৌকিক কাহিনীকে জীবন্ত করে রাখে।
পরবর্তী সকালে আমি ঘুম থেকে উঠলাম এবং চা চাইলাম। আমাকে মগ ও চা ব্যাগ নিয়ে নদীর দিকে যেতে নির্দেশ করা হলো। আমি অবাক হলাম। কারণ, নদীর পানি পরিষ্কার ছিল এবং তাতে একটা মনমাতানো স্বাদ ছিল; যদিও ভূ-তাপীয় সিস্টেমের জন্য সেটা পান করতে কিছুটা অদ্ভুত লাগছিল। আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, স্থানীয়রা সবসময় জায়গাটি সম্পর্কে জানত। এবং আমি কোনভাবেই প্রথম বহিরাগত ছিলাম না, যে নদীটি দেখেছে। এটা তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা এ নদীর পানি পান করে। এর বাষ্প গ্রহণ করে। রান্নার কাজে ব্যবহার করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ সারে। এমনকি নদীর পানি দিয়ে ওষুধও তৈরি করে।
আমি শামানের সাথে দেখা করলাম। তাকে নদী ও তার জঙ্গলের আরেক সংযোজন বলে মনে হচ্ছিল। তিনি আমার উদ্দেশ্যের কথা জানতে চাইলেন এবং মনোযোগ সহকারে তা শুনলেন। সত্যি বলতে, আমি একটু উদ্বিগ্ন ছিলাম। তারপরে, আমার উদ্বেগ নিরসনের জন্য, তার মুখ জুড়ে একটি হাসি ফুটে উঠল, এবং তিনি কেবল হাসলেন। অবশেষে নদী নিয়ে গবেষণা করার জন্য আমি শামানের কাছ থেকে অনুমতি পেলাম। তবে শামানের একটা শর্ত ছিল, জলের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষার পর, আমি পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন তা যেন আমি আবার মাটিতে ঢেলে দেই, যাতে করে পানি তার বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পেতে পারে।
২০১১ সালে প্রথমবার সফরের পর থেকে প্রতি বছর আমি সেখানে ছুটে গিয়েছি। এটা কখনও আনন্দদায়ক, কখনও আবশ্যক, আবার কখনওবা বিপজ্জনক ব্যাপার ছিল। এর একটি গল্প তো ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনেও স্থান পেয়েছিল। আমি সেইবার স্যান্ডেলে ব্যবহৃত পেপার শিট এবং বোর্ড শর্টস আকারের একটা পাথরে আটকা পড়েছিলাম। ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নদী এবং উষ্ণ-প্রস্রবণের মাঝামাঝি এক স্থানে। জায়গাটি ফুটন্ত নদীর খুব কাছাকাছি ছিল। তার ওপরে এটা ছিল আমাজন রেইনফরেস্ট। ভারী বৃষ্টির জন্য আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। আর তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে চারদিক ঝাপসা হয়ে আসছিল। খুবই ঝাপসা।
অনেক বছর কাজ করার পর, আমি খুব জলদি আমার করা ভূ-ভৌত ও ভূ-রাসায়নিক গবেষণাপত্র প্রকাশের জন্য জমা দেবো। এবং আজকে আমি প্রথমবারের মতো এই টেড মঞ্চে আপনাদের সকলের সাথে আমার আবিষ্কারের কিছু অংশ ভাগাভাগি করে নিতে চাই।
প্রথমত, এটা কোনো রূপকথার গল্প নয়। বরং আশ্চর্যজনক বিষয়! আমি যখন গবেষণার কাজ শুরু করি, শুরুতে স্যাটেলাইট ইমেজ খুব কম রেজুলেশনের ছিল। সেটা বোধগম্য ছিল না (তখনকার অস্পষ্ট স্যাটেলাইট ইমেজ দেখিয়ে)। সেখানকার ভালো কোনো মানচিত্র ছিল না। গুগল আর্থ টিমকে সহায়তার জন্য ধন্যবাদ। এখন আমাদের এটা আছে (বর্তমানের স্পষ্ট স্যাটেলাইট ইমেজ দেখিয়ে)। শুধু তাই নয়, এ নদীর আদি নাম ‘সান্যাই-টিম্পিশকা’। যার অর্থ সূর্যের তাপে ফুটন্ত (স্থানীয়রা সূর্যের তাপকে নদীর পানি ফোটার কারণ হিসাবে দায়ী করত)। এর নাম দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে; এ নদী কেন ফুটছে— এটা নিয়ে কাজ করা আমিই প্রথম ব্যক্তি নই, মানুষেরা সবসময় চারপাশের পৃথিবীকে জানতে চেয়েছে।
তাহলে এ নদী কেন ফুটছে? আসলে এই ফুটেজ পেতে আমার তিন বছর সময় লেগেছে (পানিতে বুদবুদের শব্দ শোনা যাচ্ছে এমন একটি ভিডিও ক্লিপ দেখিয়ে)। ছবিটি উষ্ণ-প্রসবণের। আমাদের শিরা ও ধমনীর মধ্য দিয়ে যেমন গরম রক্ত প্রবাহিত হয়, তেমনি পৃথিবীর ভূ-মধ্যস্থ ফাটল ও শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে গরম পানি প্রবাহিত হয়। পৃথিবীর ধমনী দিয়ে যেখানে ভূ-শক্তি ভূ-পৃষ্ঠের উপরে উঠে আসে সেখানে আমরা ভূ-তাপীয় বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। সেসবের মধ্যে আছে তাপীয় জল (Fumaroles), উষ্ণ-প্রসবণ (Hot Springs) এবং আমাদের ক্ষেত্রে তা ফুটন্ত নদী।
এ নদীর বিষ্ময় এর আকারের বিশালতায়; অবাক করার মতো দীর্ঘ। আপনি যখন পরবর্তীতে রাস্তা অতিক্রম করবেন, ভালোমতো খেয়াল করে দেখবেন যে, নদীর অধিকাংশ স্থানই দুই লেনের রাস্তার চেয়েও প্রশস্ত। প্রবাহিত নদীর প্রায় ৬.২৪ কিলোমিটার অংশ উত্তপ্ত। সেখানে কিছু উষ্ণ পুল আছে। সেগুলো আকারে এই টেড মঞ্চের চেয়ে বড়। কিছু ঝর্ণাও দেখা যায়। সেগুলো উচ্চতায় ৬ মিটারের মতো। সেগুলোর সবই প্রায় ফুটন্ত নদীর কাছাকাছি অবস্থিত।
আমরা নদীর ধারের তাপমাত্রা ম্যাপ করেছি, এবং এটা এ নদীর সবচেয়ে উত্তপ্ত অংশ (উপরের জিওথার্মাল ম্যাপ দেখিয়ে)। এবং এর ফলাফল ছিল অবাক করা। এখানে একটা অবিশ্বাস্য প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শুরুতে দেখবেন, নদী ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে (উপরের জিওথার্মাল ম্যাপ দেখিয়ে)। তারপরে, উত্তপ্ত হয়ে আবার ঠাণ্ডা হচ্ছে, আবার উত্তপ্ত হয়ে আবার ঠাণ্ডা হচ্ছে, আবার উত্তপ্ত হচ্ছে, এবং যতক্ষণ ঠাণ্ডা পানির নদীতে গিয়ে না মিশেছে।
আমি বুঝতে পারছি আপনারা সকলে ভূবিজ্ঞানী নন। তাই আরও সহজ করে বললে: সবাই কফি পান করতে পছন্দ করে। হ্যাঁ (শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে)? খুব ভালো (গ্যালারি থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়ে)। প্রতিদিনের কফি কাপের তাপমাত্রা থাকে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা খুব গরম হলে হয় ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এক্ষেত্রে কফি কাপের কথাই ধরা যাক, ফুটন্ত নদী ঠিক এমনই (ম্যাপ দেখিয়ে)। এখানে (৫৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১৩০ ডিগ্রি ফারেনহাইট) গরম কফি আছে। আর এখানে আছে খুব গরম কফি (৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ১৪০ ডিগ্রি ফারেনহাইট)। একটি বিট পয়েন্টও আছে; এখানে নদী খুব গরম কফির চেয়েও বেশি গরম। কিন্তু পানির তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১১৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট) হলেই সেটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।
আমরা আর্দ্রতম ভূ-তাপীয় তাপমাত্রার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ম্যাপটি শুষ্ক মৌসুমে তৈরি করেছি। তবে এখানে একটি জাদুর সংখ্যা আছে, যা এখানে দেখানো হয়নি। সংখ্যাটি হলো ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কারণ, এ তাপমাত্রা থেকে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়; আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানি। তাপমাত্রা এর উপরে গেলে, আপনি সেই পানিতে নামতে যাবেন না। এ ব্যাপারে আপনাকে সাবধান হতে হবে। এটা মারাত্মক হতে পারে।
আমি নদীতে বিভিন্ন প্রাণীকে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি। এটা আমাকে অবাক করেছে। কারণ, সকল ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি প্রায় একই রকম। প্রাণীগুলো যখন নদীর পানিতে পড়ে, প্রথমেই প্রচণ্ড উত্তপ্ত পানিতে তার চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চোখ খুব তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়ে যায়। দেখতে দুধ-সাদা রঙের হয়ে যায়। এরা সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করতেই থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে এদের পেশী ও হার সেদ্ধ হতে শুরু করে। কারণ, পানি খুব উত্তপ্ত। যতক্ষণ না উত্তপ্ত পানি প্রাণীর মুখে গিয়ে এটা ভেতর থেকে সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে, এগুলো শক্তি হারাতেই থাকে।
বিষয়টি দুঃখজনক, তাই না? এর তাপমাত্রার কারণে আবারও আপনাকে অবাক হতে হবে। আমি সারা বিশ্বের আগ্নেয়গিরিতে এমনটা হতে দেখেছি। ইয়েলোস্টোনের মতো সুপার আগ্নেয়গিরিতেও এটা হতে দেখেছি। তবে এখানে আরেকটি ব্যাপার আছে। তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে ফুটন্ত নদীটি আগ্নেয়গিরির প্রভাব থেকে মুক্ত। আবার উৎপত্তিগতভাবে এটা ম্যাগম্যাটিক ক্ষেত্রে কিংবা আগ্নেয়গিরির কোনোটাই নয়। এমনকি নিকটবর্তী আগ্নেয়গিরির কেন্দ্র থেকেও ৭০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাহলে এ নদীর পানি উত্তপ্ত হওয়ার পেছনের কারণ আসলে কী?
আমি বছরের পর বছর ধরে ভূবিজ্ঞানী এবং আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞদের মতামত জানার চেষ্টা করেছি, কিন্তু এর মতো আগ্নেয়গিরিবিহীন ভূ-তাপীয় সিস্টেমের আর একটিও খুঁজে পাইনি। এটা অনন্য। গোটা বিশ্বে বিশেষ। প্রশ্ন হলো, এটা কীভাবে কাজ করে? তাপের যোগান কোথা থেকে আসে? এ নিয়ে নিবিড় গবেষণা প্রয়োজন। সিস্টেমটিকে আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য আরও গবেষণা করা এখনও বাকি আছে। তবে এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে একে বড় কোনো হাইড্রোথার্মাল সিস্টেমের ফলাফল বলে মনে হচ্ছে।
সিস্টেমটি মূলত এভাবে কাজ করে: পৃথিবীর যত গভীরে যাওয়া যাবে, এটা তত গরম হবে। আমরা একে জিওথার্মাল গ্রেডিয়েন্ট (Geothermal Gradient) বলি। জল আন্দিজের হিমবাহের মতো দূর থেকেও আসতে পারে। তারপরে এ জল ভূ-গর্ভস্থ ফাটলের গভীরে প্রবেশ করে এবং জিওথার্মাল গ্রেডিয়েন্ট থেকে উত্তপ্ত হয়ে ফুটন্ত নদী আকারে বাইরে বেরিয়ে আসে। এমনটা ঘটে এই অনন্য ভূ-তাত্ত্বিক পরিবেশের কারণে।
আমরা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সহকর্মীদের সাথে ড. স্পেন্সার ওয়েলস, ড. জন আইজেন এবং ড. ইউসি ডেভিসকে নিয়ে নদী ও তার আশেপাশে বসবাসকারী এক্সট্রোমোফাইল লাইফফর্মের জেনেটিক্যালি সিকোয়েন্স করেছি। ফুটন্ত নদীতে বসবাসকারী নতুন লাইফফর্ম ও অনন্য প্রজাতি খুঁজে পেয়েছি।
তবে সমস্ত গবেষণা, আবিষ্কার ও কল্পকাহিনী সত্ত্বেও, প্রশ্ন থেকে যায়। তা হলো, ফুটন্ত নদীর তাৎপর্য কী? কিংবা জঙ্গলের এই অংশে সবসময় ঘোরাফেরা করা এই স্থির মেঘেরই তাৎপর্য কী (জঙ্গলের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সবসময় জমে থাকা মেঘের ছবি দেখিয়ে)? শৈশবে শোনা কল্পকাহিনির বিস্তারিত তাৎপর্য কী? শামান ও তার সম্প্রদায়ের জন্য, এটা পবিত্র স্থান। একজন ভূ-বিজ্ঞানী হিসেবে আমার জন্য, এটা অনন্য ভূ-তাপীয় ঘটনা। কিন্তু অবৈধ লগার ও গবাদি পশু খামারিদের জন্য, এটা শোষণের হাতিয়ার। আর পেরু সরকারের কাছে, এটা উন্নয়নের জন্য প্রস্তুত অরক্ষিত জমির একটি অংশ মাত্র।
এক্ষেত্রে আমার লক্ষ্য একটাই। সেটা হচ্ছে, এই জমি যেই নিয়ন্ত্রণ করুক, সে যেন ফুটন্ত নদীর অনন্যতা এবং এর তাৎপর্য বুঝতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা। কারণ, এটা প্রশ্নের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মর্মার্থ। আমাদের সেই সক্ষমতা আছে। আমরাই তারা যারা পবিত্রতা আর তুচ্ছের মাঝে সীমারেখা এঁকেছি। বর্তমানে যেখানে সবকিছু ম্যাপ করা, পরিমাপ করা এবং অধ্যয়ন করা হয়েছে বলে মনে করা হয়, সেখানে আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে আবিষ্কার কেবল অজানার অন্ধকার শূন্যতায় করা হয় না, বিহ্বলকারী উপাত্তের অভ্যন্তরেও করা হয়।
অনেক কিছু উদঘাটন করার জন্য বাকি আছে। এক অভাবনীয় বিশ্বে আমাদের বসবাস। তাই বাইরে যান। কৌতূহলী হোন। কারণ, আমাদের বসবাস এমন এক জগতে, যেখানে শামানরা জঙ্গলের আত্মার উদ্দেশ্যে গান গায়, যেখানে রূপকথার মতন বাস্তবে নদীর পানি ফুটছে এবং যেখানে কল্পকাহিনিরা জীবন জুড়ে থাকে।